মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

কী হবে আগামীকাল


দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা খুবই সঙ্কটাপন্ন, অনেকাংশে বিপজ্জনকও বটে। কী কারণে এই সঙ্কট ও বিপদ এমন ঘনীভূত রূপ পরিগ্রহ করল, সে কথা কোনো মানুষেরই আজ কিছুমাত্র অজানা নয়। তবুও এ বিষয়ে আমরা সামান্য কিছু আলোচনা করা কর্তব্য বলে জ্ঞান করি। রাজনৈতিক যে সঙ্কট আজ কঠিন ও দুরতিক্রম্য হয়ে দেখা দিয়েছে তার একমাত্র কারণ আসন্ন নির্বাচন। নির্বাচন সংবিধান-সম্মতভাবে বর্তমান সরকারের অধীনে হবে, নাকি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাধীনে হবে, এই বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত বিরোধ অব্যাহত থাকবে; আর এখানেই সব বিপদ ও সঙ্কটের মূল কেন্দ্রবিন্দু। সবাই বলছেন, এই সঙ্কট নিরসনের একমাত্র উপায় দুই পক্ষের সংলাপ ও অর্থবহ আলোচনা। এই ধারণা নিরর্থক নয়; কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলো দেশের স্বার্থ ও কল্যাণচিন্তা মাথায় রেখে কোনো পক্ষই হয়তো এজাতীয় সংলাপ ও আলোচনা অনুষ্ঠানে আন্তরিকতা নিয়ে মুখোমুখি উপবিষ্ট হতে সম্মত হবে না। কারণ এখন পর্যন্ত যা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, তাতে এটাই অপরিহার্যরূপে প্রবল যে, দুপক্ষই স্ব স্ব অবস্থানে এতটাই অনড় ও অবিচল যে, তাদের মধ্যবর্তী ব্যবধান শুধু দুস্তরই নয়, রীতিমতো দুর্গম। এ অবস্থায় আলোচনা প্রায় অসম্ভব। তারপরও বিশেষ কোনো কারণে আলোচনা যদি হয়ও, সে আলোচনা হবে প্রকৃতপক্ষে নিষ্ফল ও অন্তঃসারহীন। অতএব যারা সংলাপ ও সমঝোতার কথা ভাবছেন, তাদের যে স্বপ্নভঙ্গ ঘটবে এটা প্রায় নিশ্চিত। বর্তমান আলোচক অবস্থাদৃষ্টে এ রকমই ধারণা পোষণ করেন। আলোচ্য সঙ্কটের আরো কিছু কারণ আছে যা কিঞ্চিৎ আলোচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশে রাজনীতি কোনো জনকল্যাণমূলক চেতনা ও সেবার সাথে সংযুক্ত নয়; রাজনীতি একটি নিরাপদ ব্যবসায়। এই ব্যবসায় থেকে অকেশে খ্যাতি ও ক্ষমতা যেমন করায়ত্ত করা যায়, অকেশে বিপুল বিত্ত-বৈভবেরও মালিক হওয়া সম্ভব। পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, শুধু রাজনীতি করার কারণেই কত অসংখ্য নিঃস্ব নিঃসম্বল মূষিক আজ এক একটি বিলিয়নিয়ার ঐরাবতে পরিণত হয়েছে। অতএব যেকোনো মূল্যে রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। শেখ হাসিনা দলের কর্ণধার বটে, কিন্তু তিনি ভালোভাবেই জানেন, তার চার দিকে যারা অন্ধ-আনুগত্য নিয়ে বিরাজমান, যাদের দ্বারা তিনি পরিবৃত, তারা বেশির ভাগই সদ্যোজাত ঐরাবত অথবা ঐরাবত হওয়ার তীব্র মনস্কামনা নিয়ে সক্রিয়। বস্তুত এদের প্রকৃত লক্ষ্য অর্থশিকার। এবং এই লক্ষ্য সামনে রেখেই তারা প্রধানমন্ত্রীর সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে সংবিধান বর্ণিত নির্বাচনী রূপরেখার অকুণ্ঠ সমর্থক। দু-চারজন ছাড়া শেখ হাসিনাকে সম্ভবত কেউই বিশেষ ভালোবাসে না। তারা সুবিধাবিলাসী, তারা ভালোবাসে প্রধানমন্ত্রীর প্রতাপ ও ক্ষমতাকে। সম্ভবত তারাই নিরন্তর সুপরামর্শদিয়ে চলেছে, জনগণের দাবি ও অভিপ্রায়কে মূল্য দেয়ার অর্থ দুর্বলতা, যা অনেকটা লড়াইয়ের ময়দানে যুদ্ধরত অবস্থায় স্বেচ্ছায় হাতিয়ার ফেলে দেয়ার শামিল। আর এই সুপরামর্শের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হলো, এক মাস কি এক সপ্তাহ কি একটি দিনও যদি শাসনক্ষমতাকে প্রলম্বিত করা যায়, তাহলেও অনেক লাভ। তারা জানে, ক্ষমতায় থাকা না-থাকার সাথে বঙ্গবন্ধু-তনয়া শেখ হাসিনার অস্তিত্ব ও মর্যাদার খুব একটা ইতরবিশেষ হবে না, কিন্তু পুষ্পবিলাসী মধুমক্ষিকাদের কী হবে? কী আর হবে। কিছুই হবে না, কারণ রাজনীতিকরূপী এসব মধুমক্ষিকার জীবনদর্শন বহুলাংশে জার্মান নাট্যকার ব্রেখটের মতো। সমাজতন্ত্র প্রভাবিত পূর্ব জার্মানির প্রস্তাব ছিল, ব্রেখট যেন পূর্ব জার্মানির পক্ষাবলম্বন করেন। ব্রেখট বললেন, তিনিও চান সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার অধীনে মানুষ সুখে-শান্তিতে জীবন নির্বাহ করুক, কিন্তু তার জন্য তিনি তার গাড়ি-বাড়ি ও আরামপ্রদ জীবন হারাতে রাজি নন। আমাদের বহু রাজনীতিবিদই ব্রেখটের এই দর্শনে বিশ্বাসী। তারা চান দেশের মানুষ সুখে থাক, রাজনীতির বিুব্ধ ময়দান শান্ত, নিরাপদ ও সুখময় হয়ে উঠুক; কিন্তু তার জন্য তারা তাদের পদ-পদবি ও শ্রমহীন অর্থাগমের পথ কোনোভাবেই বিসর্জন দেয়া সঙ্গত মনে করেন না। পাঠক নিশ্চয়ই ভাবতে পারেন, এসব কথা কেন বলছি। বলছি এ জন্য যে, প্রধানমন্ত্রী এবং বেগম জিয়া যে আপন আপন অবস্থানে অটল ও নির্বিকার তার কারণ শুধু এই নয় যে, তারা উভয়েই কঠিন জিদ ও কঠিন অহংবোধ দ্বারা চালিত; বরং প্রকৃত কারণ সম্ভবত এই যে, তাদের চতুর্দিকে উপগ্রহের মতো ঘূর্ণায়মান বিদূষক ও স্তাবকদের বিরামহীন পরামর্শ, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তারা উপেক্ষা করতে পারছেন না। এ বিষয়ে আমরা একটু বিশদ আলোচনার আবশ্যকতা অনুভব করি। দেশের বেশির ভাগ মানুষ, বেশির ভাগ সংবিধান বিশেষজ্ঞ, প্রায় সব রাজনৈতিক দল, এমনকি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান অস্থিরচিত্ত এরশাদ সাহেব সবাই দ্ব্যর্থহীনভাবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিকে সঙ্কট মোচনের একমাত্র পথ ও উপায় হিসেবে মনে করছেন। শুধু তাই নয়, বিদেশী অনেক রাষ্ট্রদূতও এই একই ধারণা ব্যক্ত করছেন যে, সব দলের অংশগ্রহণে একটি স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। সম্প্রতি চীনা রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুনও দুই নেত্রীর মধ্যে জরুরি আলোচনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এবং এই লক্ষ্যে মহাসচিব নিজে এবং জাতিসঙ্ঘের কোনো দূতও হয়তো ঢাকায় এসে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে কথা বলবেন। কিন্তু সমূহ বিস্ময়ের ব্যাপার, এত কিছু সত্ত্বেও কেউই নিশ্চিত হতে পারছেন না যে, আসন্ন নির্বাচন সর্বজনগ্রাহ্য পথে ও প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে কি হবে না। দেশ যেন আক্ষরিক অর্থেই এক গাঢ় কুজ্ঝটিকার মধ্যে প্রবেশ করেছে। আর এই কুজ্ঝটিকা এতটাই ঘন ও রহস্যময় যে, কী হবে আগামীকাল একমাত্র আল্লাহ পাক ছাড়া সে কথা কেউ জানে না। একটি কথা উল্লেখযোগ্য, দৃশ্যত প্রধানমন্ত্রীকে আপস-সমঝোতার ব্যাপারে যতটা অনমনীয় বলে মনে হচ্ছে, তিনি হয়তো তা নন। তিনি সম্ভবত এক কঠিন দ্বিমুখী সঙ্কটে আক্রান্ত। আগেই বলেছি, পার্শ্বচর বহুসংখ্যক স্তাবক তার অহংবোধকে এমনভাবে উত্তেজিত করে তুলছে যে, তিনি কিছুতেই নিজেকে স্থির ও নির্ভার করে তুলতে পারছেন না। দ্বিতীয়ত, এমন কিছু বিদেশী শুভাকাক্সীওআছে যারা তাকে সর্বশেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনড়, অচঞ্চল ও অনম্য থাকার শক্তি, প্রেরণা ও পরামর্শ দিয়ে চলেছে। অবশ্য সবই আমাদের অনুমান মাত্র; কিন্তু কার্যত যদি এ রকমই হয়, তাহলে শিগগিরই আমরা বুঝতে পারব, খালি চোখে আমরা যা দেখি সেটা নিমজ্জমান বরফের একটি অতি ুদ্রাংশ মাত্র; অর্থাৎ সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় কারো কোনো প্রচেষ্টা ও উদ্যোগই সাফল্য লাভ করতে পারবে না। তদুপরি প্রস্তর কঠিন এই সমস্যার নিরসন অন্য একটি কারণেও দুঃসম্ভব; এবং তা হলো ক্ষমতার মসনদ সবার কাছেই বড় প্রিয়, অনেক মূল্যের বিনিময়ে হলেও যা আঁকড়ে ধরার মতো বস্তু। এই আকর্ষণ উপেক্ষা ও অবহেলা করার মতো মানসিক শক্তি বিদ্যমান, এমন মানুষ খুবই দু®প্রাপ্য। বলা আবশ্যক, আমাদের নির্বাচনকেন্দ্রিক সমস্যা বহুলাংশে এই মসনদপ্রীতির মধ্যে আবদ্ধ। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার যে দুর্নিবার মোহ ও আকর্ষণ, সেটাও অন্যতম কারণ যা বর্তমান সঙ্কটকে দারুণভাবে ঘনীভূত করেছে। যা হোক, বাস্তবিক অর্থেই লড়াই জমে উঠেছে। দুপক্ষই সমান উত্তেজিত ও সমান আত্মবিশ্বাসী। কারো পরাক্রমই কম নয়। দুপক্ষই নিজ নিজ তীè বুদ্ধি-কৌশল নিয়ে প্রস্তুত। আর এই লড়াইটার প্রকৃতিই এমন যে, এখানে ন্যায় ও ইনসাফ বলে কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নেই, দেশ ও দেশের জনগণের প্রতি ন্যূনতম দায়িত্ববোধও এখানে অচল ও বাহুল্য; এমনকি দেশের অস্তিত্বেও যদি টান পড়ে, যদি সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ারও উপক্রম হয়, কারো পক্ষেই পরাভব মেনে নেয়া সম্ভব নয়। সন্দেহ নেই, উভয় দিকেই প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী কিছু মানুষ আছেন, ক্ষমতা ও অহমিকা ও লঘু-বীরত্বের চেয়ে সত্য ও বিবেকবোধ যাদের কাছে বড়, কিন্তু তাদের ভূমিকা ও রণকৌশল বাস্তব ক্ষেত্রে কোনো কাজেই আসছে না। আসার কথাও নয়, কারণ প্রেমে ও সমরে যারা ইনসাফের কথা ভাবে তারা ঋষি; সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের কথা যারা বলে তারা ঋষিপ্রতিম ন্যায়ঋদ্ধ পুরুষ হতে পারে, কিন্তু লড়াইয়ের ময়দান-কাঁপানো যোদ্ধা হতে পারে না। অতএব এই শঙ্কা ও আশঙ্কাই তীব্রতর হয়ে উঠছে যে, আমরা একটি ঘোরতর প্রাণঘাতী যুদ্ধের সম্মুখীন। স্বাভাবিক সমঝোতার পথ যেহেতু সঙ্কীর্ণ হতে হতে রুদ্ধপ্রায়, কোনো অভাবিত অলৌকিক কিছু না ঘটলে ঘূর্ণায়মান দুর্যোগকে প্রতিরোধ করা অসম্ভব। এ অবস্থায় ভীত ও উৎকণ্ঠিত জনগণ নসিবকে দোষারোপ করা ছাড়া দ্বিতীয় আর কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। বারবার বলতে হয়, উভয় শিবিরের অবস্থানগত দৃঢ়তা এতটাই ঋজু ও দুর্ভেদ্য যে, জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুন পর্যন্ত আজ বিচলিত। তিনি কী করবেন জানি না। তবে তারও উদ্যোগ যে কতটা সফল হবে, তা নিয়ে পর্যাপ্ত সন্দেহের অবকাশ আছে। মনে হয়, প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসার কথাই ঠিক, একটি প্রচণ্ড সুনামি বয়ে যাবে, তারপর যদি শান্ত ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে। আমাদেরও এ রকমই ধারণা। আমরা অবশ্যই আদৌ নৈরাশ্যবাদী নই; কিন্তু এটা তো সত্য যে, কথায় কথায় অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের কে বন্ধু আর কে আততায়ী, সে কথা এত দিনেও জানা হলো না। যারা বন্ধু, বর্তমান এই জটিল সঙ্কটাবস্থায় তারা অস্থির ও ভয়ার্ত; কিন্তু যারা বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে আলখেল্লা পরিহিত আততায়ী, লুকানো কৃপাণ নিয়ে যথাসময়ে ছুরিকাঘাতের জন্য তারা ওঁৎ পেতে আছে। ভয় দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে আল্লাহ পাক বাংলাদেশকে অনেক শিক্ষাই দিলেন; কিন্তু বিস্ময়কর যে, কোনো শিক্ষাই কোনো কাজে লাগল না। বুকভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে এখন শুধু একটাই প্রশ্নÑ কী হবে আগামীকাল! একটি কথা দিয়ে শেষ করি। জিউসের মন্দিরে একটি কঠিন গিঁট লাগানো রশি ছিল। সবার বিশ্বাস, এই গিঁট যে খুলতে পারবে সে হবে দিগি¦জয়ী। আলেকজান্ডার বিজয় অভিযানে বেরোনোর আগে মন্দিরে এলেন। শক্ত গিঁটটা হাতে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলেন, তারপর তরবারির এক আঘাতে দ্বিখণ্ডিত করে বললেন, ‘এ ধরনের গিঁট এভাবেই খুলতে হয়। গল্পটির সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে আমাদের এই বর্তমান নির্বাচনী সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে এই গল্পের কিছুটা হলেও যথার্থতা অনুধাবন করা সম্ভব। যা হোক, আমরা মনে করি, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কোনো প্রকৃত হেতু নেই; কারণ আল্লাহ পাক বলেনÑ ‘সার্বভৌম ক্ষমতার তিনিই একচ্ছত্র মালিক। তিনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করেন, যার কাছ থেকে ইচ্ছা কেড়ে নেন, যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন, যাকে ইচ্ছা নিক্ষেপ করেন জিল্লতির গহ্বরে। কল্যাণ তারই হাতে। নিশ্চয়ই তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ২৬)। অতএব আমাদের পক্ষে অপেক্ষা করাই উত্তম। দেখা যাক, আল্লাহ পাকের গায়েবি ফয়সালা আগামী দিনের জন্য কী বার্তা বহন করে আনে। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads