বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সঙ্ঘাতের ফাঁদ ও বাংলাদেশ


বিশ্বে অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত ও গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের সংখ্যা কয়েক দশকের মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক দেশেই এখন চলছে গৃহসঙ্ঘাত। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে বিপর্যস্ত অনেক দেশ রয়েছে ল্যাটিন আমেরিকায়ও। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ অবস্থা ছিল বাংলাদেশে। রাজনৈতিক বিরোধ-বিসংবাদ অনেক সময় এখানে অচলাবস্থা তৈরি করেছে কিন্তু সেটি গৃহযুদ্ধ বা সঙ্ঘাত সৃষ্টির পর্যায়ে পৌঁছেনি। এখন নানা মহল থেকে সে আশঙ্কাই করা হচ্ছে উদ্বেগজনকভাবে। অনেকটা পরিকল্পিতভাবেই যেন দেশকে গৃহসঙ্ঘাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। 
এখন বিশ্বের যেসব দেশ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে বিপর্যস্ত, সেসব দেশে এ সঙ্ঘাতের কারণ একেবারে অভিন্ন নয়। কোনো দেশে ধর্ম ও বর্ণগত ব্যবধান সঙ্ঘাতের সৃষ্টি করেছে। আবার কোনো দেশে এই সঙ্ঘাতের উৎস অনেকটাই জাতিগত। আবার রাজনৈতিক বিরোধ এবং আদর্শগত দ্বন্দ্বও অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাতের সূচনা করতে দেখা গেছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও অর্থনৈতিক বৈষম্যও অনেক দেশে অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বর্ণ, জাতি বা ধর্মীয় গোষ্ঠীগতÑ যে কারণেই এ সঙ্ঘাত সৃষ্টি হোক না কেনÑ এর মূল বীজ থাকে সংশ্লিষ্ট দেশের অভ্যন্তরীণ বিরোধের মধ্যে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এ বিরোধকে পুঁজি করে এই দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতকে উসকে দেয়। এর পেছনে যেমন থাকে কর্তৃত্ব¡ প্রতিষ্ঠার বিষয়, তেমনি থাকে অর্থনৈতিক স্বার্থের ব্যাপার-স্যাপার। 

 
পৃথিবীতে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত হয়ে এসেছে মধ্যপ্রাচ্য। সেখানকার সঙ্ঘাতে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে আরব জাগরণকে কেন্দ্র করে। এশিয়া ও আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ এই সন্ধিস্থলে রাজা-বাদশাহ ও একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পরিবর্তে জনগণের ইচ্ছার শাসনের সূচনা হবে বলে আশাবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল দুই বছর আগে। দেশে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু হয়ে তা সশস্ত্র¿ লড়াইয়ে পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। একাধিক দেশে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়। তুলনামূলক শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার বদল ঘটেছিল তিউনিসিয়া ও মিসরে। বিদেশী সেনা হস্তক্ষেপের মাধ্যমে শাসন পরিবর্তন ঘটে লিবিয়ায়। ইয়েমেনেও নানা টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে একটি পরিবর্তনের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলে। সিরিয়ায় শাসন পরিবর্তনের আন্দোলন রক্ষক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর পরও রক্তক্ষয় অবসানের কোনো লক্ষণ দেশটিতে দেখা যাচ্ছে না। 
মধ্যপ্রাচ্যের জাগরণ, শাসন পরিবর্তন ও পাল্টা সামরিক হস্তক্ষেপে অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত ও গৃহযুদ্ধে ছারখার হয়ে যাওয়াÑ এসব কিছুর পেছনে এখন ভিন্ন এক পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের রহস্য ক্রমেই যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতার মূল কারণ হিসেবে খ্যাত ইসরাইল আশির দশকে ইনোন পরিকল্পনা নিয়েছিল পুরো অঞ্চলকে দেশটির ওপর নির্ভরশীল অনেক রাষ্ট্রে বিভক্ত করে ফেলার। এ পরিকল্পনার পর থেকে নানা ইস্যুতে অস্থিরতা বেড়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। 
ব্রিটিশ ও ফ্রান্স যখন উপনিবেশ পরিত্যাগ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশকে স্বাধীনতা দিতে শুরু করে তখন তাদের অনুগত গোত্রগুলোর হাতে ক্ষমতা দিয়ে যায়। এসব রাজা-বাদশাহদের মধ্যে যারা যোগ্য ও সক্ষম ছিলেন, তারা নিজেদের রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছেন। আর অনেক দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কর্তৃত্বের হাতবদল হয়। তবে একনায়কতান্ত্রিক শাসন চলতে থাকে সব দেশেÑ যেখানে জনগণের মতামত শাসন পরিচালনা বা পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা রাখে না। 
ঔপনিবেশিক শাসনের সময় শাসক দেশগুলোর একটি বিশেষ কৌশল ছিল। তারা যেসব দেশে উপনিবেশ স্থাপন করত সেখানে ভাগ বিভাজন করে একটি গোষ্ঠীকে হাতে নিয়ে নিত। আর সে গোষ্ঠীর হাতে এমনভাবে কিছু কর্তৃত্ব তুলে দেয়া হতো, যাতে ঔপনিবেশিক শাসক ও স্থানীয় এই গোষ্ঠীর স্বার্থ একই রেখায় মিলে যায়। ইসরাইল ও তার পৃষ্ঠপোষকেরা মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সেই কৌশলই অনুসরণ করছে। 
একসময় মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর শাসকদের সামনে কমিউনিজম ছিল চ্যালেঞ্জ সৃষ্টিকারী আদর্শ। স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিভক্ত বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তন হয়। এর বিপরীতে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা একটি পুঁজিবাদী বলয় বিপরীত পথের দেশগুলোকে সমর্থন দেয়। অভ্যন্তরীণ অসঙ্গতির কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর সমাজতান্ত্রিক ভীতির স্থান দখল করেছে রাজনৈতিক ইসলাম বা ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠাকামীদের আন্দোলন। এই ভীতি পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর মুসলিম দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে যেমন একটি বাধা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, তেমনিভাবে মুসলিম দেশগুলোর শাসকদের সামনেও এটি একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। ইসরাইল তার ছিন্ন ভিন্ন করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ বাস্তবতাকে মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষভাবে কাজে লাগাতে পারছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের মধ্যপ্রাচ্যের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে তৈরী এক প্রতিবেদনে ইসরাইলের এক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। এ কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন, ‘আমরা উপভোগ করছি কিভাবে এক আরব অন্য আরবের গলা কাটছে। এ কর্মকর্তা মিসর ও সিরিয়ার পরিস্থিতির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। আসলে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এ ধরনের একটি পরিস্থিতি তৈরির জন্য কাজ করা হয়েছে। আমেরিকান ভিন্ন মতের চিন্তাবিদ দার্শনিক নোয়াম চমস্কি তার সাম্প্রতিক অনেক লেখা ও সাক্ষাৎকারে এর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্যে এখন যে সঙ্ঘাত রক্তক্ষয় ও গৃহযুদ্ধ তার অবসানের জন্য পশ্চিমা শক্তি কোনো ভূমিকা আসলেই পালন করছে না। তারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে আরো বিভক্ত ও দুর্বল করার যে পরিকল্পনা নিয়ে ইসরাইল কাজ করছে তাতে সহায়তাকারীর ভূমিকাই পালন করছে। 
মিসরের প্রেসিডেন্ট মুরসি সুয়েজ খালকে আন্তর্জাতিক বন্দরে পরিণত করে মিসরের অর্থনৈতিক সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এতে বিশ্ববাণিজ্যের কেন্দ্র দুবাইসহ আমিরাতের বন্দরগুলোর বাণিজ্যিক গুরুত্ব হারানোর আশঙ্কা ছিল। এ কারণে সংযুক্ত আরব আমিরাত বেপরোয়াভাবে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সর্বাত্মক সহায়তাই শুধু দেয়নি, একই সাথে গাজায় হামাসকে উৎখাতের জন্য কোটি কোটি ডলার তুলে দিচ্ছে ইসরাইল ও মিসরীয় জেনারেলদের হাতে। আমিরাত তার তেলক্ষেত্রগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্ব তুলে দিয়েছে ইসরাইলি অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলদের পরিচালিত বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার হাতে। এভাবে কার্যত দেশটি নিজেকে ইসরাইলের আশ্রিত দেশে পরিণত করছে; যেটি ইনোন পরিকল্পনার মাধ্যমে ইসরাইল অর্জন করতে চাইছে। 
মিসরে ড. মুরসি যেসব পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে শুরু করেছিলেন, তাতে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পন্ন হলে দেশটি আঞ্চলিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠত। আবার এতে প্রতিবেশী আরব বংশপরম্পরায় শাসিত দেশগুলোর জন্যও এটি চ্যালেঞ্জও হয়ে দাঁড়াতে পারত। ইসরাইল এ ভীতিকে আরব শাসকদের সামনে এমনভাবে তুলে ধরেছে যে তারা মিসরের শাসন পরিবর্তনের সাথে সাথে মধ্যপ্রাচ্যের পুরো ইসলামি শক্তির ওপর আঘাত হানতে শুরু করেছে। মিসরের ইতিহাসে মসজিদে আগুন দিয়ে আহত-নিহতদের লাশ পোড়ানোর বিষয় কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। মিসরীয় সেনাবাহিনীকে দিয়ে এটি সফলভাবে করিয়ে নিতে পেরেছে ইসরাইল। এতে পশ্চিমের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা মিসরীয় সেনাবাহিনীর সাথে জনগণকে মুখোমুখি করে দেয়া সম্ভব হয়েছেÑ যাতে সেনা প্রতিষ্ঠান ও দেশটির ইসলামি শক্তি একটি অন্যের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। একই পরিস্থিতি আরব বিশ্বের দেশে দেশে সৃষ্টি করা হচ্ছে শিয়া-সুন্নি উত্তেজনা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে। ঔপনিবেশিক আমলে মুসলিম দেশগুলোতে একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরি করে তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে জনগণকে শাসন ও শোষণ করা হতো। এখন স্বাধীন দেশগুলোর কোনো কোনোটিতে রাজতান্ত্রিক শাসক আবার কোনো কোনোটিতে সেনাবাহিনীকে পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা দিয়ে একই স্বার্থ আদায় করা হচ্ছে। আর এর জন্য প্রথমেই যেটি প্রয়োজন পড়ে সেটি হলো অস্থিরতা তৈরি করা। এ জন্য যেসব দেশে শাসকেরা খুব বেশি শক্তিধর নয়, সেখানে সেনাবাহিনী, বিচারব্যবস্থা ও আমলাদের সাথে সরাসরি যোগসূত্র তৈরি করা হয়। 

 
মধ্যপ্রাচ্যে আজ যে অস্থির অবস্থা দেখা যাচ্ছে তার অনেক লক্ষণ কিন্তু বাংলাদেশে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশকে এক সময় আন্তর্জাতিক ভূকৌশলগত অবস্থানের ক্ষেত্রে ততটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হতো না। যেটি নানা কারণে এখন পাল্টে গেছে। প্রথমত, বিশ্ব কর্তৃত্বের সম্ভাব্য প্রতিযোগিতায় ২০২০ সাল নাগাদ আবির্ভূত হতে যাচ্ছে চীন। দেশটির অন্যতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলো বাংলাদেশ। দ্বিতীয়ত, চীনের ওপর নজর রাখার ক্ষেত্রে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ মিয়ানমারে পশ্চিমামুখী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়েছে অজানা খনিজ সম্পদের বিপুল মজুদ। সেখানে অবাঙালি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিপুল বসবাস রয়েছে। এর সাথে ভারত ও মিয়ানমার অংশকে সংযুক্ত করে একটি বাফার স্টেট করার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বলে পশ্চিমা কৌশলবিদদের অনেকের ধারণা রয়েছে। এ ছাড়া এ অঞ্চলে রয়েছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইহুদি জনগোষ্ঠীর বসবাস, যাদের হারিয়ে যাওয়া ই্হুদি গোত্র হিসেবে ইসরাইল গ্রহণ করেছে এবং তাদের সাথে বিশেষ যোগসূত্র তৈরি করেছে। এর বাইরেও বেশ কিছু পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে হারিয়ে যাওয়া ইহুদি গোত্রের অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। এ অঞ্চলে পৃথক একটি ইহুদি রাষ্ট্র কায়েমের আওয়াজ ইতোমধ্যে উত্থাপন করেছে মনিপুর-মিজোরামের ইহুদিরা। পার্বত্য চট্টগ্রামকেন্দ্রিক পশ্চিমা দেশগুলোর বিশেষ তৎপরতায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে বাংলাদেশের গুরুত্ব এ কারণেও ক্রমেই বাড়ছে। চতুর্থত, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলোয় খ্রিষ্টান ও উপজাতীয়দের বিপুল বসবাস এবং তাদের মধ্যকার বিদ্যমান বিচ্ছিন্ন হওয়ার আন্দোলনও বাংলাদেশের প্রতি বিশেষ আন্তর্জাতিক নজর দেয়ার কারণ হয়ে উঠেছে। 
কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক সম্পদ অথবা ভূকৌশলগত বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ার পর সেখানে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হলে প্রথমেই অস্থিরতা সৃষ্টির প্রয়োজন দেখা দেয়। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় সবাই একই ভাষাভাষী এবং ৯০ শতাংশ মানুষ একই ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী হওয়ায় এখানে অস্থিরতার উপকরণ মধ্যপ্রাচ্য বা আফ-পাক এলাকার মতো নেই। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় এখানে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্যের আওয়াজ তুলে অস্থিরতা সৃষ্টি করা সহজও নয়। ফলে এখানে রাজনৈতিক ইস্যুকেই বড় করে তোলা হয়েছে। আলকায়েদা বা জঙ্গিবাদী তৎপরতা এখন বিশ্বের যেসব স্থানে সক্রিয় দেখা যায়, তার নিয়ন্ত্রণ ও কার্যক্রম বেশ রহস্যপূর্ণ মনে হয়। আমেরিকার যেখানে হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন দেখা দেয় সেখানে আলকায়েদার তৎপরতা ও হুমকি বেড়ে যায়। একসময় আফ-পাক এলাকা ছিল এই গোষ্ঠীর প্রধান তৎপরতার কেন্দ্র। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের পরিকল্পনা ঘোষিত হওয়ার পর আলকায়েদা মধ্যপ্রাচ্যমুখী হয়ে গেছে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। নানাভাবে সিরিয়ার রণক্ষেত্রের দুই পক্ষের এক দিকে কথিত আলকায়েদা সংশ্লিষ্ট আন নুশরা গ্রুপ আর বিপরীত দিকে শিয়া মিলিশিয়া হিজবুল্লাহকে যুদ্ধে নামানোর ব্যবস্থা হয়েছে। এ দুই পক্ষ একে অন্যকে ইসরাইলের চেয়েও বড় শত্রু মনে করছে। আর ইসরাইল আমেরিকানদের প্রতি দুই পক্ষকে বিমান হামলা করে নিঃশেষ করার পরামর্শ দিচ্ছে। 
অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে সেই জঙ্গিবাদী তৎপরতার প্রচারণা এক দশক ধরে বাংলাদেশে চালানো হচ্ছে। সরকারের সরাসরি উদ্যোগেও এ ধরনের প্রচারণা জোরদার করা হচ্ছে। মিসরে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইসলামিস্টদের দমন অভিযান চালানোর প্রেক্ষিত তৈরির জন্য লিবারেল-সেকুলারিস্টদের সাথে ইসলামিস্টদের সঙ্ঘাত ও বিভক্তিকে উসকে দেয়া হয়েছিল। সেই একই ধরনের বিভক্তিকে বাংলাদেশে উসকে দেয়া হচ্ছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। এ ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধকে করা হয়েছে একটি ইস্যু। ইসলামিস্ট দমনের জন্য এ ইস্যুটি তুলে আনা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের কাজ করার জন্য নিরাপত্তাবাহিনীর পাশাপাশি কাজে লাগানো হয়েছে বিচারব্যবস্থাকে। 
বিচারব্যবস্থার একটি নির্দিষ্ট অবয়ব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যাকে বা যাদের শিকার করতে চাইবে তার জন্য আইন প্রণয়ন, সংশোধন ও বিচারের আয়োজন করতে পারে। আদালত গঠন, বিচারক নিয়োগ, প্রসিকিউশন গঠনÑ এ সব কিছুর ৯০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ থাকে সরকারের হাতে। এখানে অভিযুক্ত পক্ষের কৌঁসুলিরা আইনি লড়াই চালাতে পারেন কিন্তু তাদের বক্তব্য ও যুক্তি গ্রহণ করা-না-করা সবই বিচারকদের মনোভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। কোনো এক বিচারক তার বিচার জীবনের স্মৃতিকথায় বলেছিলেন, তিনি একটি খুনের ঘটনা নিজে প্রত্যক্ষ করেন। ঘটনাক্রমে সেই ঘটনার মামলা বিচারের জন্য উত্থাপিত হয় তারই আদালতে। সেখানে খুনি হিসেবে যাকে অভিযুক্ত করা হয়, তিনি আসলেই প্রকৃত খুনি ছিলেন না। কিন্তু তার বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগ বিবরণী এবং তদন্ত প্রতিবেদন এমনভাবে উপস্থাপিত হয় যে আইনি যুক্তিতর্কে তিনি যে আসলেই খুনি নন, তা প্রমাণের কোনো সুযোগই এই বিচারকের সামনে ছিল না। এই বিচারক খুনের দায়ে অভিযুক্তকে শাস্তি দিতে বাধ্য হন। 
বাংলাদেশে এখন যে বিচারের আয়োজন চলছে তাতে সেই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে একের পর এক। সর্বশেষ যে অভিযুক্তকে সর্বোচ্চ আদালত থেকে ফাঁসির দণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে তার বয়স এখন ৬৫ বছর। ৪৪ বছর আগে তিনি ছিলেন ২০-এর কোটায়। তিনি উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রি পড়েছেন ফরিদপুরে। এ লোক কিভাবে ফরিদপুর থেকে এসে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মিরপুর গিয়ে ৫০০ বিহারিকে সংগঠিত করে নিজের স্বগোত্রীয় বাঙালিদের ওপর নিধনযজ্ঞ চালাতে পারলেন। এটি আদৌ সম্ভব কি না সেটি বিবেচনায় আসছে কি না জানা যায়নি। নামের মিল থাকায় মিরপুরের বিহারি আবদুল কাদের মোল্লার সব দায়ভার চাপিয়ে ফরিদপুরের বাঙালি আবদুল কাদের মোল্লার শাস্তি হচ্ছে কি না সেটি এখন গণমাধ্যমের একতরফা প্রচারণায় যেন কোনো ইস্যুই নয়। তরুণ বয়সে এভাবে শত শত মানুষকে হত্যা করে কসাই খ্যাতি মেলার পর সে ব্যক্তি স্বাধীনতার পর পাঁচ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থেকে পদার্থবিদ্যা ও শিক্ষা বিষয়ে কৃতিত্বপূর্ণ ডিগ্রি নিয়ে উদয়ন স্কুল ও বিডিআর কলেজে কিভাবে অধ্যাপনা করতে পারলেন এবং হতে পারলেন ঢাকার অবিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নের দুইবার সহসভাপতি তাও আলোচনায় আসছে না। সবই হারিয়ে যাচ্ছে একপক্ষীয় প্রচারণায়। 
আশির দশকের গোড়ার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ কাসের ছাত্র থাকার সময় আমাদের রাজনৈতিক তত্ত্ব ও দর্শন পড়াতেন খ্যাতনামা অধ্যাপক ড. আর আই চৌধুরী। তিনি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হয়েছিলেন। একনাগাড়ে দুই ঘণ্টা কাস নিতেন। কঠিন কঠিন বিষয়গুলোকে এমন সহজভাবে তিনি বুঝাতেন যে কাসের সবচেয়ে অমনোযোগী ছাত্রের পক্ষেও না বোঝার সুযোগ থাকত না। এক দিন খ্যাতনামা এক দার্শনিকের বরাত দিয়ে স্যার বলছিলেন, কোনো রাজশাসনের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে যখন সেই রাষ্ট্রে বিচারকারী এবং দণ্ড কার্যকরকারীর মধ্যে আর কোনো পার্থক্য থাকে না। শেষোক্ত জনের কাজ হলো হুকুম তামিল করা। আর বিচারকারীর দায়িত্ব হলো অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে অপরাধের দায় আনা হয়েছে, সে জন্য তিনি প্রকৃত দোষী কি না তা বিবেচনা করে রায় দেয়া। সে দায়িত্ব পালন না করে কোনো বিচারক যদি হুকুমের গোলাম হয়ে যান, তখন দুইজনের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য থাকে না। সে রকম শাসন বেশি দিন টিকতে পারে না। অধ্যাপক আর আই স্যারের বক্তব্যের তাৎপর্য সেই দিন ততটা উপলব্ধি করতে পারিনি যতটা এখন পারছি। 
বাংলাদেশের বিপদটি হলো সাম্প্রতিক নানা ঘটনা দেশকে চরম বিভক্তির দিকে ভয়ঙ্করভাবে এগিয়ে নিচ্ছে। এর সাথে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং রাজনৈতিক দুই পক্ষকে মুখোমুখি করার মাধ্যমে গৃহসঙ্ঘাত এবং বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপের চারণভূমিতে পরিণত করার শঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে। 

 
দেশে দেশে আজ যে গৃহযুদ্ধ ও সঙ্ঘাত চলছে, তার ওপর বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ পল কুলিয়ার (Paul Collier) সঙ্ঘাতের ফাঁদ থেকে উত্তরণ : গৃহযুদ্ধ ও উন্নয়ন নীতি (Breaking the Conflict Trap: Civil War and Development Policy) নামে একটি বই লিখেছেন। এ বইয়ে তিনি সঙ্ঘাত ও গৃহযুদ্ধের ফলে কী ক্ষতি বিশ্বের হয়েছে তার ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছেন, এ কারণে ৫০ লাখ মানুষ এখন বাস্তুচ্যুত। এর শিকার মানুষগুলোর আয় কমে গেছে ১৫ শতাংশ। ৩০ শতাংশ মানুষ এ কারণে চরম দারিদ্র্যসীমায় নেমে পড়েছে। মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের হার এসব দেশে বেড়ে গেছে। সামরিক ব্যয় বেড়ে গিয়ে কমেছে সামাজিক খাতের ব্যয়। সেই সাথে মূলধন-পলায়ন বেড়ে যায়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জীবনমানে। বিশ্বে ৯৫ শতাংশ মাদক চালান হয় এ ধরনের গৃহসঙ্ঘাতপ্রবণ দেশের মধ্য দিয়ে। এতে মাদক ও এইডসের বিস্তৃতিও ঘটে। এক-এগারো এবং এর পরবর্তী সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের ঘটনায় এক কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। গৃহসঙ্ঘাতে একবার জড়িয়ে গেলে সে দেশে বিভক্তি সমাজের গভীরে প্রবেশ করে আর সঙ্ঘাত অর্থনীতিকে করে দুর্বল। দুর্বল অর্থনীতি সঙ্ঘাত ও সহিংসতাকে ছড়িয়ে দেয়। এভাবে এক ধরনের ফাঁদে আটকে যায় দেশটি। 
মিসরে আজ যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে, তা ঘটানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন নোবেল বিজয়ী মোহাম্মদ আল বারাদি। তিনি সরকার থেকে বিদায় নেয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মুরসিই সঠিক পথে ছিলেন। কিন্তু বারাদির এই উপলব্ধি যখন আসে তখন নীল নদের পানি রক্তে লাল হয়ে অনেক দূর গড়িয়েছে। তিনি হাজার চেষ্টা করেও পুরনো সময়কে আর ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। বাংলাদেশে আজ ইসলামিস্ট দমনে সেকুলারিস্ট ও লিবারেলদের স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ অথবা তত্ত্বাবধায়কের পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি করে যে গৃহসঙ্ঘাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার পরিণতি এক ভয়াবহ বিপর্যয়কে অনিবার্য করে তুলতে পারে। কিন্তু প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার আকাক্সা যেন ক্ষমতাধর কাউকে এমনভাবে অন্ধ করে দিয়েছে যে অনিবার্য এই বিপর্যয় দেখা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads