বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সবকিছুর মূলে রয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। একদিকে তারা নিজেদের ইচ্ছামতো পঞ্চদশ সংশোধনী এনে সংবিধানের খোলনলচে পাল্টে ফেলেছেন, অন্যদিকে ওই সংবিধান থেকে ‘এক চুল’ও নড়বেন না বলে ঘোষণা দিয়ে সংকটকে জটিল করে তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, প্রধানমন্ত্রী কোন সংবিধানের কথা বলেছেন? ক্ষমতাসীনরাই বা কোন সংবিধানের অধীনে একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে চাচ্ছেন? আমরা মনে করি, পুনরাবৃত্তি করে হলেও কিছুটা পেছনে ফিরে দেখা দরকার। জানা দরকার, কিভাবে সংবিধানের খোলনলচে পাল্টে ফেলা হয়েছে।
শুরুতেই বলতে হবে, সংবিধান নিয়ে ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক অর্থে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। কারণ, এমন এক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করেছে যিনি সরকারের কাছ থেকে ১০ লাখ ৩৭ হাজার ২৫০ টাকা ‘ত্রাণ’ নেয়াসহ ব্যক্তিগত কিছু কীর্তির কারণে নিন্দিত হয়েছেন। এই ‘ত্রাণ’ নেয়ার মাসখানেক আগে এক রায়ে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বানিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন। বিদায় নেয়ার প্রাক্কালে তিনিই আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও বাতিল ঘোষণা করে গেছেন। এ খবরও গোপন থাকেনি যে, পুনর্মুদ্রণের নামে সরকার যেভাবে সংবিধান সংশোধন করেছে ঠিক সেভাবেই রায় দিয়েছে তার নেতৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। সরকার অবশ্য বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক তথ্য জনগণকে জানতে দেয়নি। এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে তৎপরতা চালিয়েছে সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ সংসদীয় কমিটি। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে রাখা দূরে থাকুক, দল দুটির বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। অখ্যাত ও প্রত্যাখ্যাত এমন কিছু দল ও সংগঠনকে নিয়ে কমিটি আসর মাতিয়েছে যারা শুধু জনবিচ্ছন্ন নয়, যাদের কারো কারো বিরুদ্ধে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়ার লক্ষ্যে অপতৎপরতা চালানোর অভিযোগও রয়েছে। এজন্য এবং বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় সংসদীয় বিশেষ কমিটি প্রথম থেকেই বিতর্কিত হয়ে এসেছে।
সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে তৎপরতা চালিয়েছে সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ সংসদীয় কমিটি। ২০১০ সালের ২১ জুলাই গঠিত এ কমিটির চেয়ারম্যান বানানো হয়েছিল সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে। তিনি অবশ্য নামমাত্র চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। কারণ, ১৫ সদস্যের এ কমিটির সকল কর্মকান্ডে এ পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়েছেন কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বলে শুধু নয়, শুরু থেকে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম ও রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের মতো বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক চলেছে বলেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে নেতৃত্বের সুযোগ দেয়ার যৌক্তিকতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও ক্ষমতার দাপট যথেষ্টই দেখিয়েছেন। বিএনপি তো কমিটিতে যায়ই-নি, জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে ঠিক একজন উগ্র হিন্দুত্ববাদীর মতো যুদ্ধংদেহী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন সুরঞ্জিত। তিনি বলেছেন, জামায়াতকে কমিটিতে রাখার প্রশ্নই ওঠে না। সঙ্গে সঙ্গে উঠেছিল পাল্টা প্রশ্নÑ কেন প্রশ্ন উঠবে না? কারণ, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাশাপাশি জামায়াত বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। ১৯৮৬ সাল থেকে প্রতিটি সংসদে জামায়াত প্রতিনিধিত্ব করে এসেছে। বর্তমান সংসদেও দলটির প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। কিন্তু এত জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও কথা অনুযায়ী কাজও করে দেখিয়েছেন মিস্টার সেনগুপ্ত। জামায়াত সত্যি সত্যি কমিটিতে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। অন্যদিকে প্রত্যাখ্যাত কিছু দলকে নিয়ে শুধু নয়, ঘাদানিক ধরনের কিছু সংগঠনের পাশাপাশি বিতর্কিত ও নিন্দিত অনেক ব্যক্তিকেও রীতিমতো ‘নেমন্তন্ন’ করে এনেছেন তিনি। এদের মধ্যে রয়েছেন ভারতের দালাল হিসেবে চিহ্নিত শাহরিয়ার কবির এবং কবির চৌধুরীরা। এমন আরো অনেকেরই মতামত নেয়া হয়েছিল যারা কোনোদিক থেকেই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন না। শুধু তা-ই নয়, তাদের বিরুদ্ধে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়ার লক্ষ্যে অপতৎপরতা চালানোর অনস্বীকার্য অভিযোগও রয়েছে। কিন্তু সব জেনেও মিস্টার সেনগুপ্ত শাহরিয়ার কবির-কবির চৌধুরী গংদের নিয়েই লাফ-ঝাঁপ করেছেন, বাদ দিয়েছেন জামায়াতের মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত বড় একটি রাজনৈতিক দলকে। বাদ পড়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও। অথচ কোনো বিচারেই সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়া থেকে বিএনপি ও জামায়াতকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রসম্মত ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় সংসদীয় বিশেষ কমিটি প্রথম থেকেই বিতর্কিত ও প্রত্যাখ্যাত হয়ে এসেছে।
প্রশ্ন উঠেছে বিশেষ করে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে। কারণ, এর পেছনে রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ ইতিহাস। একটি রিট আবেদনের শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট হাই কোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন। সে রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়েছিল গত ১ মার্চ। ২০১১ সালের ১৬ মে বিদায় নেয়া প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চকে সহায়তা করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের ১০ জন সিনিয়র আইনজীবী অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিযুক্তি পেয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, বিচারপতি টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ড. এম জহির, ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি প্রমুখ বক্তব্য রেখেছেন। কিছু সংস্কার ও পরিবর্তনের সুপারিশ করলেও ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন ছাড়া অ্যামিকাস কিউরিদের প্রত্যেকেই কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। যেমন ৩০ মার্চ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তার বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা পদে সাবেক প্রধান বিচারপতিকে নিযুক্তি দেয়ার বিরোধিতা করে বলেছেন, সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য অন্য কোনো ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা করা উচিত। এর ফলে বিচার বিভাগ রাজনীতিমুক্ত হবে। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো আগে থেকেই হিসাব-নিকাশ করে ব্যবস্থা নেয় যাতে তাদের পছন্দের বিচারপতিরা প্রধান উপদেষ্টা হতে পারেন। প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার জন্য প্রধান বিচারপতিরাও নানাভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন (যেমনটি খায়রুল হকের ক্ষেত্রে দেখা গেছে)। এজন্যই ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, আপিল বিভাগের শুনানিতে ১০ জন অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে একজন ছাড়া বাকিদের কেউই কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার বিরোধিতা করেননি। কিন্তু দিনের পর দিন ধরে সংবিধানসম্মত ব্যাখ্যা ও বক্তব্য শোনার পরও একদিকে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হয়েছে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরাও আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অজুহাত হিসেবে যে রায়কে অবলম্বন করা হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে চিহ্নিত সে রায়টি একই সঙ্গে স্ববিরোধিতাপূর্ণ হিসেবেও বিতর্কিত হয়েছে। কারণ, রায়ে শুধু কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়নি, একথাও বলা হয়েছিল যে, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তাছাড়া এটি একটি বিভক্ত রায়। পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সাত সদস্যের মধ্যে কতজন কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করেছেন এবং তারা কি অভিমত দিয়েছেন সেকথাও এখনও অপ্রকাশিত রয়েছে। বড় কথা, রায়ের নামে যা ঘোষণা করা হয়েছে তা আসলে ‘সংক্ষিপ্ত আদেশ’, পূর্ণাঙ্গ রায় নয়। পূর্ণাঙ্গ রায় না দেখে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো সাংবিধানিক বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু সরকার সে কাজটিই করেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি বলে বসেছেন, আদালত অবৈধ ঘোষণা করায় কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার নাকি ‘আর কোনো সুযোগ নেই’! প্রধানমন্ত্রী কিন্তু সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গে জুড়ে দেয়া অভিমতটুকুর উল্লেখ পর্যন্ত করেননি, এখনো করছেন নাÑ যেখানে বলা হয়েছে, ‘দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু সংবিধানকে আওয়ামী লীগের ‘ইশতেহার’ বানানো উদ্দেশ্য ছিল বলেই সরকার সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরিপন্থী অবস্থানে চলে গেছে।
এখানে অন্য বিশেষ কিছু তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। এরকম একটি তথ্য হলো, রায় দিয়ে বিদায় নেয়া প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের গোপন যোগসাজশ ও সমঝোতা নিয়ে অনেক কথাই উঠেছে। কারণ, সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত সংসদীয় কমিটির পরামর্শে ২০১১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আইন মন্ত্রণালয় যেভাবে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করেছে ঠিক সেভাবেই ১০ মে রায় দিয়ে গেছে এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। অর্থাৎ আগে পুনর্মুদ্রিত সংবিধানে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাদ দেয়া হয়েছে, তারও তিন মাস পর পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের নামে ব্যবস্থাটিকে বাতিল ঘোষণা করেছেন খায়রুল হক। উল্লেখ্য, একই খায়রুল হকের নেতৃত্বে হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর পুরোটাই বাতিল ঘোষণা করেছিল। আপিল বিভাগও রায়টিকে বহাল রেখেছে। এর পর পর কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংবিধান পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল ১০ ফেব্রুয়ারি। অথচ আপিল বিভাগের বেঞ্চে তখনও কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা নিয়ে শুনানি শুরু হয়নি। শুনানি শুরু হয়েছিল ১ মার্চ থেকে, সংক্ষিপ্ত আদেশের আকারে যার রায় ঘোষিত হয়েছে ১০ মে। অথচ ১০ ফেব্রুয়ারি পুনর্মুদ্রিত সংবিধানেই কেয়ারটেকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়েছে। এর অর্থ, প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ করেছেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা একে গুরুতর বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, সরকার আদালতের রায়ের আলোকে ব্যবস্থা নিয়েছে, নাকি আদালতের রায়ে সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে?
এমন প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। কারণ, রায়ের জন্য শুধু নয়, ব্যক্তিগত অন্য কিছু কীর্তির কারণেও নিন্দিত হয়েছেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি। ২০০৯ সালের ২৭ জুলাই বিচারপতি খায়রুল হক সরকারের কাছ থেকে ‘ত্রাণ’ হিসেবে ১০ লাখ ৩৭ হাজার ২৫০ টাকা পেয়েছিলেন। খবরের পেছনের খবর ছিল, ওই টাকা পাওয়ার মাত্র কিছুদিন আগে, ২০০৯ সালের ২১ জুন বিচারপতি খায়রুল হক এক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ রায়ে ঘোষণা করেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক, জিয়াউর রহমান নন। অমন একটি রায় দেয়ার পর পর এত বিপুল পরিমাণ টাকা পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বিশেষ ইঙ্গিতসহ গুঞ্জন উঠেছে। এর পর জানা গেছে, পুনর্মুদ্রণের নামে সরকার যেভাবে সংবিধান সংশোধন করেছে প্রধান বিচারপতি হিসেবে ক্ষমতা খাটিয়ে ঠিক সেভাবেই রায় দিয়েছে খায়রুল হকের বেঞ্চ।
সে রায়ের ‘আলোকে’ সংবিধান সংশোধন এবং সেই সংবিধানের দোহাই দিয়ে ক্ষমতাসীনরাই শুধু বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে বেড়াচ্ছেন না, এর সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে নির্বাচন কমিশনও। এ ব্যাপারে সর্বশেষ উদাহরণ তৈরি করেছেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জাবেদ আলী। বৃহস্পতিবার তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো বাধা নেই। ভারতসহ বিভিন্ন দেশের উল্লেখ করে তিনি আরও বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির আশংকা অমূলক। কারণ, সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তারা এমনভাবে নির্বাচনী বিধিমালা সংশোধন করবেন যার ফলে সব দলের প্রার্থীরাই মন্ত্রী-এমপিদের মতো সমান সুযোগ পাবেন। অর্থাৎ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবে কমিশন। মুখে বললেও নির্বাচন কমিশনার জাবেদ আলীর কথাগুলো কিন্তু আদৌ বিশ্বাসযোগ্য হতে পারেনি। এর একটি কারণ, অনেক আগে থেকেই ব্যক্তিগতভাবে তিনি আওয়ামী ঘরানার লোক হিসেবে নিজের পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নির্বাচন কমিশনার হওয়ার পর কিছুদিন পর্যন্ত নিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণ নিলেও নির্বাচন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে খোলসটুকুও ঝেড়ে ফেলতে শুরু করেছেন তিনি। বিএনপির পাল্টা বিএনএফ নামের দলকে নিবন্ধন দেয়া এবং জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে জটিলতা সৃষ্টিসহ আরো অনেক কারণেই এ অভিযোগ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন আসলেও আওয়ামী লীগ সরকারের সেবাদাসের ভূমিকা পালন করে চলেছে। একই কারণে ‘মেরুদ-হীন’ ও ‘অথর্ব’ হিসেবে চিহ্নিত বর্তমান কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করা যায় না। ইসি আসলেও সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই কাজ করে চলেছে। কমিশনার জাবেদ আলী সে কথাটাই পরিষ্কার করেছেন মাত্র।বলা বাহুল্য, ইসির সকল সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমের পেছনেও সমর্থন যুগিয়ে চলেছেন ক্ষমতাসীনরা। এভাবে সব মিলিয়েই আওয়ামী লীগ সরকার গণতন্ত্রের পাশাপাশি দেশের সংবিধানের নাড়ি ধরেও টান মেরেছে। এর খোলনলচে পাল্টে ফেলেছে। বিএনপি ও জামায়াতকে সুযোগ না দেয়ার পাশাপাশি জনমতের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছে সরকার। এজন্যই সংসদে ভোটের জোরে পার করে নেয়া গেলেও সংশোধিত সংবিধান জনগণের সমর্থন পায়নি। এখন তো আরো পাচ্ছে না। এর কারণে দেশের রাজনৈতিক সংকটই বরং মারাত্মক হয়ে উঠবে। এমনকি দেশ এগিয়ে যেতে পারে সংঘাত ও সহিংসতার দিকেও। বলা দরকার, আশংকা অকারণে করা হচ্ছে না। করা হচ্ছে এজন্য যে, ক্ষমতাসীনরা যে সংবিধানের দোহাই দিচ্ছেন সেটা আসলে শেখ হাসিনা ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তদের সংবিধান। এক কথায় যাকে সঠিকভাবেই ‘আওয়ামী সংবিধান’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন