মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

নতুন কণ্ঠে সেই পুরনো কথাই


বাস্তব কারণেই মানুষ পরিবর্তন চায়। আর এই পরিবর্তনের আকাক্সক্ষার মধ্যে থাকে শান্তি, স্বস্তি, নিরাপত্তা, সুশাসন ও জীবনমানের উন্নয়ন। ভোটের সময় আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও গণআকাক্সক্ষার এই বিষয়গুলো বেশ উচ্চকণ্ঠেই উচ্চারণ করে থাকেন। নির্বাচনের সময় আমরা গণআকাক্সক্ষার অনুকূলে চমৎকার-চমৎকার স্লোগানও শুনে থাকি। যেমন গত নির্বাচনে আমরা শুনেছিলাম দিনবদলের কথা। দিন বদলের সেই স্লোগান যে বাস্তবায়িত হয়নি, গত সাড়ে চার বছরে দেশের জনগণ তা বেশ ভালভাবেই উপলব্ধি করেছেন এবং বিভিন্ন সময়ে যখন ভোটের মাধ্যমে মত প্রকাশের সুযোগ এসেছে তখন তারা সরকারি দলের লোকজনের বিরুদ্ধেই রায় দিয়েছেন। এই বিষয়টিকে সরকার এবং সরকারি দলের লোকজন নিজেদের জন্য একটি বার্তা হিসেবে গ্রহণ করতে পারতেন। বার্তার মধ্যে থাকে ভুলত্রুটির উপলব্ধি এবং সংশোধনের প্রচেষ্টা। কিন্তু সরকারি দল বার্তাকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে তর্কের খাতিরে তর্ক করেছে, উচ্চ কণ্ঠে নিজেদের সাফল্যের জয় গান গেয়েছে, বিপক্ষের বিরুদ্ধে নিন্দাবাদ করেছে এবং মত্ত হয়েছে ব্লেম গেমে। অর্থহীন ও পুরাতন এমন রাজনৈতিক তৎপরতায় জনগণ এখন ত্যক্ত-বিরক্ত। জনগণ নতুন কথা শুনতে চায়, চায় জনআকাক্সক্ষার অনুকূলে নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম ব্যক্তিত্ব। অনেকেই আজকাল নতুন নেতৃত্ব পাওয়ার আকাক্সক্ষাও প্রকাশ করছেন। এ প্রসঙ্গে চলে আসছে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের কথাও।
 দেশের মানুষ চায় স্বাধীনতা ও মুক্তি, চায় দেশের উন্নত ভাবমর্যাদা। এ কাজে যে নেতা বা যে দল সমর্থ হবে জনগণ তাদেরই ভালবাসবে ও সমর্থন করবে। তাই এ কথা ভাবার কোনো যুক্তি নেই যে, মানুষ কোনো নেতা বা দলের চিরন্তন সমর্থক হয়ে থাকবে। কৃতকর্মের কারণেই দল বা ব্যক্তির উত্থান-পতন ঘটে থাকে। এক সময়ে বাংলাদেশের মানুষ মুসলিম লীগের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, আবার সেই মুসলিম লীগকে বাদ দিয়ে বিজয়ী করেছে আওয়ামী লীগকে। এরপর জনগণ আবার আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বিজয়ী করেছে বিএনপিকে। এখন আবার ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। উত্থান-পতনের এমন ধারায় অপেক্ষা করছে একটি নির্বাচন। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠে নেমেছেন প্রধানমন্ত্রীর পুত্র জয়। জয়ের মুখে মানুষ নতুন কথা শুনতে চায়, ব্লেম গেমের অবসান চায়। কিন্তু জয় যখন বিরোধী দলের সমালোচনায় উচ্চকণ্ঠ হয়ে শুধু নিজদলের সাফল্যের জয়গান গাইতে থাকেন, তখন মানুষ আশাহত হয়। কারণ এমন বক্তব্য তো জনগণের কাছে নতুন কিছু নয়, বরং বলা যেতে পারে নতুন কণ্ঠে পুরাতন গান। তিনি যদি পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি, হলমার্ক ও শেয়ারবাজার প্রসঙ্গে ন্যায্য কথা বলতে পারতেন এবং গত সাড়ে চার বছরের শাসনামলে যে অব্যবস্থাপনা ও ভুলগুলো হয়েছে তা স্বীকার করে সমাধানের বাস্তবসম্মত পথনির্দেশ করতে পারতেন, তাহলে মানুষ আশাবাদী হতে পারতো। মানুষ হয়তো তখন বলতো, দিন বদলের লক্ষ্যে আমরা নতুন নেতা পেয়েছি। কিন্তু মানুষ জয়ের কাছে কাক্সিক্ষত বক্তব্য শুনতে পাচ্ছে না। কিছুদিন আগে তিনি বলেছিলেন, “আমার কাছে খবর আছে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে।’ সেদিন আবার বললেন, ‘তিনদিনের মধ্যে চমক দেখাব।’ এরপর আবার বললেন, এমন কথা তিনি বলেননি। এমন সব কথাবার্তার মধ্যে ক্ষমতার রাজনীতির সেই পুরনো চিত্রই ভেসে ওঠে, নতুন নেতৃত্ব কিংবা নতুনের কোনো আবাহন খুঁজে পাওয়া যায় না।
মানুষ চমক নয়, চায় শান্তি ও স্বস্তির জীবন। এ জন্য প্রয়োজন হয় আদর্শের রাজনীতি। আর আদর্শের রাজনীতির সাফল্যে প্রয়োজন জ্ঞান চর্চা, বাস্তবধর্মী রণকৌশল, ত্যাগ তিতিক্ষা, সততা ও সংযম। নতুন প্রজন্মের নেতা সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছে মানুষ এসবই আশা করেছিল। কিন্তু জয়ের নতুন কণ্ঠে পুরানো কথাগুলোই বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। গত সোমবার টাঙ্গাইল ও মধুপুরের জনসভায় জয় বললেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আগামী নির্বাচনের যুদ্ধই হলো শেষ যুদ্ধ। এমন বক্তব্য শুনে প্রশ্ন জাগে, রাজনীতিতে নির্বাচনটাই কি সব কিছু? আর নির্বাচন তো হলো প্রতিযোগিতার বিষয়, আমরা এটাকে যুদ্ধ বলে অভিহিত করছি কেন? আর জয় যদি নির্বাচনকে যুদ্ধ হিসেবেই বিবেচনা করে থাকেন, তাহলে আগামী নির্বাচনটাই শেষ যুদ্ধ হতে যাবে কেন? এর পরে দেশে কি আর কোনো নির্বাচন হবে না? আগামী নির্বাচনে যারা বিজয়ী হবেন তারা কি চিরদিনই ক্ষমতায় থেকে যাবেন? তাহলে তো দেশে আর গণতন্ত্রের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। আওয়ামী লীগের মতো একটি পুরানো দলের নতুন নেতার মুখে এ কেমন উচ্চারণ? এমন উচ্চারণে আওয়ামী লীগের কোনো উপকার হচ্ছে কিনা কিংবা ভোটের রাজনীতিতে ভোটার বাড়ছে কিনা তা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা ভেবে দেখতে পারেন। তবে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বক্তব্যে ভোটের রাজনীতি তথা আবার ক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র বাসনা যেভাবে ফুটে উঠছে তাতে জনগণের আশা ভঙ্গ হচ্ছে। কারণ জনগণ নতুন নেতার কণ্ঠে দিনবদলের নতুন কথা শুনতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন শুনছে নতুন কণ্ঠে অর্থহীন সেই সব পুরানো কথা। জনগণ তো নতুন কিংবা পুরাতন কোনো রূপেই আর প্রহসন কিংবা চাতুর্যের রাজনীতি চায় না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads