জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নিয়ে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে নির্যাতনের সুযোগ সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যাতে না পায়, সে জন্যই হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র রুবেলকে ৫৪ ধারায় আটক করে ডিবি পুলিশ রিমান্ডে নেয়। সেখানে ভয়াবহ নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর সারাদেশে পুলিশী রিমান্ড নিয়ে সোচ্চার হয় বিভিন্ন সংগঠন এবং মানবাধিকার কর্মীরা। রুবেলের মৃত্যুর ঘটনায় বেসরকারি সংস্থা ‘ব্লাস্ট’ হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিটও করে। হাইকোর্ট বিভাগ সরকারকে কারণ দর্শানোর রুল জারি করেন। রুলের জবাবের পর শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট বিভাগ।
হাইকোর্ট বেঞ্চ ১৬৭ ধারা সংশোধন করতে সরকারের প্রতি নির্দেশনা জারি করেন। একই সঙ্গে ওই ধারাটি সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত রিমান্ডে নিতে হলে কী কী পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে এবং রিমান্ড মঞ্জুরের পর কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট একটি গাইডলাইনও দেন আদালত। এ রায়টি আপিল বিভাগে এখনও বহাল আছে। কিন্তু এসব নির্দেশনার একটিও পালন করা হয়নি।
রায়ে বলা হয়, কোনো ব্যক্তিকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হলে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতারের কারণ লিপিবদ্ধ করতে হবে। অবিলম্বে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির আত্মীয় বা কাছের কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের বিষয়টি অবহিত করতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আইনজীবী বা পরিচিত কারও উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির গায়ে গ্রেফতারের আগে থেকে আঘাতের কোনো চিহ্ন থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে ডাক্তার দেখাতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ডাক্তার দেখাতে হবে।
রায়ে আরও বলা হয়, কোনো গোপন জায়গায় জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে না। এ রায় বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও সরকারকে বলেছিলেন হাইকোর্ট বিভাগ; কিন্তু এসব নির্দেশনা মানা হচ্ছে না।
রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হাইকোর্টের নির্দেশনা মানতে অবশ্যই বাধ্য। কিন্তু প্রায় ১০ বছর আগে হাইকোর্ট নির্দেশনাগুলো জারি করলেও এ পর্যন্ত এর কোনটিই অনুসরণ করা হয়নি।
একজন আসামীর ব্যাপারে প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হলেই কেবল পুলিশ তাকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন জানাতে পারে। এছাড়া অন্য কোনো অবস্থায় রিমান্ডে নেয়া সংবিধানে সংরক্ষিত মানবাধিকারের লঙ্ঘন। একই সঙ্গে জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর গৃহীত সনদেরও পরিপন্থী। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই কনভেনশন এগেইনস্ট টর্চার সনদে স্বাক্ষর করেছে এবং অভ্যন্তরীণ আইনও রেটিফাই করেছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বিচার বিভাগের উদ্যোগী ভূমিকার প্রত্যাশা মানুষের রয়েছে। কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড মঞ্জুর করা হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ছাড়া আসামিকে অন্য কারো হাতে হস্তান্তরের কোনো বিধান নেই।
সংবাদপত্রে তথাকথিত টিএফআই সেল বা জেআইসি নামক যেসব জায়গায় নিয়ে যাওয়ার খবর বের হয়, তার আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। রিমান্ডে নিয়ে টি.এফ.আই. সেলে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে চলা জরুরি। রিমান্ড ও টি.এফ.আই. সেলে জিজ্ঞাসাবাদের নামে যে কোনো নির্যাতনই প্রচলিত আইন ও মানবাধিকারের পরিপন্থী।
মহাজোট সরকার গঠনের পর থেকে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে শুরু হয় আক্রমণ। মানবাধিকার সংস্থাগুলো তাদের বার্ষিক রিপোর্টেও এসব তথ্য প্রকাশ করেছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ দমন এবং অপরাধীকে গ্রেফতার করে তদন্তের পর বিচারের জন্য আদালতে আসামীকে উপস্থিত করার দায়িত্ব পুলিশের। অপরাধ দমন, অপরাধীকে গ্রেফতার এবং তদন্তের জন্য পুলিশকে ফৌজদারি আইন বিধিতে অনেক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ফৌজদারি আইনে কোন কোন ক্ষেত্রে একটি ক্রিয়া শনাক্ত করার মতো অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে কিনা তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এসব আইন ও কার্যপ্রণালী বিধির ভিত্তিতে পুলিশ বিশাল ক্ষমতার অধিকারী। যেমন ফৌজদারি কার্যপ্রণালীর বহুল আলোচিত ৫৪ ধারার অধীনে পুলিশ যদি মনে করে কোনো ব্যক্তি অপরাধ সংঘটিত করতে পারে, তাহলে সেই অনুমান বা সন্দেহের ভিত্তিতেই তাকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠাতে পারে। এর ফলে ইচ্ছা অনুযায়ী নিরপরাধ ব্যক্তিকেও সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গ্রেফতার করার ক্ষমতা পুলিশের রয়েছে এবং যদি শেষ পর্যন্ত সন্দেহভাজন ব্যক্তি নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্তি পায়, তাহলে তার পক্ষে পুলিশের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার উপায় নেই।
মেট্রোপলিটন পুলিশ আইনেও এই ধরনের গ্রেফতারের বিধান রাখা হয়েছে। আইনের এই বিধান যে প্রায়ই অপব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে, তা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়াও বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এই বিধান ব্যবহার করে নিরপরাধ ব্যক্তিদের মৌলিক অধিকার হরণ করা যায় এবং হয়ে থাকে।
বর্তমান সরকার বিভিন্ন অজুহাতে সাবেক মন্ত্রী, এমপি, সচিব, স্বনামধন্য রাজনীতিক, সাবেক তিন পুলিশ প্রধান, পুলিশ ও সিআইডি’র সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও প্রথম শ্রেণীর বহু নাগরিকসহ শতাধিক রাজনৈতিক ও খ্যাতনামা ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। রিমান্ডের হাত থেকে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এনএসআইয়ের সাবেক দুই মহা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) এম আব্দুর রহিম চৌধুরী ও মেজর জেনারেল (অবঃ) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীসহ সেনা এবং সরকারের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বাদ যাননি।
রিমান্ডের নামে তাদের টিএফআই সেলে নিয়ে নির্যাতনেরও অভিযোগ রয়েছে। কারাবন্দি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর রিমান্ডের নির্যাতনে বর্তমানে গুরুতর অসুস্থ। জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে গ্রেফতার হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানকে এযাবৎকালে সবচেয়ে বেশি রিমান্ডে এনে রেকর্ড সৃষ্টি করা হয়েছে। তাকে প্রায় ২০০ দিন রিমান্ডে আনা হয়েছে। বছর খানিক আগে তিনি ২১ আগস্ট মামলায় আদালতে দেয়া ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রিমান্ডের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তিনি পুলিশের দেয়া বক্তব্য আদালতে পাঠ করে শুনিয়েছেন।
সম্প্রতি অতি উৎসাহী আইন প্রয়োগকারী সংস্থা রিমান্ডের নামে লোমহর্ষক নির্যাতন চালাচ্ছে। দেশজুড়ে হামলা-মামলা নির্যাতন, ধর্ষণ, ক্রসফায়ার রেকর্ড পরিমাণ ঘটেছে ঠিকই কিšুÍ নির্যাতিত অসহায় মানুষ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা চেয়েও প্রতিকার পাচ্ছে না। পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা চলছে ক্ষমতাসীনদের ইশারায়। বিভিন্ন এলাকায় তারাই নির্ধারণ করে দিয়েছে কার নামে মামলা হবে, কাকে গ্রেফতার করা হবে, রিমান্ডে নেয়া হবে।
সংবাদপত্রে প্রকাশ, আইনের কোনো তোয়াক্কা না করে রিমান্ডের নামে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নেয়া মানেই ওই ব্যক্তির ওপর অবধারিতভাবে বর্বর নির্যাতন চালানো। অথচ যাদের রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে তারা সবাই অপরাধী নন। সরকার রিমান্ডকে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে।
সিআইডিসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে রিমান্ডে নিয়ে আসামীদের বর্বর নির্যাতন চালানোর গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। রিমান্ড ফেরত ব্যক্তিরা নির্যাতনের যে বর্ণনা দিয়েছে, তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। আদালতে রিমান্ড ফেরত ব্যক্তিরা জানান, স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য সিআইডি কর্মকর্তারা নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছে।
পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় জড়িত কয়েকজন রিমান্ডের ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, রিমান্ডে নিয়ে তাদের স্পর্শকাতর স্থানে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়, বেধড়ক পিটিয়ে হাত পায়ের হাড় ভেঙে দেয়া, গিরায় গিরায় হাতুড়ি দিয়ে পেটানো, অসুস্থ অবস্থায় রিমান্ডে নিয়ে আগের জখমে আঘাত করা, মোটা সুইয়ের সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে শরীর থেকে রক্ত বের করা, চেয়ারে বসিয়ে চোখ বেঁধে চরকির মতো ঘোরানো, পানি ও খাবার না দেয়া, বৈদ্যুতিক শক দেয়ার মতো অমানুষিক ও বর্বর নির্যাতন চালানো হয়েছে। নির্যাতনের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, রিমান্ডে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। বিশেষ করে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের পর কতজন জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে তা সঠিকভাবে বলা হচ্ছে না।
ঠুনকো অভিযোগে বিরোধী মতের লোকজন গ্রেফতার হলেও কাউকে কাউকে দফায় দফায় রিমান্ডে এনে নির্যাতন চালানো হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করে বিরোধী মতের নেতাদের আটক করে বিভিন্ন মামলায় তাদের ফাঁসানো হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ মামলা, পিলখানা ট্র্যাজেডি, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, জঙ্গি মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। এছাড়াও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অজুহাতে এখন গ্রেফতার ও রিমান্ডে আনা হচ্ছে অহরহই।
সরকারি কর্মকা-ের যে-ই বিরোধিতা করছে তাকেই আটক করে রিমান্ডে এনে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে। হরতালে বিরোধী পক্ষের ওপর পুলিশ ও সরকারদলীয় ক্যাডাররা হামলার ঘটনায়ও বিরোধী মতের ব্যক্তিদের আটক করে রিমান্ডে আনা হচ্ছে। কথায় কথায় রিমান্ডে আনার ঘটনায় জনমনে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। এরই মধ্যে আদালতে বিচারকের সামনে রিমান্ডে লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন অনেকে। এরপরও আদালত থেকে রিমান্ড মঞ্জুর করে পুলিশ-গোয়েন্দাদের কাছে পাঠানো হচ্ছে।
১০ সেপ্টেম্বর ২০০৯ পিলখানা সদর দফতর থেকে ১৬ জওয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ রিমান্ডে নেয়া হয়। এদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি দুই জওয়ানের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাদের বৈদ্যুতিক শক দেয়াসহ বিভিন্ন কায়দায় নির্যাতন করা হয়েছে। এ সব তথ্য প্রকাশের জন্য মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকারের’ নির্যাতন প্রতিরোধ বিষয়ক কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।
নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায়ের কৌশল মানবাধিকার এবং ফৌজদারি আইনের চরম লঙ্ঘন। সংবিধানেও একই কথা বলা হয়েছে। ২০০০ সালে লালবাগের আব্দুল হাফিজ নামে এক ব্যক্তিকে ১৭ দিন রিমান্ডে রাখা হয়েছিল। পরে জামিনে বের হয়ে রিমান্ডে নির্যাতনের অভিযোগ করে পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল কাহ্হার আখন্দের বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছিলেন ওই ব্যক্তি। মাহবুব উদ্দিন খোকন ওই মামলার আইনজীবী ছিলেন। প্রথমে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলাটি নাকচ করে দিয়েছিল। পরে জেলা জজ আদালত মামলা আমলে নিতে নির্দেশ দেন। মামলা আমলে নেয়ার পর ওই পুলিশ কর্মকর্তা আসামির সঙ্গে আপসরফা করে।
পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার ঘটনায় দ-বিধির ৩৩২, ৩৩৩ ও ৩৫৩ ধারায় মামলা করা যায়। এ মামলায় সর্বোচ্চ ৩ বছর সাজা দেয়ার বিধান রয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বর্তমানে আদালত এসব মামলায় দফায় দফায় রিমান্ড মঞ্জুর করছেন।
২৭ জুন ২০১০ হরতালে জামায়াত নেতা-কর্মীরা পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেন এবং পুলিশের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে পুলিশ সদস্যদের আহত করার অভিযোগ এনে রমনা থানায় ওইদিনই মামলা করা হয়। মামলায় এ তিন নেতার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে উল্লেখ করে রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ।
২৭ জুন হরতালে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ভাংচুর, সরকারকে অস্থিতিশীল করা এবং হত্যার উদ্দেশ্যে পুলিশকে গলা চেপে ধরার অপরাধে বিএনপি নেতা শমসের মবিন চৌধুরী, মোস্তফা আহম্মেদ, মোঃ এলাহী, মোঃ বাবুল, সুলতান আহম্মেদ, মতিউর রহমান এলাহী এবং মোঃ মুসা কলিমুল্লাহকে আসামি করে গুলশান থানায় মামলা করা হয় এবং তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে ২০১০ সালের ২৯ জুন হরতালের সময় গ্রেফতার করার পর শ্যোন অ্যারেস্ট করা হয় মগবাজারে একটি গাড়ি পোড়ানো মামলায়। একই সঙ্গে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানানো হয় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। রিমান্ড মঞ্জুর করেন ম্যাজিস্ট্রেট।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার সাজানো মিথ্যা মামলায় ২৯ জুন ২০১০ বিকেলে জামায়াতে ইসলামীর আমীর ও সাবেক মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমীর ও সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার করার পর তাদের প্রত্যেককে ১৬ দিনের জন্য রিমান্ডে নিয়ে তাদের উপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালানো হয়।
মাওলানা সাঈদী ও মুজাহিদকে ৯ দিনের রিমান্ড শেষে ১০ জুলাই ২০১০ সিএমএম আদালতে হাজির করা হয় এবং রমনা এলাকায় গাড়ি ভাংচুরের মিথ্যা মামলায় পূর্বঘোষিত ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। ১১ জুলাই ২০১০ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম সাংবাদিক সম্মেলনে অভিযোগ করেন, জামায়াতের আমীর ও সাবেক মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমীর ও সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে তাদের উপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তাদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না, নামাজও আদায় করতে দেয়া হচ্ছে না।
তিনি বলেন, মাওলানা সাঈদী এবং মুজাহিদ আদালতের অনুমতি নিয়ে কথা বলেন। মাওলানা সাঈদী বলেন, ‘‘আমরা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমাদের কোন প্রকারের চিকিৎসা করা হচ্ছে না। রিমান্ডে নিয়ে একনাগাড়ে অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।’’
মুজাহিদ বলেন, ‘‘গ্রেফতারের সময় আমার রক্তের চাপ ছিল ১২০/৮০, বর্তমানে রক্ত চাপ ১৫০/১০০। আমাদের মাথার উপর দিন রাত ৩০০ ওয়াটের বাল্ব জ্বালিয়ে রাখা হয়। ফলে ঘুমাতে পারি না। আমাদের বসে নামাজ পড়তে হয় কিন্তু সেখানে বসার কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি।’’
২০১০ সালের ১৬ নভেম্বর রাজধানীর গাবতলী মোড়ে ট্রাফিক কনস্টেবলকে মারধর করে আহত করা, পুলিশের দায়িত্ব পালনে বাধা এবং আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে চলচ্চিত্র অভিনেতা এবং ডিসিসি’র ৯ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার মনোয়ার হোসেন ডিপজলের বিরুদ্ধে দারুস সালাম থানায় মামলা করে পুলিশ। ২৮ নভেম্বর ডিপজল থানায় আত্মসমর্পণ করেন। এ মামলায় তাকে দুই দফা রিমান্ডে নেয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদে ট্রাফিক পুলিশকে মারধর এবং অস্ত্র দেখানোর বিষয়টি অস্বীকার করে ডিপজল বলেছেন, আলতাব হোসেন নামে ট্রাফিক পুলিশের ওই সদস্যের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়েছে। তিনি কাউকে মারধর করেননি বা অস্ত্র প্রদর্শন করেননি।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী থেকে গ্রেফতার হওয়ার পর পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয় গোয়েন্দা পুলিশ। তিনি আদালতে বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদের নামে দুটি গোয়েন্দা সংস্থার ৮ সদস্য তার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে। গভীর রাতে অন্য সংস্থার লোকজন এসে তার ওপর নির্যাতন করেছে। তার নাকে ঘুষি দিয়ে রক্তাক্ত করেছে। বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছে। পায়ের নিচে শক্ত লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। শরীরে ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। এছাড়াও তাকে বিভিন্ন হুমকি দিয়ে মানসিক অবস্থা দুর্বল করার চেষ্টা করেছে তারা।
১ জানুয়ারি থেকে ৩০ ডিসেম্বর ২০১০ পর্যন্ত শুধু ঢাকার সিএমএম কোর্টে ৩৬৫ দিনে ৪ হাজার ৮২৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। গড়ে প্রতিদিন ১৩ জনকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে শুধু ঢাকা মহানগরে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রিমান্ড মঞ্জুরের ঘটনা ঘটেছে কোতোয়ালি, বংশাল, লালবাগ, চকবাজার ও কামরাঙ্গিরচর থানার অধীনে। এসব থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এক বছরে ৬৩৮ জনকে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। সবচেয়ে বেশি রিমান্ডের ঘটনা ঘটেছে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা মহানগরে ৪৩৩ জনকে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জুলাই মাস। জুলাই মাসে ৪৩০ জনকে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে ঢাকা মহানগরে। ডিসেম্বরে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে ৪১২ জনকে।
জানুয়ারিতে ৪০৫, ফেব্রুয়ারিতে ৪৩৩, মার্চে ৪১২, এপ্রিলে ৩৮৭, মে মাসে ৩৯১, জুনে ৪১০, জুলাইতে ৪৩০, আগস্টে ৪০৭, সেপ্টেম্বরে ৩৬৭, অক্টোবরে ৩৭৪, নভেম্বরে ৪০১ এবং ডিসেম্বরে ৪১২ জনকে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাদের একাধিকবার রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ১ অক্টোবর ২০১১)
২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে জামায়াত-পুলিশ সংঘর্ষের ঘটনায় জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক অধ্যাপক তাসনীম আলমসহ ১৮৩ জনকে ৯টি মামলায় ১৯ দিনের রিমান্ডে এনে নজির সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যদিকে দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক প্রবীণ সাংবাদিক আবুল আসাদকেও ওই ঘটনায় একটি মামলায় ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। তিনি বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। রিমান্ডে থাকা জামায়াত নেতাদের হাতকড়া ও ডা-াবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করে নতুন অমানবিক ও অসভ্য সংস্কৃতি চালু করেছে পুলিশ।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লাকে বিভিন্ন মামলায় ১৫ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আদেশ দেন আদালত। সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে ৬ মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ৫৪ দিনের রিমান্ড চেয়েছিল পুলিশ। (সূত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম ১৪ নভেম্বর ২০১২)
২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ৭০ বছর বয়সী নেতা গুরুতর অসুস্থ মাওলানা রফিউদ্দিন আহমদ আদালতের নির্দেশে জামিন লাভ করলেও পুলিশ জেলগেট থেকে ফের গ্রেফতার করে। আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাকে সাজানো মামলায় জড়িয়ে বানানো অভিযোগে রিমান্ডেও নেয়া হয়। মাওলানা রফিউদ্দিনকে ১৯ সেপ্টেম্বরের ২০১১ ঘটনায় রমনা ও পল্টন থানায় করা দুটি মামলায় জড়ানো হয়। ১৬ অক্টোবর ৬ সপ্তাহের জন্য হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন লাভ করেন তিনিসহ আরো কয়েকজন জামায়াত নেতা। ১১ ডিসেম্বর তিনিসহ অন্য নেতারা আদালতে হাজির হন। আদালত জামিন বাতিল করে জেলে পাঠায়।
২০১৩ সালের ৩০ মে তারিখের প্রায় প্রতিটি জাতীয় পত্রিকায়ই মোটামুটি লিড নিউজ হওয়া একটি খবরের দু’টো শিরোনাম “বাবুনগরীর তড়িঘড়ি জামিন সিসিইউতে স্থানান্তর” (দৈনিক ইত্তেফাক)।
“৭ মে থেকে টানা রিমান্ডে নির্যাতনে পায়ে ক্ষত কিডনি অচল: জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী: সরকারের পীড়াপীড়িতে তড়িঘড়ি জামিন” (দৈনিক আমার দেশ)।
এ বিষয়ে পূর্বে ও বর্তমানে প্রকাশিত খবরসমূহের সারমর্ম হলো, গত ৬ মে হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে গ্রেফতার করে মতিঝিল থানায় তার বিরুদ্ধে পুলিশ হত্যা মামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করা হয়।
৭ মে মতিঝিল থানার এসআই শেখ মফিজুর রহমান এর আবেদনের প্রেক্ষিতে মহানগর হাকিম মোঃ তারেক মঈনুল ইসলাম ভূঁইয়ার আদালত তার ৯ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ রিমান্ডের মেয়াদ শেষ হলে পুলিশের পুনঃআবেদনের প্রেক্ষিতে ১৬ মে তাকে ২২ দিন রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ড আবেদনের বিপক্ষে আসামীপক্ষের আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়ার করা আবেদন খারিজ করে দেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এম মোস্তাফিজুর রহমান।
প্রথম দফা ৯ দিন এবং দ্বিতীয় দফা ২২ দিন সর্বমোট ৩১ দিনের রিমান্ডে থাকাকালীন সময়েই ২১ মে দুপুরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ফজলুল হক তাকে ১৩ দিনের রিমান্ডের মাথায় ঢাকার সিএমএম আদালতে এনে স্বীকারোক্তি রেকর্ড করার আবেদন করেন। এ সময় বাবুনগরী ছিলেন খুবই অসুস্থ। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হারুন অর রশিদ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় বাবুনগরীর জবানবন্দি রেকর্ড করে তাকে ঐদিনই জেল-হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরপর ২৫ মে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে বারডেম হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
২৯ মে তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়। এই অবস্থায় সরকারপক্ষের পীড়াপীড়িতে ২৯ মে মামলার ধার্য তারিখ না হওয়া সত্ত্বেও জামিনের আবেদন করেন বাবুনগরীর আইনজীবীরা। জামিন আবেদনের শুনানিতে সরকারপক্ষের পিপি আবদুল্লাহ আবু জামিনের বিরোধিতা করেননি বরং জামিন মঞ্জুরের পক্ষে মত দেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ১৮ দিন রিমান্ড বাকি থাকতেই ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট শাহরিয়ার মাহমুদ আদনান দশ হাজার টাকা মুচলেকায় তার জামিন মঞ্জুর করেন।
জামিনের শুনানিতে বাবুনগরীর আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া আদালতকে বলেন, বাবুনগরীকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। নির্মম নির্যাতনে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এছাড়াও হেফাজতে ইসলাম নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেছেন, জুনায়েদ বাবুনগরীকে দিনের পর দিন রিমান্ডে বর্বর কায়দায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তার জীবন সংকটাপন্ন। কোমর থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত কালচিটে দাগ আর ক্ষতবিক্ষত। নখের ভেতর আলপিন জাতীয় কিছু ঢুকিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। তার পায়ে পচন ধরেছে।
গ্রেফতারের পর তার চিকিৎসার আবেদন করা হয়েছিল কিšুÍ চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা না করে রিমান্ডে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ের নামে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। হেফাজত নেতারা অভিযোগ করেন, আজ যখন তার জীবন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে, তখন তার আইনজীবীদের ধরে এনে তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করার পরে জামিন নিতে বাধ্য করা হয়েছে। যেখানে না চাইতেই ২২ দিন রিমান্ডে নেয়া হয়, সেখানে স্বপ্রণোদিত হয়ে এই জামিনের আয়োজন সরকারের দায় এড়াতে সাহায্য করবে না।
২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল পুলিশকে হত্যার উদ্দেশে মারধর, গাড়ি ভাংচুর ও ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে পল্টন থানার একটি মামলায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাউদ্দিন আহমেদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
১ এপ্রিল রাজধানীর পল্টন থানায় দায়ের করা গাড়ি পোড়ানো ও ককটেল বিস্ফোরণের একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে দশ দিন রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন থানার উপ-পরিদর্শক শ্যামল দেবনাথ।
আসামীপক্ষে এ বক্তব্য অস্বীকার করে শুনানিতে তারা বলেন, সালাহউদ্দিন আহমেদ অপরিচিত কেউ নন। তিনি সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী এবং সরকারি কর্মকর্তা। বর্তমানে তিনি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব। মামলার এজাহারে দশ আসামীর নাম উল্লেখ রয়েছে। সালাহউদ্দিন আহমেদ যদি সেখানে থাকতেন, তাহলে তার নামও অন্তর্ভুক্ত হতো। মামলা দায়েরের আট দিন পর তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
২০১৩ সালের ৩১ মার্চ দুপুরে রাজধানীর শ্যামলী থেকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোঃ দেলাওয়ার হোসেনকে আটক করে ডিবি পুলিশ। দেশব্যাপী জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজধানীর শ্যামলী এলাকায় শিবির সভাপতির নেতৃত্বে একটি মিছিল করার চেষ্টা করে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। পুলিশ আসার আগেই নেতা-কর্মীরা সরে পড়ে। পরে ওই এলাকায় বাসা থেকে ডিবি পুলিশের একটি দল দেলাওয়ারকে আটক করে।
পরদিন তাকে দুটি মামলায় সাত দিন করে মোট ১৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। মামলা দুটির তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোঃ আফজাল হোসেন ও এসআই মাহবুবুর রহমান শিবির সভাপতি দেলাওয়ারকে ঢাকার সিএমএম আদালতে পাঠিয়ে মোহাম্মদপুর থানায় করা ককটেল বিস্ফোরণের দুটি মামলায় ১০ দিন করে মোট ২০ দিন রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করেন। আবেদনের শুনানি শেষে মহানগর হাকিম হারুন অর রশিদ এ মামলায় ৭ দিন করে দুই মামলায় সতর্কতার সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রিমান্ডে নিয়ে তাকে নির্যাতন চালানো হচ্ছে অভিযোগ করে ৭ এপ্রিল ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ আবদুল জব্বার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেন। অভিযোগে তিনি বলেন, ছাত্রশিবিরের সভাপতিকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে রিমান্ডের নামে নির্মম নির্যাতন চালানো হচ্ছে। নির্যাতনের ফলে তিনি বারবার অচেতন হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ০৮ এপ্রিল ২০১৩)
প্রথম পর্যায়ে ১৪ দিন রিমান্ড সময় শেষ হলে ১৬ এপ্রিল তাকে আদালতে হাজির করে পুলিশ যখন আরো ৫টি মামলায় ৩৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করে তখন দেলোয়ার ঠিকমতো হাঁটতে পারছিলেন না। পুলিশের সহায়তায় তাকে কাঠগড়ায় নেয়া হয়। এদিন বিভিন্ন মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মোট ১৮ দিন পুনঃরিমান্ড মঞ্জুর করে। মামলাগুলো হলো-
(১) তেজগাঁও থানার ১৯(১১)১২ মামলায় ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন তেজগাঁও থানা পুলিশের এসআই রজিবুল ইসলাম। শুনানি শেষে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ মনিরুজ্জামান ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
(২) মতিঝিল থানার ১৪(২)১৩ মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করেন মতিঝিল থানার এসআই শেখ মফিজুর রহমান। শুনানি শেষে মতিঝিল থানার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সহিদুল ইসলাম ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
(৩) রামপুরা থানার ৩১(৮)১২ মামলায় ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন ওই থানার এসআই শেখ আবু হানিফ। শুনানি শেষে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুর রহমান ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
(৪) কলাবাগান থানার ৮(১১)১২ মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন একই থানার এসআই মাসুদ শিকদার এবং হাজারীবাগ থানার ১৭(২)১৩ মামলায় ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন এসআই আকরামুল হক। শুনানি শেষে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হাসিবুল হক কলাবাগান থানার মামলায় ৫ দিন ও হাজারীবাগ থানার মামলায় ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
শুনানিকালে এডভোকেট আবদুর রাজ্জাক বলেন, রিমান্ডে শিবির সভাপতিকে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে। চোখ বেঁধে বেধড়ক পিটানো হয়েছে। ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না তিনি। ঠিক মতো খাবারও দেয়া হয়নি। দীর্ঘ ১৯ দিন এক কাপড়ে রাখা হয়েছে। এ কারণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন শিবির সভাপতি। এ জন্য রিমান্ড শুনানির জন্য সময় আবেদন করা হলেও আদালত তা নাকচ করে রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করে।
প্রথম রিমান্ডকালীন ১৪ দিন দেলোয়ারের সাথে তাঁর আত্মীয়-স্বজন কাউকে দেখা করতে দেয়া হয়নি এমনকি সে কোথায় কি অবস্থায় ছিল তাও তাঁদের জানানো হয়নি। এমনকি পরিবারের অনুরোধেও দেলাওয়ারের অবস্থান ও শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানায়নি পুলিশ। দ্বিতীয় দফা রিমান্ডের জন্য যখন তাঁকে আদালতে আনা হয় তখন তাকে গুরুতর অসুস্থ দেখা যাচ্ছিল। তিনি এমনকি হাঁটতে পর্যন্ত পারছিলেন না। পুলিশ তাকে পেছন থেকে ঠেলে এগিয়ে দিচ্ছিল। দেলাওয়ারের চোখে-মুখে ছিল তীব্র যন্ত্রণার স্পষ্ট ছাপ। তার আইনজীবীও একই কথা জানিয়েছেন। বলেছেন, নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়া দেলাওয়ার জন্ডিসেও আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্ত পুলিশ তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি। আদালতও কেবল রিমান্ডই মঞ্জুর করেছে, চিকিৎসার নির্দেশ দেয়নি।
মতিঝিল থানায় দায়ের করা ৫৩ (১)১৩ নং মামলায় ২ দিনের রিমান্ড শেষে ২৫ এপ্রিল তারিখে তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়। পরে ৪৪ (১)১৩ নং মামলায় ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে মতিঝিল থানা পুলিশ। শুনানি শেষে মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুর রহমান ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ মামলার এজাহারে তার নাম নেই। এ নিয়ে পৃথক ১০টি মামলায় তার মোট ৩৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত।
ইতোমধ্যেই রিমান্ডে পুলিশের নির্মম নির্যাতনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন দেলাওয়ার। মিরপুর থানার ১৪(৩)১৩ নং মামলায় ১ দিনের রিমান্ড শেষে ১১ মে দেলাওয়ারকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। চার দফায় ৩৬ দিনের রিমান্ডের এক পর্যায়ে ৯ মে মিরপুর থানায় এক দিনের রিমান্ডে নেয়ার পথে প্রিজন কারে তার ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালানো হয়েছে। তাকে রাস্তায়ই এএসআই দেলোয়ার কাপুরুষের মতো হাত পায়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তার সারা শরীরে নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে। থানায় নেয়ার পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এস আই মাসুদ তার হাত, পায়ের তালু, কোমর, পিঠে, মুখের ভিতর লাঠি ঢুকিয়ে ও বুকের ওপর বুটের চাপা দিয়ে দলিত মথিত করে, আঙ্গুল দিয়ে চোখ উঠিয়ে নেয়ার চেষ্টাসহ বিভিন্নভাবে বর্বর নির্যাতন করেছে। এখন তিনি হাঁটতে বা বসতে পারছেন না। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায়ই হাজারীবাগ থানায় ২ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।
শিবির সভাপতিকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের কথা পিটিশনের মাধ্যমে আদালতে জানান তার আইনজীবী এডভোকেট আবদুর রাজ্জাক। মহানগর হাকিম আতাউল হকের আদালতে এই পিটিশন দেয়া হয়। এ সময় তিনি বলেন, একজন মেধাবী ছাত্রনেতাকে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়ার জন্যই সরকার পরিকল্পিতভাবে শিবির সভাপতির ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। এ সময় জামিন আবেদন করা হলে আদালত তা নাকচ করে দেয়।
এই অবস্থাতেই পুনরায় ১৪ মে অসুস্থ শিবির সভাপতিকে সিএমএম আদালতে হাজির করে আরো ৫ মামলায় ৩৫ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। মহানগর হাকিম মোঃ আসাদুজ্জামান নুর এর আদালত ৪ মামলায় ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। মামলাগুলো হলো-
(১) পুলিশ পল্টন থানার ৪৬(১)১৩ নং মামলায় ১০ দিনের রিমান্ড আবেদনে ৩ দিন।
(২) মতিঝিল থানার ৯(১১)১২ নং মামলায় ৫ দিনের রিমান্ডে ২ দিন
(৩) ১০(১১)১২ নং মামলায় ৫ দিনের রিমান্ডে ২ দিন।
(৪) ১৬(২)১৩ নং মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডে ৩ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর হয়।
২০ মে অসুস্থ-অচেতন দেলোয়ারকে জিআরপি থানার ২(৩)১৩ ও সাভার থানার ৭(৩)১৩ নং মামলায় ১৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট তৈয়েবুল হাসানের আদালতে হাজির করে পুলিশ। ভয়ঙ্কর যেই অবস্থা দেখে ও শুনে শুধু আদালতে উপস্থিত সাধারণ মানুষই নয় আদালত এমনকি সরকারি পক্ষের আইনজীবীরাও স্তম্ভিত হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় নজিরবিহীন এই করুণ ইতিহাসের ভিকটিম, যার একমাত্র অপরাধ মনে-প্রাণে ইসলামের অনুসারী হওয়া, সেই তরতাজা যুবক দেলোয়ারের সর্বমোট ৫৩ দিন পুলিশী রিমান্ডে থাকার পর যে অবস্থায় তাঁকে আদালতে উপস্থাপন করা হয় তার বিবরণ পড়ুন এই প্রতিবেদনেÑ
শিবির সভাপতিকে রিমান্ডের আবেদন
নির্যাতনের চিহ্ন দেখে স্তম্ভিত আদালত
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত তিনি। চোখে মুখে আর সারা শরীরে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের চিহ্ন। চলৎশক্তিহীন। হাত পা ফোলা। ছোপ ছোপ রক্তজমা সারা দেহে। শরীরে এতটুকু শক্তিও নেই। উঠে দাঁড়ানো দূরের কথা। বসার মতো শক্তিও নেই তার। হাত পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। দুই চোখ মুদিত। বছর ত্রিশের টগবগে যুবক। মুখভর্তি চাপদাড়ি। হাতে পায়ে কোমরে ডা-াবেড়ি। সে ডা-াবেড়ি আবার ধরে রেখেছেন দুইজন পুলিশ। চ্যাংদোলা করে কয়েকজন পুলিশ তাকে উঠালেন ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। বসতে পারছেন না। মুখে কোনো কথাও নেই। তাকে আদালতেই পেছনে ঠেক দিয়ে ধরে রেখেছেন পুলিশ সদস্যরা। তাদের কাছে ১৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে পাঠানো আবেদন।
শুনানিতে আইনজীবীরা বললেন, আসামি একজন মানুষ। তাকে আগে বাঁচতে দিন। সরকারি দলের কয়েকজন আইনজীবীও আসামিকে দেখে যেন খানিকটা বিচলিত বোধ করলেন। অস্ফুট উচ্চারণে বললেন, হায় হায় একি! সবার স্তম্ভিত অবস্থা দেখে কাল আর নতুন করে রিমান্ডে না দিয়ে সদাশয় আদালত আপাতত চিকিৎসা দিতে বললেন। আদালতে এই নিষ্ঠুর ঘটনার অবতারণা হয়েছে গতকাল।
দেশের অন্যতম প্রধান ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের টানা ৫৩ দিনের রিমান্ড শেষ হয় গতকাল। এর পর আরো একটি নতুন মামলায় তাকে আবারো ১৭ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করে পুলিশ। এর আগে সর্বশেষ দফায় নেয়া ১৩ দিনের রিমান্ডে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া দেলোয়ারকে গতকাল পুলিশ পাঁজাকোলা করে ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করেন। তার আইনজীবী তার অসুস্থতার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিকিৎসার আবেদন করলে আদালত আগামী ২৮ মে রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করেন।
গতকাল কোর্ট পুলিশ তাকে পাঁজাকোলো করে আদালতে হাজির করে। এ সময় পায়ে ডা-াবেড়ি পরানো দেলাওয়ার ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রায় অচেতন। তার পায়ে বেন্ডেজ এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্ন ছিল লক্ষণীয়। গতকাল সাভার ও ঢাকা রেলওয়ে থানার পৃথক দুই মামলায় রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। শুনানি শেষে ম্যাজিস্ট্রেট তৈয়বুল হাসান আগামী ২৮ মে নতুন তারিখ ধার্য করেন।
শিবির সভাপতির আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক বলেন, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের আইনি বিধান না থাকলেও শিবির সভাপতিকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত অবশ করে দেয়া হয়েছে, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। তিনি খেতে পারছেন না। হাঁটা-চলা এমনকি বসতেও পারছেন না। এক দিকে প্রেসারের চাপ অন্যদিকে নির্মম নির্যাতন তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। সমস্ত শরীর অবশ হওয়ায় শিবির সভাপতিকে হুইল চেয়ারে করে আদালতে হাজির করা হয় এবং তাকে কোর্টে আনার সময় প্রিজন ভ্যানে শুইয়ে রাখা হয়। আদালতে আইনজীবীদের সামনেই শিবির সভাপতিকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে পুলিশ। কোনো সভ্য দেশে এরকম আচরণ করতে আমরা শুনিনি। (সূত্রঃ দৈনিক নয়াদিগন্ত ২১ মে ২০১৩)
রিমান্ডে নির্যাতন করা হলে মামলা দায়েরের বিধান আছে। তবে পুলিশ আরও নির্যাতন করতে পারে এই ভয়ে কেউ মামলা করতে এগিয়ে আসেন না। দন্ডবিধির ৩৩০ এবং ৩৩১ ধারা বল প্রয়োগ করে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য কাউকে আঘাত বা গুরুতর আঘাত করা হলে সেটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এ অপরাধের জন্য অপরাধীর বিরুদ্ধে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড এবং জরিমানার বিধান রয়েছে।
নির্যাতনের মাধ্যমে আদায় করা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট এবং বিচারকদের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারা অনুযায়ী আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি দেয়ার এখতিয়ার রয়েছে। তবে এই আইনটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের যে গাইডলাইন ও নির্দেশনা রয়েছে তা মানা হয় না।
পুলিশ যখন বিশেষ উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে কোনো ব্যক্তিকে মামলায় জড়ানোর জন্য গ্রেফতার করে তাদের হেফাজতে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা চালায়, সেক্ষেত্রে আদালতের, বিশেষ করে ন্যায় বিচারের স্বার্থে, মানবাধিকার ও আমাদের সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকার সুরক্ষা করার জন্য উচ্চ আদালতের অবশ্যই কার্যকর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন রয়েছে।
যখন কোনো আসামিকে রিমান্ড থেকে ফিরিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধের জন্য উপস্থিত করা হয়, তখন ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব রয়েছে উক্ত স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছায়, ভয়ভীতি-প্রলোভন সর্বোপরি পুলিশ নির্যাতনের কারণে কিনা তা যাচাই করা। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার জন্য ন্যায় বিচারের স্বার্থে তাদের যে দায়িত্ব রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে সেটা পালন করা হয় না, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশের ইচ্ছামত স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করা হয়। অথচ ওই ম্যাজিস্ট্রেটরা উপলব্ধি করছেন না ওই মিথ্যা ও সাজানো জবানবন্দির কারণে উক্ত আসামি এবং সহযোগীদের ফাঁসি হয়ে যেতে পারে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে প্রয়োজনবোধে দোষী নির্যাতনকারীর শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বর্তমানে যেভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্যাতন-নিপীড়ন করা হচ্ছে সেটার জন্য রিমান্ড চলাকালীন সংশ্লিষ্ট আসামির উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা এবং আইনজীবীর উপস্থিতি ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদ ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আইনের দৃষ্টিতে অকার্যকর হবে এরকম বিধান করা আবশ্যক।
অন্তত দশজন নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধেও এরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া গেলে নির্যাতন অনেকটা হ্রাস পাবে। বিচার বিভাগ একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। রিমান্ডের নামে নির্যাতন বন্ধের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগেরও দায়িত্ব অবশ্যই রয়েছে।
বাংলাদেশ একটি সভ্য রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রে আমরা আইনের শাসন চাই। আইনের শাসনে বিচারের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে কারো ওপর নির্যাতন চলতে পারে না। রিমান্ডে কোনো ব্যক্তির ওপর যেকোনো ধরনের নির্যাতন কারো কাম্য হতে পারে না। বিচারের রায়ের আগে কারো উপর নির্যাতন আইনের শাসনের পরিপন্থী। রিমান্ডে নির্যাতন বন্ধ হোক এটাই সবার প্রত্যাশা। সংশ্লিষ্ট মহল বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনের শাসনের আওতায় কাজ করবে এই কামনা। সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন