তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালসহ নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে কঠোর মনোভাব দেখানো হলেও ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আরো একবার নমনীয়তা দেখিয়েছেন। গত রোববার নরসিংদীতে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসমাবেশে তিনি ঘোষণা করেছেন, ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এখনও যদি নির্দলীয় সরকারের প্রস্তাব আসে তাহলে বিএনপি আলোচনায় অংশ নেবে। ৪৩ মিনিটের দীর্ঘ ভাষণে সাম্প্রতিক ইতিহাসের পর্যালোচনা করার পাশাপাশি সংসদের আসন্ন অধিবেশনেই সংবিধান সংশোধনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেছেন, না হলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতাসীনদের একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করবে ১৮ দলীয় জোট। সরকারকে সতর্ক করতে গিয়ে তিনি আরো বলেছেন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান যুক্ত করে সংবিধান সংশোধন না করা হলে লাগাতার হরতাল এবং রাজপথ-রেলপথ অবরোধসহ প্রচ- আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করা হবে। নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা থেকে সংকট কাটিয়ে ওঠার এবং সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবের পরামর্শের প্রতি উপেক্ষা দেখানো পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্যের উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, গণতন্ত্রসম্মত সে পথে না গিয়ে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী একতরফা নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি না মানলে ক্ষমতাসীনদের বিদায় তো নিতে হবেই, পালানোর পথও খুঁজতে হবে বলেও সাবধান করে দিয়েছেন বিরোধী দলের নেত্রী। ভাষণে সরকারের গণতন্ত্রবিরোধী ও ফ্যাসিস্ট বিভিন্ন কর্মকা-েরও তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি। দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার এবং গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের বিরোধিতা করে ও নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেছেন, সরকারের বিভিন্ন অপকর্ম প্রকাশ করার এবং সত্য লেখার কারণে এই নির্ভিক সম্পাদককে গ্রেফতার করা এবং নানাভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। শুধু আমার দেশ-এর প্রকাশনা নয়, সরকারবিরোধী অন্য অনেক গণমাধ্যমেরও কণ্ঠরোধ করে চলেছে সরকার। ক্ষমতাসীনদের ফ্যাসিস্ট নীতির কারণে কোনো মানবাধিকার সংস্থাও স্বাধীনভাবে তৎপরতা চালাতে পারছে না। সত্য প্রকাশের কারণে অধিকার-এর সম্পাদক আদিলুর রহমান খানকে বানোয়াট মামলায় গ্রেফতার করেছে সরকার। সরকারের ইসলাম ও মুসলমান বিরোধী নীতি ও কার্যক্রমেরও কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনি। বলেছেন, আলেমদের হত্যা করে সরকারের শেষ রক্ষা হবে না। নরসিংদীর সমাবেশে দুর্নীতি ও অপশাসনসহ অন্য কিছু বিষয়েও খোলামেলা ভাষায় দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রীর অবস্থান থেকে কথা বলেছেন খালেদা জিয়া। দ্রুত ঘনীভূত হয়ে ওঠা বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্যে এসেছে নির্বাচনকালীন সরকার। উচ্চ আদালতের দেয়া একটি বিতর্কিত রায়ের একটি মাত্র অংশের ভিত্তিতে ক্ষমতাসীনরা যেভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনেছেন বহুল আলোচিত বলে সে সম্পর্কে পুনরাবৃত্তিতে যাওয়ার পরিবর্তে এখানে অন্য দুটি বিশেষ তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। প্রথম তথ্যটি হলো, সংকট কাটিয়ে ওঠার সদিচ্ছা রয়েছে বলে খালেদা জিয়া তার দাবিতে অনেক ছাড় দিয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা হুবহু পুনর্বহাল করার পরিবর্তে তিনি বলেছেন নির্বাচনকালীন সরকারকে অবশ্যই নির্দলীয় হতে হবে এবং শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বহাল রেখে যে নামেই কোনো সরকার করা হোক না কেন সে সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। খালেদা জিয়ার এই বক্তব্য দেশী-বিদেশী সব মহলেই প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু সমস্যার সমাধানে এখনও রাজি হচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী। তিনি বরং ঘোষণা করেছেন, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নে তারা সংবিধান থেকে ‘এক চুল’ও নড়বেন না। বলাবাহুল্য, এর মধ্য দিয়ে সমঝোতামুখী সামান্য সদিচ্ছারও প্রকাশ ঘটেনি। এই কঠোর মনোভাব ও অবস্থানের কারণে সংকটও ঘনীভূত হচ্ছে। এজন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি গণচীনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের পক্ষে নেয়া সমঝোতার চেষ্টা সফল হতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের পরামর্শের প্রতিও উপেক্ষা দেখিয়ে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই কঠোর নেতিবাচক মনোভাব এবং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্যের পরিণতিতে সমঝোতার সব উদ্যোগই ব্যর্থ হয়ে গেছে। এদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি তো ঘটছেই দেশও এগিয়ে চলেছে অনিবার্য সংঘাতের দিকে। মূলত সে কারণেই বেগম খালেদা জিয়ার সর্বশেষ আহবানকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। তিনি শুধু আহবান জানাননি, একই সঙ্গে সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কেও সতর্ক করে দিয়েছেন। আমরা আশা করতে চাই, জাতিসংঘের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি সকল মহলের আহবান ও পরামর্শের প্রতি প্রধানমন্ত্রী সম্মান দেখাবেন এবং সংঘাত এড়িয়ে দেশকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটাবেন। নির্বাচনকালীন সরকারের বিধান যুক্ত করে তাকে অবশ্যই সংবিধান সংশোধন করতে হবে। গণতন্ত্রের ব্যাপারে ন্যূনতম সদিচ্ছা থাকলে ক্ষমতাসীনদের উচিত খালেদা জিয়ার দেয়া শেষ সুযোগটুকুকে কাজে লাগানো। আমরা চাই না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে পালানোর পথ খুঁজে বেড়াতে হোকÑ যে কথাটা বেগম খালেদ জিয়া নরসিংদীর সমাবেশে জানিয়ে দিয়েছেন।
প্রসঙ্গক্রমে খালেদা জিয়ার নির্বাচন কমিশন সম্পর্কিত বক্তব্যও লক্ষ্য করা দরকার। বেশ কিছুদিন আগেই কমিশনকে ‘মেরুদ-হীন’ ও ‘অথর্ব’ আখ্যায়িত করে বলেছেন, এই কমিশন সরকারের এজে-া বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। সে কারণে নরসিংদীর সমাবেশে তিনি বর্তমান কমিশনকেই বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন। আমরাও মনে করি, খালেদা জিয়া সঠিক দাবিই জানিয়েছেন। কারণ, তার আগে ও পরে কমিশন সম্পর্কে মুখ খুলেছেন এমনকি মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও। তিনি বলেছেন, নানা কর্মকা-ের মাধ্যমেও ইসি বিতর্কিত হয়ে পড়েছে এবং জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমান ইসির অধীনে তার দল নির্বাচনে অংশ নেবে না বলেও জানিয়ে রেখেছেন এরশাদ। ওদিকে বিকল্প ধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন, নির্বাচন কমিশনকে দলীয়করণ করা হয়েছে। ইসির ইদানীংকালের বিভিন্ন বক্তব্যে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আগামী নির্বাচন হবে একতরফা। এভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনের সবাই বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছেন। এমনকি বিদেশি কূটনীতিক এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও সুশীল সমাজের বক্তব্য ও কার্যক্রমের মধ্য দিয়েও একই অনাস্থার প্রকাশ ঘটে চলেছে। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের অধীনে এমনভাবে নির্বাচন চাচ্ছেন যাতে তিনি নিজে ও তার মন্ত্রীরা পরিপূর্ণ সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেন। এ উদ্দেশ্যে প্রশাসনকে ষোলো আনা দলীয়করণ করা হচ্ছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী তো বেশ কিছুদিন ধরে রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়েই সরকারি খরচে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। কিন্তু ইসিকে প্রতিবাদ জানাতে বা আইনত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। কথা শুধু এটুকুই নয়। দায়িত্ব যেখানে ছিল নির্বাচনী বিধিমালা অনুযায়ী আইন লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জাবেদ আলীরা সেখানে উল্টো ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছেন। কমিশনাররা এমনকি বিএনপির মতো প্রধান একটি দলকেও ভারতের উদাহরণ টেনে ‘জ্ঞান’ দিতে চেয়েছেন। ঠিক প্রধানমন্ত্রীর সুরে বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সংশয় নাকি অমূলক! বলা দরকার, বিএনপি মোটেও অমূলক কোনো আশংকা প্রকাশ করেনি। অসত্য বরং কমিশনাররাই বলে চলেছেন। ইচ্ছামতো আরপিও সংশোধনের মাধ্যমেও তারা বর্তমান সরকারের পক্ষেই ভূমিকা পালন করছেন। অর্থাৎ সব কর্মকা-ের মাধ্যমেই ইসি তার গ্রহণযোগ্যতা খুইয়ে ফেলেছে। এই ইসির অধীনে কোনো সষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। খালেদা জিয়াও একই কারণে বর্তমান কমিশনকে বিদায় করার দাবি জানিয়েছেন। সরকারের উচিত তার দাবিটি মেনে নেয়া এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে নির্বাচনের আয়োজন করা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন