সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সংসদ নির্বাচনের একটি বড় ফ্যাক্টর

গাজীপুর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ের পর পত্রপত্রিকায় এবং টেলিভিশনের টকশোতে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। তবে সব আলোচনাকে টেক্কা মেরেছে আওয়ামী লীগ দলীয় তরুণ এমপি গোলাম মাওলা রনির মন্তব্য। তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘কোথায় আমাদের দলীয় আমলরা ও পুলিশ কর্মকর্তারা, যারা আমাদের জয়ের স্বপ্ন দেখাত? কোথায় আমাদের তথাকথিত চামচারা, যারা বলত, সব কিছু ঠিক আছে? গাজীপুরে জয় নয়, সম্মানজনক পরাজয়টুকু কেন পেলাম না? প্রার্থী আজমত উল্লাহর কী দোষ ছিল? কেন গাজীপুরে গেলেন না ব্যবসায়ী নেতারা? যাদের এতগুলো টেলিভিশন, কুইক রেন্টাল, ব্যাংক, বীমা ও শেয়ারবাজার দেয়া হলোÑ তারা আজ কোথায়? দেশপ্রেমিকদেরই বা কী হলো? যারা আগুন লাগাল তারা মীরজাফর না, যারা আগুনের ব্যাপারে সতর্ক করল তারা দোষী। সেলুকাস, তুমি কোথায়। দেখ, বঙ্গের মীরজাফরেরা কিভাবে মালয়েশিয়া ও কানাডা পালাচ্ছে।নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি, মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, বিরোধী মতাবলম্বীদের দমনপীড়ন, আস্তিক-নাস্তিক ইস্যু, মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, জনশক্তি রফতানিতে জটিলতা, শেয়ারবাজার, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লুটপাট এবং শেষ সময়ে জনপ্রিয়তায় ধস প্রভৃতি নিয়ে এক কঠিন সময় পার করছে মহাজোট সরকার। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে গুম-খুনের ব্যাপক অভিযোগ, বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব খাটানোয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উপেক্ষা করা, পররাষ্ট্র নীতিতে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বিচ্যুতিসহ নানা কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সরকার। বিশ্বমিডিয়ায় বাংলাদেশের ক্রমাবনতিশীল এসব চিত্র সবিস্তার উঠে আসছে প্রতিনিয়ত। রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে উদ্যোগ নেই সরকারের। একই সাথে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কোন্দল, সঙ্ঘাত ও বিভক্তি এবং ঈদের পর বিরোধী দলের লাগাতার কঠোর আন্দোলনের হুমকিতে ঘরে-বাইরে অস্বস্তিতে রয়েছে ক্ষমতাসীন দল ও সরকার। চাপ সইতে না পেরে দল ও সরকারের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের পদত্যাগের গুঞ্জন উঠেছে একাধিকবার। তাদের একেকজন একেকভাবে কথা বলায় ভারসাম্যহীনতাই বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। সরকার এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজছে। বিশ্লেষকদের মতে, দেশের অভ্যন্তরীণ ও বাইরের কোনো পরিস্থিতিই সামাল দিতে পারছে না সরকার। বিশেষ করে কয়েকটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পর আরো ঘোলাটে হয়ে উঠেছে পরিস্থিতি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পরিকল্পনায় রাজনৈতিক মাঠ আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। রায়ের পাশাপাশি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার প্রয়াস চলছে। বিরোধী দল দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যথেচ্ছ ব্যবহার মানুষকে করে তুলেছে ুব্ধ। জনগণের মতো দলের ভেতরে ও বাইরে সৃষ্টি হয়েছে এ নিয়ে চরম ক্ষোভ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের লুটপাট, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলার বিপরীত কর্মকাণ্ড ইত্যাদি বিষয়ে জবাব দিতে পারছেন না সরকারি দলের শীর্ষ নেতারা। অনেক মন্ত্রী-এমপি এলাকায় যেতে পারছেন না। গেলেও লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। বিশ্বমিডিয়ায় এখন সরব আলোচনা চলছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত ছাড়া তেমন কোনো দেশকে পাশে পাচ্ছে না সরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দেয়া হলেও আগামী নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে তা চূড়ান্ত হয়নি। তবে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার ১২ সেপ্টেম্বরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগের ৬২ ভাগ ভোটার তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে, ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ৬৩ ভাগের।উচ্চ আদালতের রায়ের কথা বলে আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিলেও সরকারের এই কাজে খুশি নয় দেশের প্রায় ৮১ শতাংশ ভোটার। ওই রায়ে আরো দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পরামর্শ থাকলেও তড়িঘড়ি করে সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংসদে ব্রুট মেজরিটির জোরে বাতিল করে লেজে-গোবরে অবস্থায় ফেলেছে দেশের রাজনীতিকে। অন্য দিকে মাত্র ১৫ শতাংশ ভোটার তত্ত্বাবধায়ক সংক্রান্ত সাংবিধানিক পরিবর্তনের পক্ষে রয়েছে। তারা হার্ড লাইন আওয়ামী লীগার বলে জানা গেছে। দেশী-বিদেশী নানা চাপের মুখেও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে এখনো অনড় অবস্থানে সরকার। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। সরকারের উচিত গোঁয়ার্তুমি ত্যাগ করে সমঝোতার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করা। বর্তমান অবস্থায় যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে তা দেশ-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। পুনরায় নির্বাচন করতে হবে। আর আওয়ামী লীগ ও মহাজোট চাইলেও শান্তিতে যে নির্বাচন হবে না, তা নিশ্চিত। মহাজোটের কোনো কোনো দল সংলাপের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য উপায়ে নির্বাচন করার পরামর্শ দিয়েছে আওয়ামী লীগকে। অন্য দিকে বিরোধীদলীয় জোট নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায়ে আরো কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে। ঈদের পর চূড়ান্ত আন্দোলনের ঘোষণাও দিয়েছে তারা। দেশ অচল করে দেয়ার হুমকিও দিয়েছেন বিরোধী দলের নেতারা। পাশাপাশি হেফাজতে ইসলামও তাদের ১৩ দফা দাবি আদায়ে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে। বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাতে আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনীতির মাঠ। জঙ্গিবাদের ধুয়া তুলে ইসলামি দলগুলোকে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা চলছে। আওয়ামী লীগ বিদেশীদের বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে খুশি করতে চায় এই জঙ্গিবাদের কথা বলে। কিন্তু কোনো গণতান্ত্রিক মহল আওয়ামী লীগের এ গোঁজামিলের রাজনীতি পছন্দ করে না। তা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ অন্যান্য রাষ্ট্র তাদের কূটনীতিক চ্যানেলে হাসিনা সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে। হাসিনা সরকার ভালোভাবে জানে, ইসলামপন্থীরা তাদের ভোট দেবে না। তাদের আক্রোশটা সেখানেই। বাংলাদেশ ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ। এখানকার অধিকাংশ মুসলমান ধর্ম-কর্ম নিষ্ঠার সাথে করে থাকেন। সেই দেশে যখন অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড দেখে তখন তারা তা মেনে নিতে পারেন না। সরকার শাহবাগে জনগণের মঞ্চ বলে তিন মাস ধরে যে নাটক করেছে তা বাংলার মানুষ ভোলেনি। ব্লগাররা ইসলাম ও রাসূল সা:-এর প্রতি যে কটূক্তি করেছে, তার কঠোর প্রতিবাদ সারা দেশের মানুষ করেছে। শাহবাগ মঞ্চ সরকারের জন্য বুমেরাং হয়েছে। অথচ মঞ্চের নায়কদের সরকার জামাই আদরে রেখেছিল। হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন। ইসলামের বাণী সাধারণ মুসলমানদের কাছে পৌঁছানো এবং কেউ বা কোনো সংগঠন ইসলামবিরোধী কাজ করলে তার প্রতিবাদ করা এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য। তাদের ১৩ দফাতে এর উল্লেখ আছে। দেশের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে তারা কঠোর। শাহবাগের জনতার মঞ্চে ইসলামবিরোধী কাজের প্রতিবাদ করায় সারা দেশ থেকে তারা বিপুল সাড়া পান। তারা এপ্রিল মাসে সারা দেশে সমাবেশ করে তা দেখিয়ে দিলেন। ৫-৬ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে তারা যে মহাসমাবেশ করেছেন তার নজির বাংলাদেশে আর নেই। সরকার এতে ভীত হয়ে রাতের আঁধারে নিরীহ জনতার ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে পাশবিক হামলা চালিয়েছে। এই ঘটনায় সারা দেশ স্তম্ভিত। মুসলমানেরা বুঝতে পেরেছে বর্তমান সরকারের অধীনে ইসলাম নিরাপদ নয়। যে সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে তাতে ইসলামপ্রিয় জনগণ ভোটের ক্ষেত্রে নীরব বিপ্লব ঘটাবে। কারণ তারা দেখেছে সরকার ইসলামবিরোধী কাজই করে যাচ্ছে। অধিকন্তু ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা গত সাড়ে চার বছরে জাতীয় সম্পদ দেদার লুট করেছে। সরকার লুটের পথ খোলাসা করে দেয়ায় অর্থনীতি আজ চরম বিপর্যয়ের মুখে। সিন্ডিকেটের কর্মকাণ্ডে ব্যবসায়-বাণিজ্য রসাতলে গেছে। চাষি তার উৎপাদিত পণ্যের মূল্য না পেলেও শহরে এসে তার মূল্য হয়ে যায় তিন-চার গুণ। দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে মানুষ দিশেহারা। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে ৩৩ লাখ ুদ্র শেয়ার ব্যবসায়ী পথে বসেছেন। তাদের পোষ্য দেড় কোটি মানুষ ভীষণ দুর্ভোগে আছে। পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, হলমার্ক, ডেসটিনি ও অন্যান্য রক্তচোষা কোম্পানি সরকারি মদদে দেশের অর্থনীতির সর্বনাশ করে ছাড়ছে। এতে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা কি আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে? হেফাজতে ইসলামের যে বিরাট জনসমর্থন আছে তারা এবং ইসলামি দলগুলোর সমর্থকেরা কেউ আওয়ামী প্রার্থীকে ভোট দেবেন বলে আশা করতে পারে? সব কিছু মিলিয়েও রাষ্ট্র পরিচালনায় চরম ব্যর্থতার জন্য আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটকে মূল্য দিতেই হবে। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads