শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ফেলানী আমাদের ক্ষমা কর!


বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। নিজস্ব সামর্থ্য ও স্বকীয়তা নিয়ে বাংলাদেশ বেড়ে উঠেছে ধীরে ধীরে নিজের তুলনামূলক সুবিধাগুলোকে যতটা সম্ভব কাজে লাগিয়ে। বাংলাদেশী জনগণ শত সীমাবদ্ধতা আর প্রতিকূলতার মাঝেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ ভরণপোষণ বা নিরাপত্তার জন্য বড়ভাই দেশ ভারতের মুখাপেক্ষীও নয় কিন্তু মহাজোট সরকার ভারতের সাথে একতরফা নিঃশর্ত বন্ধুত্বের নামে এমন এক পররাষ্ট্রনীতির চর্চা করছে যে, আমাদের নাগরিকদের নিয়মিত বিনা বিচারে পাখির মতো গুলী করে মারার পরেও টু শব্দটি উচ্চারণ করছে না।
ফেলানী হত্যা মামলায় অভিযুক্ত বিএসএফের হাবিলদার অমিয় ঘোষ ‘নির্দোষ’ বলে রায় দিয়েছে বাহিনীর বিশেষ আদালত। বিএসএফ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য এই রায় বাহিনীর মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো হয়েছে।
এই খবরে হতাশা প্রকাশ করে ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম বলেছেন, “আমরা ন্যায়বিচার চাই।” ফেলানীর পরিবারকে আইনী সহায়তা দেয়া কুড়িগ্রাম জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর এসএম আব্রাহাম লিংকন বলছেন, বিএসএফের মহাপরিচালক এই রায়কে অনুমোদন দিলে তা হবে ‘চরম দুর্ভাগ্যজনক’। এতে বিএসএফের বেপরোয়া মনোভাব আরো উৎসাহিত হবে বলেও মনে করেন তিনি।
ওই রায়ে বলা হয়, বিএসএফ ১৮১ নম্বর ব্যাটালিয়নের হাবিলদার অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ আদালত পায়নি।
একি প্রকৃত অর্থে বন্ধুত্বের পররাষ্ট্রনীতি? নাকি নতজানু পদলেহী মানসিকতার পরিচায়ক? বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রনীতি উভয়ই এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমত, নাগরিকদের বিপন্ন জীবন রক্ষা করতে, দ্বিতীয়ত, জীবনহানির পর তার প্রতিকার করতে বা সুবিচার আদায় করতে এবং তৃতীয়ত, এমনতর নির্মম ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে।
বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ খুন হচ্ছে। পাখির মতো গুলী করে মানুষ মারছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন ও মানবাধিকারের কোনো তোয়াক্কা করছে না তারা। কখনও কখনও সীমান্ত অতিক্রম করে ভেতরে ঢুকেও মানুষ খুন করছে বিএসএফ। বিএসএফর এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর জবাবদিহিতার ব্যবস্থা না থাকায় এমনকি হত্যাকা-ের মতো গুরুতর অত্যাচারও বিনা বাধায় চলতে পারছে। এর মাধ্যমে এই বার্তাই পরিষ্কার হয় যে, ভারতীয় সরকার এসব অমানবিক অত্যাচারকে গ্রহণযোগ্য মনে করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর ডিসেম্বর, ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘ট্রিগার হ্যাপি ঃ এক্সেসিভ ইউজ অব ফোর্স বাই ইন্ডিয়ান ট্রুপস এট দ্যা বাংলাদেশ বর্ডার’ বা ‘গুলী ফোটানোর সুখ ঃ বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে গত এক দশকে ৯০০ বাংলাদেশী নাগরিকের হত্যাকা- ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে, এই ৯০০ জন নিহত বাংলাদেশীর মধ্যে রয়েছে দরিদ্র কৃষক কিংবা শ্রমিক যারা হয়তো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে গরু নিয়ে আসছিল সীমান্ত পেরিয়ে, কেউবা উদ্দেশ্যহীন গোলাগুলির শিকার, আবার কেউ হয়তো কোনো যথোপযুক্ত কারণ ছাড়াই খুন হয়েছে।
৭ জানুয়ারি ২০১১ প্রত্যুষে ১৫ বছরের বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানীকে কুড়িগ্রাম সীমান্তে বিএসএফ খুব কাছ থেকে ঠা-ামাথায় গুলী করে হত্যা করে তার লাশ ৫ ঘণ্টা ঝুলে রেখেছিল। দু’দিন পর লাশ ফেরত দিলেও বাংলাদেশ সরকার আর দশটি সীমান্ত হত্যাকা-ের মতো এটাকে চাপা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় পত্রিকার সৌজন্যে ও দৈনিক আমার দেশ এবং দৈনিক নয়াদিগন্তে ফেলানীর ঝুলে থাকা লাশের ছবি প্রকাশের পর বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে এ ঘটনা। সরকারও ১০ দিনের মাথায় ভারতীয় দূতকে ডেকে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু ফেলানীর মা-বাবাসহ দেশবাসী এ হত্যাকা-ের বিচার চেয়েছে।
কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকা কিশোরী ফেলানীর লাশ বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। শুধু ফেলানী নয়, এভাবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশীকে হত্যার রেকর্ড রয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে। রয়েছে কয়েক হাজার মানুষকে নির্যাতনের রেকর্ড। বিএসএফের হাতে হত্যাকা-ের প্রতিটি ঘটনার বিস্তারিত লোমহর্ষক বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় পত্রিকায়। সরকারও মাঝে-মধ্যে মৃদু গলায় এসবের প্রতিবাদ করছে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তুলেছে সীমান্ত হত্যাকা-ের এসব ঘটনা। কিন্তু ভারত এতে কর্ণপাত করেনি।
বাবা-মায়ের প্রথম ও দ্বিতীয় সন্তান মারা যাওয়ার পর ১৫ বছর আগে জন্ম নেয়া এই শিশুটি যাতে বেঁচে থাকে, সে আশা নিয়েই তার নাম রাখা হয়েছিল ফেলানী। মাত্র এক সপ্তাহ পরে ছিল তার বিয়ে। স্বামীর ঘরে যাওয়ার মতো করে মেয়েকে নিজ হাতে সাজিয়ে দিয়েছিলেন মা জাহানারা বেগম। সঞ্চয় যা ছিল সব দিয়ে সোনা রূপার গয়নাও পরিয়ে দিয়েছিলেন ফেলানীকে।
ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম তার বাবা হাফেজ আলীর মৃত্যুর পর তার বয়স যখন ৯/১০ বছর তখন অভাবের তাড়নায় নাগেশ্বরীর দক্ষিণ রামখানা কলোনিটারী থেকে বিধবা মা আলীজানের সঙ্গে তিনি এবং তার ছোটভাই আব্দুল খলিল ভারতের জলপাইগুড়িতে কাজের খোঁজে যান। ওই সময় সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। জলপাইগুড়িতে তারা বেশ কিছুদিন থাকে। এর মধ্যে মা আলীজান বিবির মৃত্যু হলে তাকে জলপাইগুড়িতে কবর দেয়া হয়। মায়ের মৃত্যুর পর অভাব তাদের গ্রাস করলে দুই ভাই দুই দিকে কাজের সন্ধানে বের হয়। বিভিন্ন স্থানে কাজ করতে গিয়ে ভারতের আলীপুরে ফেলানীর মা জাহানারা বেগমের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। জাহানারা একইভাবে অভাবের তাড়নায় তার দাদীর সঙ্গে আলীপুরে থাকত। নুর ইসলামের গ্রামের বাড়ির পার্শ্ববর্তী গ্রাম দক্ষিণ রামখানা বানারভিটার বাসিন্দা জাহানারা হওয়ায় প্রতিবেশী সম্পর্কে এক পর্যায়ে নুর ইসলাম ও জাহানারা বেগমের বিয়ে হয়। স্বামী-স্ত্রীর সংসারে দুই মেয়ে সন্তান জন্ম নিলেও সন্তান দুটি জন্মের কিছুদিন পর মারা যায়। দুই সন্তানের মৃত্যুর পর স্বামী-স্ত্রী দুজনে আলীপুর ছেড়ে আসামের গোয়ালপাড়া জেলার নিউ বঙ্গাইগাঁও ভালাগুড়িতে চলে যান। সেখানে জন্ম হয় ফেলানীর। দুই মেয়ের মৃত্যুর মতো ফেলানীরও মৃত্যু হতে পারে এই আশঙ্কায় তার নাম রাখা হয় ফেলানী। পরে ফেলানীসহ আরও ৫ সন্তানের জন্ম হয়। এরা হলো মালেকা খাতুন, জাহান উদ্দিন, আরফান আলী, আক্কাস আলী ও কাজলী খাতুন। নিউ বঙ্গাইগাঁও ভালাগুড়িতে একটি মুদির দোকান দিয়ে তাদের ৩ মেয়ে, ৩ ছেলে ও স্বামী-স্ত্রী মিলে পরিবারের ৮ সদস্যের সুখের সংসার চলছিল। অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা স্বচ্ছল হলে দেশে ফিরে আসবে এই আশা ছিল তাদের। নুর ইসলাম দেশে আসবে বলে বাংলাদেশের ভোটার হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করে সে। ভোটের সময় এলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ভোট প্রয়োগ করতেন তিনি।
এর মধ্যে মেয়ে ফেলানী বড় হয়ে উঠলে তাকে বাংলাদেশে বিয়ে দেবে এই পরিকল্পনা নেয় তারা। শাশুড়ি হাজেরা বিবির সম্মতিক্রমে ছোটবেলায় কথা দেয়া স্ত্রী জাহানারা বেগমের আপন বড় বোন লালমনিরহাট জেলার কুলাঘাট ইউনিয়নের চরকুলাঘাট গ্রামের ইদ্রিস আলী ও তার স্ত্রী আনজিনা বেগমের বড় ছেলে আমজাদ হোসেনের (২৫) সঙ্গে বিয়ের ব্যাপার চূড়ান্ত করা হয়। ২০১০ সালের বাংলা ফালগুন মাসে নুর ইসলাম আসাম থেকে এসে আমজাদ হোসেনের মায়ের সঙ্গে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে বিয়ের দিন ধার্য করে।
ফেলানীর বয়স যখন ৫ বছর তখন তার মা জাহানারা বেগম ও নানী হাজেরা বিবির সঙ্গে ফেলানী বেড়াতে আসে। তখন নানী হাজেরা ফেলানীর সঙ্গে আমজাদের বিয়ে দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করলে ফেলানীর বড় খালা আঞ্জিনা বেগম ও খালু ইদ্রিস আলী সম্মতি দেন। এরই আলোকে ৯ জানুয়ারি ২০১১ আমজাদ ও ফেলানীর বিয়ের আয়োজন করা হয়। আমজাদ হোসেনেরও বিয়ের প্রস্তুতি ছিল ব্যাপক।
বিয়ে বলে গার্মেন্ট খাটানো টাকায় সে বাড়ির ভাঙা ঘর থেকে ৪৫ হাত বিশিষ্ট ঘর নির্মাণ করে। ফেলানীকে ছোটবেলায় একবার দেখা হলেও তাকে নিয়ে ঘর করার স্বপ্ন লালন করেছি দীর্ঘদিন ধরে। বিয়ে করব, সুখের ঘর করব মনের ভেতরের এই স্বপ্নগুলো ধুলিসাৎ করলো বিএসএফ।
৯ জানুয়ারি ২০১১ বিয়ের দিন ধার্য অনুযায়ী মেয়ে ফেলানীকে নিয়ে ৬ জানুয়ারি সকাল ১১টায় নুর ইসলাম আসাম থেকে রওনা দেন বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে।
ফেলানীর মা জাহানারা বেগম মেয়েকে নিজ হাতে সাজিয়ে দেন। পরিয়ে দেন হাত, গলা, কান, নাক ও পায়ে স্বর্ণ এবং রূপার অলঙ্কার। হবু জামাই আমজাদ হোসেনের জন্য দুটি আংটি, একটি চেইনসহ মেয়ের হাত খরচের নগদ ১ হাজার ৯০০ ভারতীয় রুপি সঙ্গে দেন। ফেলানীও তার হবু জীবনসঙ্গীর জন্য একটি রুমাল, কিছু গিফট সামগ্রী নিয়ে বাবার সঙ্গে আসে।
দীর্ঘ ৮ ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে তারা রাত ৮টার দিকে আসাম থেকে চৌধুরীহাট বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলে ভারতীয় চৌধুরীহাট খেতাবের কুটি সীমান্তবর্তী গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে দালাল মোশাররফ হোসেন (৩৮) ও দালাল বর্জুত আলীসহ (৩০) ৩-৪ জন দালাল তাদের পিছু নেয়। দালালরা তাদের কাঁটাতারের বেড়া পার করে দেয়ার জন্য ৩ হাজার টাকা চুক্তি করে। দালাল মোশারফকে চুক্তির টাকা দেয়ার সময় ফেলানীর বাবা দালালের কাছে প্রতিশ্রুতি নেয় তার মেয়ের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। তার কথামতো দালাল মোশারফ ক্ষতি না হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে আশ্বস্ত হন ফেলানীর বাবা। পরে রাত ৯টার দিকে দালাল মোশারফ হোসেন ফেলানী ও বাবাকে তার বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে কাঁটাতারের বেড়া পার করে দেয়ার অজুহাতে দালাল মোশাররফ ফেলানী ও তার বাবাকে আরও ৩-৪টি বাড়িতে আনা-নেয়া করে। রাত ৯টা থেকে গভীর রাত ৩-৪টা পর্যন্ত একবাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে টানাহেঁচড়া করায় ফেলানী একটু ঘুমাতে চেষ্টা করেও তা পারেনি। নির্ঘুম রাত কাটানো ও টানাহেঁচড়ায় ক্লান্ত ফেলানী ও তার বাবাকে ৭ জানুয়ারি ভোররাতে ফজরের আজানের সময় ফুলবাড়ীর অনন্তপুর হাজীটারী সীমান্তের আন্তর্জাতিক পিলার ৯৪৭/৩ এসের পাশে ভারতের অভ্যন্তরে চৌধুরী হাট খেতাবের কুটি এলাকায় নিয়ে আসে দালালরা। ওই এলাকায় কাঁটাতারের বেড়ার ৩ স্তরের বেড়া পার হতে বাঁশের তৈরি তিনটি মই কাঁটাতারের বেড়ায় লাগানো হয়। সেই মই বেয়ে প্রথমে নূর ইসলাম, পরে মেয়ে ফেলানী পার হওয়ার সময় চৌধুরীহাট ক্যাম্পের বিএসএফ তাদের পিছু নেয়।
মই বেয়ে পার হওয়ার সময় ২-৩ জন বিএসএফকে তিনি মইয়ের উপরে উঠতে দেখেন। একসময় একটি গুলীর শব্দ হলে নুর ইসলাম ভয়ে পড়ে যান কাঁটাতারের বাইরে। তখন মেয়ে ফেলানী ছিল কাঁটাতারের বেড়ার মাঝখানে মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে। কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে ভারত ভূখন্ডে পড়ে যাওয়া নুর ইসলাম তড়িঘড়ি করে উঠে ফেলানীকে তাড়াতাড়ি কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে আসার জন্য বলেন। কিন্তু কাঁটাতারের মাঝখানে মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ফেলানীকে গুলী করলে সে কাঁটাতারের বেড়ার মাঝখানে পড়ে থাকতো কিন্তু কীভাবে কাঁটাতারের বেড়ার শেষপ্রান্তে ফেলানীর লাশ ঝুলে থাকলো- কীভাবে ফেলানী মারা গেল তা বাবা বুঝতে পারেননি।
নুর ইসলাম একটি গুলীর শব্দ শুনলেও তিনি আরও একটি কম আওয়াজের গুলী হয়েছে বলে পরে মানুষের কাছে শুনেছেন। এতে ধারণা হয় ফেলানীর বাবাকে ভয় দেখানোর জন্য একটি ফাঁকা গুলী ছোড়া হয়েছিল।
ফেলানীকে যেভাবে কাটাতারের শেষপ্রান্তে আটক রাখা হয়েছে তা পরিকল্পিত। ফেলানীকে নির্যাতন করে হত্যার পর কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এমন অভিযোগও উড়িয়ে দেয়া যায় না।
৭ জানুয়ারি ভোর থেকে সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে ছিল ফেলানীর লাশ। ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম মেয়ের হত্যার কথা শুনে সংজ্ঞাহীন হন। সাড়ে ১০টার দিকে ফেলানীর মৃত্যুর খবর পায় তার পরিবার। ওইদিন কুড়িগ্রাম বিজিবি ২৭ ব্যাটেলিয়নের কাশিপুর কোম্পানির পক্ষ থেকে লাশ ফেরত চেয়ে বিএসএফকে চিঠি দেয়া হলে ফেলানীর লাশ পোস্টমর্টেম শেষে পরের দিন ৮ জানুয়ারি বেলা ১১টায় ওই সীমান্তে বিজিবি কাশিপুর কোম্পানি ও বিএসএফ চৌধুরীহাট কোম্পানির পর্যায়ে পতাকা বৈঠকে বিজিবিকে লাশ ফেরত দেয় বিএসএফ। পরে বাংলাদেশে ফেলানীর পোস্টমর্টেম শেষে ৯ জানুয়ারি রাতে তার পরিবারের কাছে ফুলবাড়ী থানার পুলিশ লাশ হস্তান্তর করলে ওই রাতেই কলোনিটারী গ্রামে ফেলানীকে দাফন করা হয়।
ফেলানী হত্যাকান্ডের পর ভারতের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সীমান্তে বেসামরিক বাংলাদেশী নাগরিক হত্যাকান্ড বন্ধ হয়নি। নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হচ্ছেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলীতে, নির্যাতনে আহত হচ্ছেন, অপহৃত হচ্ছেন। এই ধারাবাহিক নির্বিচার হত্যাকান্ড দায়িত্বজ্ঞানহীন, বেপরোয়া এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। অথচ আমাদের তথাকথিত ভারতবান্ধব সরকার ফেলানী হত্যাকান্ডের পর ঘটে যাওয়া একটি হত্যাকান্ডেরও কোনো প্রতিবাদ জানিয়েছেন বলে জানা যায়নি। মৃদুস্বরেও বলেনি যে তোমরাতো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে আর কোনো হত্যাকান্ড ঘটাবে না সীমান্তে। তোমাদের কথা অনুযায়ী তোমরা এই নির্বিচার হত্যাকান্ড বন্ধ কর, নইলে আমরা এর পাল্টা যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব।
একতরফা নিঃশর্ত বন্ধুত্বের নামে এমন এক পররাষ্ট্রনীতির চর্চা চলছে যে, আমাদের নাগরিকদের নিয়মিত বিনা বিচারে পাখির মতো গুলী করে মারার পরেও টু শব্দটি উচ্চারণ করছে না এই সরকার। একি প্রকৃত অর্থে বন্ধুত্বের পররাষ্ট্রনীতি? নাকি নতজানু পদলেহী মানসিকতার পরিচায়ক? বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রনীতি উভয়ই এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমত, নাগরিকদের বিপন্ন জীবন রক্ষা করতে, দ্বিতীয়ত, জীবনহানির পর তার প্রতিকার করতে বা সুবিচার আদায় করতে এবং তৃতীয়ত, এমনতর নির্মম ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে।
ফেলানীর হত্যাকান্ড আজ আমাদের সামনে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছে আমাদের স্বরাষ্ট্র এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতি ও কর্মকান্ডের কার্যকারিতা নিয়ে। এ প্রশ্নটি আজ গভীরভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে। ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ ছুঁয়ে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে আন্তরিকভাবে ভাবতে হবে কেমন করে এই মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ চিরতরে বন্ধ করা যায়। যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করে না অথচ প্রতিমাসে সীমান্তে নিরীহ-নিরস্ত্র নাগরিক হত্যাকান্ড চলছে এমনটি সভ্য দুনিয়ার মানচিত্রে নজিরবিহীন।
৯ ফেব্রুয়ারি ২০১১ ফেলানী হত্যার প্রতিবাদ ও আন্তর্জাতিক আদালতে এর বিচার দাবি করে কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরীর রামখানা এলাকায় প্যাট্রিয়টস অব বাংলাদেশ ও স্থানীয় সচেতন জনতার ব্যানারে একটি সমাবেশ ডাকা হয়েছিল। স্থানীয় বিএনপি এ সমাবেশে সমর্থন দেয়।
ফেলানরি বাড়িতে যাওয়া দূরে থাক, কুড়িগ্রাম শহরে হোটেল থেকেই প্যাট্রিয়টস অব বাংলাদেশের লোকজনকে বের হতে দেয়নি পুলিশ। ৯ ফেব্রুয়ারী ২০১১ ভোর থেকে এ সংগঠনের নেতাদের অবস্থানরত হোটেলটি ঘিরে ফেলে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সংগঠন সভাপতি উইং কমান্ডার (অবঃ) হামিদুল্লাহ খানের নেতৃত্বে ফেলানীর বাড়ি অভিমুখে রওনা হতে চাইলে হোটেলের সামনেই পুলিশ বাধা দেয়। এমনকি তাদেরকে কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে যেতে দেয়া হয়নি। পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা এলাকায় মিছিল করে সংগঠনটির সমাবেশ প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। সংগঠন নেতারা তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের এই ফ্যাসিবাদী অন্যায় আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানান।
গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার পথকে সংকুচিত ও বাধাগ্রস্ত করতে সরকার বিরোধী কোনো সমাবেশ ডাকা হলেই সরকার সমর্থকরা তা পন্ড করার উদ্দেশ্যে একই স্থানে পাল্টা সমাবেশ আহবান করেছে এবং প্রশাসনও সংঘর্ষ এড়াতে সমাবেশের জায়গায় ফৌজদারী কার্যবিধির ১৪৪ ধারা জারি করেছে। প্রত্যেক নাগরিকের সভা-সমাবেশ করার অধিকার রয়েছে, যা সংবিধানের ৩৮ ও ৩৯ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে।
৮ ফেব্রুয়ারী ২০১১ রাত থেকেই স্থানীয় প্রশাসন মাইকিং করে ফেলানীর গ্রামে ১৪৪ ধারা জারি করে। কুড়িগ্রাম, নাগেশ্বরী ও ফেলানীদের গ্রামে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ফেলানীদের বাড়ি দক্ষিণ রামখানার রানারভিটাপাড়ায় পুলিশি পাহারা বসানো হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা জারির ফলে কুড়িগ্রাম শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে এলাকায় এদিন সকাল থেকেই থমথমে অবস্থা বিরাজ করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দেয়। তারা সরকারের এই ঘৃণ্য আচরণের তীব্র নিন্দা জানায়।
শহরের হোটেল অর্ণব প্যালেসে অবস্থানকারী হোটেল থেকে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নাগেশ্বরী যাওয়ার চেষ্টা করলে কুড়িগ্রাম সদর থানার ওসি তাহারুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। হোটেলের সামনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বাকবিতন্ডা হয়। প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টার পরও নাগেশ্বরী যেতে না পারায় আবার তারা হোটেলে ফিরে আসেন এবং সেখানে বেলা পৌনে ১২টার দিকে প্রেস ব্রিফিং করেন। এতে ছিলেন প্যাট্রিয়টস অব বাংলাদেশের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান বীর প্রতীক, সাবেক খাদ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু, প্যাট্রিয়টস মহাসচিব কবি আব্দুল হাই শিকদার, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম ফোরাম সভাপতি ও বিএনপি নেত্রী শামা ওবায়েদ, কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপি সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা, জেলা বিএনপি নেতা আলহাজ্ব আব্দুল আজিজ, সোহেল হাসনাইন কায়কোবাদ, অধ্যাপক হাসিবুর রহমান সাহিব ও পৌর মেয়র নুরুল ইসলাম নুরু।
প্রেস ব্রিফিংয়ে উইং কমান্ডার (অবঃ) হামিদুল্লাহ খান বীর প্রতীক বলেন, এ সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে সীমান্ত এলাকায় হত্যাকা-ের কোনো প্রতিবাদ হচ্ছে না। ফেলানী হত্যাকান্ডোর এক মাস পর তার বাড়িতে এলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। আমরা ১ ফেব্রুয়ারি যখন ফেলানীর বাড়িতে আসার জন্য কর্মসূচি ঘোষণা করি, তখন তড়িঘড়ি করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফেলানীদের বাড়িতে আসেন। এখন সেখানে স্থানীয় কিংবা জাতীয় নেতাদের যেতে দেয়া হচ্ছে না। এদিকে ফেলানীর বাবাকেও সরিয়ে রাখা হয়েছে। তাকে জনসমক্ষে আসতে দেয়া হচ্ছে না।
প্রেস ব্রিফিংয়ে কবি আব্দুল হাই শিকদার বলেন, আমরা বিএসএফের গুলীতে নির্মমভাবে হত্যাকা-ের শিকার ফেলানীর কবর জিয়ারত, সহমর্মিতা ও আর্থিক সহায়তা দেয়ার জন্য ওই এলাকায় যাওয়ার মুহূর্তে পুলিশি বাধার মুখে পড়েছি। সেখানে কে বা কারা সমাবেশ ডেকেছে অজুহাতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। আমরা বলেছি আমরা আইন অমান্য করব না। আমরা যে এলাকা ১৪৪ ধারার আওতামুক্ত, সে এলাকা পর্যন্ত যেতে চাই। কিন্তু তা না করে আমাদের হোটেল থেকেই বের হতে দেয়া হয়নি। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। পুলিশ আমাদের বলছে আমরা ঢাকা ছাড়া কোথাও যেতে পারব না।
তিনি বলেন, এ সরকারের আমলে সীমান্তে হত্যাকা- ঘটলেও এর প্রতিবাদ করা যাচ্ছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেদিন কুড়িগ্রাম এসেছেন সেদিন থেকে ফেলানীর বাবাকে অজ্ঞাত স্থানে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফেলানীর বাবা কোনো সন্ত্রাসী, আসামী কিংবা হত্যাকারী নন। তিনি মেয়ে হারানো একজন বাবা। আমরা মনে করি, সরকারের কোনো এজেন্সি এ কাজ করেছে।
সীমান্ত অতিক্রম করছে বলে কাউকে মেরে ফেলার বিধান পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। সীমান্ত অতিক্রমের অপরাধে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নিজ নিজ দেশের আইনের হাতে ন্যস্ত করাই হচ্ছে বিধান। আইন অনুযায়ী আদালত অপরাধ প্রমাণসাপেক্ষে দ- দেবেন। দেখামাত্রই গুলী করে মেরে ফেলা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। ভারতীয় আইনে অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার অপরাধে শাস্তি যেখানে মাত্র ৩ মাস কারাদ- সেখানে নিষ্পাপ একটি শিশুকে (আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে হলে শিশুর সংজ্ঞায় পড়ে) হত্যায় বিচার চাইতে পারে বাংলাদেশ।
কেউ বিনা ভিসায় অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। দন্ডবিধি অনুযায়ী পাসপোর্ট আইন ও ইমিগ্রেশন আইনে অবৈধ সীমান্ত অতিক্রমকারীর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার কথা। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতের আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি হচ্ছে ৩ মাসের কারাদন্ড। গুলী না করে কাউকে ধরে নিয়ে গেলে ইমিগ্রেশন আইন বা পাসপোর্ট আইন ছাড়াও অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে মামলা দেয় ভারতীয় বাহিনী। এতে সহজে কেউ আর বের হয়ে আসতে পারে না। আইন অনুযায়ী বিচারের পর কারাভোগ করা শেষ হলে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষীদের কাছে হস্তান্তর করবে। এ আইনটি ভারতীয় বাহিনী মানছে না। তারা সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে দেখামাত্রই গুলী করে মানুষ মারছে। অপরদিকে ভারতীয় কোনো নাগরিক সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধভাবে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করলেও পাসপোর্ট আইন বা ইমিগ্রেশন আইন অনুযায়ী বিচার হয়। অন্য কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত হিসেবে ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সেই অপরাধের অভিযোগ আনা হয় সংশ্লিষ্ট অনুপ্রবেশকারীর বিরুদ্ধে।
ফেলানীর হত্যাকা- ও বিচারের আসামী খালাসের ঘটনা আজ আমাদের সামনে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছে আমাদের স্বরাষ্ট্র এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতি ও কর্মকান্ডের কার্যকারিতা নিয়ে। এ প্রশ্নটি আজ গভীরভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে।
ফেলানীর মর্মান্তিক হত্যাকা-ের ঘটনা পর্যালোচনা করে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে আন্তরিকভাবে ভাবতে হবে কেমন করে এই মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞগুলোকে চিরতরে বন্ধ করা যায়। যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করে না অথচ প্রতিমাসে সীমান্তে নিরীহ-নিরস্ত্র নাগরিক হত্যাকা- চলছে এমনটি সভ্য দুনিয়ার মানচিত্রে নজিরবিহীন।
শান্তিকালীন মিশনে বেআইনি কার্যক্রম প্রতিরোধ করার কাজে নিয়োজিত বিএসএফ এমন ভাব করছে যেন তারা একটি যুদ্ধক্ষেত্রে রয়েছে এবং নিরীহ স্থানীয় জনসাধারণকে অত্যাচার ও হত্যা করে চলেছে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, চীন, মিয়ানমার, নেপাল এবং ভুটানের স্থল সীমান্ত এবং আরও একটি দ্বীপ দেশ শ্রীলঙ্কার সমুদ্রসীমা রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্ণিত  দেশগুলোর মধ্যে অত্যাচার এবং হত্যাকা-ের ধারাবাহিকতা কেবল বাংলাদেশ সীমান্তেই ঘটিয়ে থাকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। অথচ একই সীমান্তে বাংলাদেশী সীমান্ত রক্ষীর গুলীতে ভারতীয় কোনো বেসামরিক নাগরিক হত্যাকা-ের ঘটনা পুরনো পত্রিকায় কিংবা ওয়েবসাইটে খুঁজে পায়নি। আর পাকিস্তান, চীন, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান কিংবা শ্রীলংকার সঙ্গে স্থলে কিংবা সমুদ্র সীমা বরাবর ওইসব দেশের কোনো বেসামরিক নাগরিক ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীর গুলীতে নিহত হওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। অর্থাৎ বাংলাদেশ সীমান্তে নিরীহ নিরস্ত্র বাংলাদেশী বেসামরিক নাগরিকদের অব্যাহত হত্যাকা-ের ঘটনা নজিরবিহীন অনাচার এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ভারতের অতি নিকটবর্তী সাতটি সীমান্তবর্তী দেশের মধ্যে শুধু বাংলাদেশ সীমান্তে এই বেপরোয়া হত্যাযজ্ঞ চলছে বছরের পর বছর। অন্য ছয়টি দেশের সঙ্গে সীমান্ত বরাবর এমনটি কখনোই ঘটে না। এর কারণ কী?
বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ খুনি বিএসএফ সদস্যদের বিচার দাবি করেছে। ক্ষতিপূরণ চাইতে বলেছে বাংলাদেশ সরকারকে। এমনও কথা উঠেছে যে, সীমান্তে পাকিস্তান কিংবা চীনা কোনো নাগরিককে এভাবে হত্যা করে কী ভারতের পক্ষে এভাবে নির্ঝঞ্ঝাট বসে থাকা সম্ভব হতো?
ভারতীয় মানবাধিকার কর্মীরা সেখানকার আদালতে এ নিয়ে মামলা করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। বাংলাদেশের হাইকোট বহু বিষয়ে জনস্বার্থ মামলায় হস্তক্ষেপ করলেও ফেলানী হত্যাকা- নিয়ে করা রিট হাইকোর্টে টেকেনি।
ফেলানীর লাশ ঝুলে থাকার ১০ দিন পরও এ সরকার কোনো প্রতিবাদ জানায়নি। এরপরও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অটুট থাকবে। তাই তারা প্রতিবাদ জানায়নি। যে সরকার নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করতে পারে না, তাদের ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই।
হতে পারে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে ছোট দেশ ভৌগোলিক আয়তনের দিক থেকে, দুর্বল সামরিক শক্তিমত্তার দিক থেকে, অর্থনৈতিকভাবে তুলনামূলক আকারেও পেছনে, বিশ্বব্যাপী পরিচিতি ও প্রভাবের দিক থেকেও পিছিয়ে। কিন্তু এ কথাটি তো সত্য যে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। নিজস্ব সামর্থ্য ও স্বকীয়তা নিয়ে বাংলাদেশ বেড়ে উঠেছে ধীরে ধীরে নিজের তুলনামূলক সুবিধাগুলোকে যতটা সম্ভব কাজে লাগিয়ে। বাংলাদেশী জনগণ শত সীমাবদ্ধতা আর প্রতিকূলতার মাঝেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads