হঠাৎ করে মানবদেহে রক্ত কণিকার প্রয়োজনীয়তার কথা আমার মনে পড়ল। আমাদের দেহে যে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে তাতে দু’ধরনের রক্ত রয়েছে; একটি হলো লোহিত কণিকা এবং অপরটি হলো শ্বেত কণিকা। লোহিত কণিকাকে ইরিথ্রোসাইটসও বলা হয়। এর কাজ হচ্ছে সারা শরীরে অক্সিজেন ছড়িয়ে দেয়া এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে শরীরকে মুক্ত রাখা। এই কণিকাগুলোর মধ্যে কোন নিউক্লিয়াস নাই এবং তারা ১২০ দিন বেঁচে থাকে। পক্ষান্তরে শ্বেত কণিকার কাজ হচ্ছে ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া থেকে শরীরকে সুরক্ষা প্রদান করা যাতে করে রোগ-ব্যাধি আক্রমণ করতে না পারে। আমাদের প্রতি ফোঁটা রক্তে লাখ লাখ লোহিত কণিকা এবং সাত থেকে পঁচিশ হাজার শ্বেত কণিকা রয়েছে। শ্বেত কণিকা রোগ-জীবাণুর সাথে লড়াই করে। রোগ-জীবাণু যদি শক্তিশালী হয় এবং এই লড়াইয়ে শ্বেত কণিকা পরাজিত হয় তাহলে আমরা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ি। কথাটা মনে পড়ল ভারতীয় বিদ্যুৎ আমদানির পর দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার দুরবস্থা দেখে। ভারত থেকে কয়েকদিন আগে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়েছে এবং কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা সাব-স্টেশনে ভারতীয় বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হয়েছে। এটা দেখে নাকি সেদিন বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়াররা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন। খুশীতে কারো কারোর অবস্থা বেহুঁশ হয়ে যাবার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল।
এখন আমার নিজের কথা বলি। ভারতীয় বিদ্যুৎ আমদানির আগে আমার এলাকায় দৈনিক গড়ে প্রায় ৫ বার ১ ঘণ্টা করে লোডশেডিং হতো, যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘আগের আমলের বিদ্যুৎ সঙ্কটের কথা স্মরণ রাখার জন্যে’ দৈনিক দু’বার লোডশেডিং করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জাতির উদ্দেশে তার প্রদত্ত বক্তব্যে ঘোষণা করেছিলেন। ভারতীয় বিদ্যুৎ আমদানির পর কয়েক দিন ধরে আমার এলাকায় ৮-১০ বার লোডশেডিং হচ্ছে। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে রক্তকণিকার কথা আমার মনে পড়েছে। আমার মনে হচ্ছে, আমাদের জাতীয় গ্রীডে ভারতীয় ভাইরাস প্রবেশ করেছে এবং এই ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করে আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা তার জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ফলে রোগাক্রান্ত হয়ে দেশে লোডশেডিং-এর ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধি পেয়েছে। বলাবাহুল্য দেশব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী বিদ্যুৎ সংকট সত্ত্বেও ভারত বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানি করছে এবং দেশটিকে সঙ্কট উত্তরণে সহায়তা করছে বলে জানা গেছে। অনেকের কাছেই এটি একটি বিস্ময়কর ব্যাপার। কেউ কেউ মনে করেন যে, এর ফলে উভয় দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার হবে। তাদের এই ধারণা কতদূর সত্য হয় তা সময়ই বলে দেবে। আপাতত একথাই বলা যথেষ্ট যে, গঙ্গা, তিস্তাসহ বাংলাদেশের উজানে আরো ৫২টি আন্তর্জাতিক নদীর পানি প্রত্যাহার, নদীসমূহের উপর বাঁধ তৈরি এবং কোন কোন ক্ষেত্রে জলাধার ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের যে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত ক্ষতিসাধন করে চলেছে তাতে দু’দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক দিন দিন তিক্ত থেকে তিক্ততর হয়ে চলেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী ছিটমহলসমূহ হস্তান্তরে ভারতীয়দের অব্যাহত অনীহা, যদিও বাংলাদেশ চুক্তির পরপরই বাংলাদেশী ভূখ- ভারতকে হস্তান্তর করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার গত পৌনে পাঁচ বছরে ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর, বন্দর, গ্যাস ও কয়লা সুবিধা দিয়ে তাকে ক্ষমতায় বসানোর কৃতজ্ঞতা ঋণ পরিশোধ করেছে। কিন্তু পশ্চিম বাংলার বিরোধিতা ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রচ্ছন্ন অনীহার দরুন তিস্তা চুক্তি সম্পাদিত হয়নি। এর ফলে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একটি চরম ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছে। তাদের এই ক্ষোভ বিস্ফোরনোন্মুখ বিক্ষোভে পরিণত হচ্ছে আরেকটি কারণে এবং সেটা হচ্ছে ভারতীয় নির্দেশনা ও পরামর্শে এই দেশের আলেম-ওলামা, দেশপ্রেমিক, সৎ ও নিষ্ঠাবান শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা এবং ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে জঙ্গি আখ্যায়িত করে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা। এই অবস্থায় আধিপত্যবাদী প্রতিবেশীর পা-চাটা নওকর হিসাবে মানুষ সরকারের প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত এবং তা নিরসনের অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ দিয়ে ভারত বাংলাদেশের মানুষের কিছুটা মন ভোলাতে চায়। কিন্তু ওয়ালস্ট্রীট পত্রিকা সম্প্রতি এই বিদ্যুতের আসল তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে। ওয়াল স্ট্রীট পত্রিকা বলেছে, উত্তর-পূর্ব ভারতে উৎপাদিত অতিরিক্ত বিদ্যুৎ গ্রীডলাইনের অভাবে ঐ দেশের সরকার দেশের বিদ্যুৎবঞ্চিত এলাকাসমূহে প্রেরণ করতে পারেন না। এই অবস্থায় তারা প্রতিবেশী বাংলাদেশে তা রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই উদ্দেশ্যে ভারতীয় স্টেট ইউলিটি এনটিপিসি’র সহযোগী বিদ্যুতের ব্যাপারে নিগমের সাথে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ২৫ বছর মেয়াদী একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ভারতের ইস্টার্ন গ্রীড থেকে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। এই বিদ্যুৎ কয়লাভিত্তিক। এ বছরের শেষের দিকে ভারতীয় সরবরাহকারীদের দরপত্র মূল্যায়নের পর আরো ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রফতানির একটি বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদিত হবে এবং পর্যায়ক্রমে তা ৫ বছরে ১০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হবে। এই রফতানির মাধ্যমে ভারত বার্ষিক ৩৫ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হবে। এতে দেশটির ক্রম সম্প্রসারণশীল ঈড়ৎৎবহঃ অপপড়ঁহঃ ফবভরপরঃ নিয়ে যে উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে তার কিছুটা অবসান ঘটবে। অক্টোবর থেকে এই রফতানি শুরু হবে। বলাবাহুল্য ইতঃপূর্বে ভারত, নেপাল ও ভুটানের কাছেও বিদ্যুৎ বিক্রয় করেছে তবে তার পরিমাণ ছিল ২০-৩০ মেগাওয়াট। শোনা যাচ্ছে যে, ভারত পাকিস্তানের কাছেও ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ বিক্রির পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশের কাছে যে বিদ্যুৎ তারা তৈরি করছে তার ইউনিট প্রতি মূল্য নিয়ে বাজারে বিভিন্ন রকমের কথা আসছে। যতদূর জানা গেছে যে, এই বিদ্যুৎ ভারত বাংলাদেশকে ৭ টাকা দরেই দিতে চাচ্ছে এটা তাদের উৎপাদন ব্যয়ের সমান। তবে সরকারিভাবে এই মূল্য সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন যে, বাংলাদেশের জাহাজগুলো যেখানে নৌরুট ও বন্দর ব্যবহারের জন্যে সরকারকে কর দেয় সেখানে বিনা পয়সায় ভারত বাংলাদেশের নৌ করিডোর/ট্রানজিট ব্যবহার করছে এবং স্থল ট্রানজিট ব্যবহার বাবদ বাংলাদেশকে কোন প্রকার চার্জ বা কর পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ করছে। এই অবস্থায় ইউনিট প্রতি উৎপাদন ব্যয়ের সমমূল্যে বাংলাদেশকে তারা বিদ্যুৎ দেবে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়, দিলেও তাদের মধ্যে সিনসিয়ারিটির অভাব রয়েছে। অতি সম্প্রতি আরেকটি ঘটনাও ঘটেছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে টন প্রতি ৩০০ ডলার মূল্যে পিয়াজ আমদানি করছিলেন এবং ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এই মূল্যে পিয়াজ সরবরাহের জন্য তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধও হয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে তারা পিয়াজের টন প্রতি মূল্য প্রথমে ৫০০ এবং পরে ৯০০ ডলারে উন্নীত করলেন এবং তাদের প্রতিশ্রুতিও ভঙ্গ করলেন। এতে করে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব এক সঙ্কটে নিপতিত হলো। এর ফল হলো এই যে, আমাদের এই ভারত নির্ভরতা পিয়াজের কেজি প্রতি মূল্য ৮০-১০০ টাকায় তুলেছে এবং মানুষ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পড়েছে।
আমি আগেই বলেছি ভারতে দীর্ঘস্থায়ী বিদ্যুৎ সঙ্কট রয়েছে এবং এই দেশটির কোন কোন এলাকায় ভয়াবহ লোডশেডিং চলছে। তথাপিও অক্টোবর মাস থেকে বাংলাদেশের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রির ভারতীয় সিদ্ধান্ত অনেককেই বিস্মিত করেছে। আমি মনে করি, এতে বিস্ময়ের কিছু নাই। কেননা অক্টোবর মাস থেকে তাপমাত্রা কমতে শুরু করবে এবং নভেম্বর মাসে পুরোপুরি শীত এসে যাবে। আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই শীতের তীব্রতা অব্যাহত থাকবে। শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে সময়ে অফিস ঐ আদালত ও বাসাবাড়িতে পাখা চলে না, এসি/এয়ারকুলার চলে না। ফলে বিদ্যুৎ খরচা হয় কম। এই অবস্থায় লোডশেডিং নি¤œতম পর্যায়ে নেমে আসে। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের বেলায়ও প্রযোজ্য। কাজেই ভারত শীত মওসুমে যদি বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে এবং তার বিপরীতে পর্যাপ্ত পয়সা পায় তাহলে মন্দ কি! এ রফতানির পেছনে আরো কিছু কৌশল আছে। আগামী জানুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা আছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ভারতের একটি আজ্ঞাবহ সরকার। গত ৫ বছরে এই সরকার জাতিকে প্রদত্ত তার কোন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। বরং দুঃশাসন, নির্যাতন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থকরণ, দুর্নীতি, লুটপাট, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, সরকারি সম্পদের অপব্যবহার, প্রশাসনের নির্লজ্জ দলীয়করণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে তারা একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ধর্ম, ধর্মভিত্তিক দলসমূহ এবং শীর্ষস্থানীয় আলেম-ওলামা ও রাজনৈতিক নেতাদের ওপর তাদের নির্যাতন, আল্লাহ, তাঁর প্রিয় নবী (সাঃ) তাঁর সহধর্মীনিগণ এবং সাহাবায়ে কেরামের ওপর নাস্তিক মুরতাদদের অশালীন ও অশ্লীল মন্তব্য ও গালাগাল এবং প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তাদের প্রশ্রয় দান ও একজনকে জাতীয় বীর আখ্যাদান এই সরকারের জনপ্রিয়তা প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছে। বিদ্যুৎ খাতের ব্যর্থতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের ভ্রান্তনীতি, দুর্নীতি, বেগম জিয়ার ভাষায় কুইক রেন্টাল, কুইক মানি উপার্জন ও বিদেশে তা কুইক পাচারে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এই খাতের দায়মুক্তি আইন মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী নির্বাচন যদি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় তাহলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি অনিবার্য। ভারতীয় বিদ্যুৎ এক্ষেত্রে তাদের ডুবন্ত ইমেজকে হয়তো কিছুটা রক্ষা করতে পারবে বলে সরকার মনে করছেন এবং নির্বাচনের এই ক্রান্তিকালকেই বিদ্যুৎ আমদানির জন্য চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে এই বিদ্যুৎ শেখ হাসিনার সরকারকে রক্ষা করতে পারবে বলে মনে হয় না। ভারতীয় বিদ্যুৎ আসার পর লোডশেডিংয়ের ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধির কথা তো আগেই বললাম। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এখানে কিছুটা কৃতজ্ঞতার পরিচয় দেয়া হচ্ছে। দেশ ও জাতিকে প্রদত্ত সকল প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলেও শেখ হাসিনা ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর, বন্দরসহ তার চাহিদার অতিরিক্ত অনেক কিছুই দিয়েছে। বিপুল এই দানের কিছুটা প্রতিদান। আরেকটি উদ্দেশ্যও এক্ষেত্রে আছে; তা হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশ থেকে গ্যাস ও কয়লাপ্রাপ্তি। ভারতীয় বিদ্যুতের ওয়েবসাইটগুলো ভিজিট করুন, বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠবে। অবশ্য এ রফতানি কতদিন অব্যাহত থাকে তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। যদি থাকেও তা বাংলাদেশের জন্য শুভ হতে পারে না। বিদ্যুৎ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। বিদ্যুতের চাবি ভারতের কাছে রেখে আমরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিন্তা করতে পারি না। আর আমাদের গ্যাস ও কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ভারত ঐ বিদ্যুৎ আমাদের কাছে রফতানি করবে তা হয় না। এটি একটি কূটকৌশল। এজন্য জাতির ম্যান্ডেট নেয়া উচিত ছিল। এখন ভারতের অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া প্রয়োজন।
ভারত বাংলাদেশকে যে বিদ্যুৎ দিচ্ছে এই ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রয়েছে। ভারতীয় দলিলপত্রের এক জায়গায় বলা হয়েছে যে, উত্তর-পূর্ব ভারতে তাদের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ আছে। কেননা সেখানে গ্রীড লাইনের অভাবে বিদ্যুৎ বঞ্চিত এলাকাসমূহে তারা বিদ্যুৎ পৌঁছাতে পারেন না বলেই তারা তা বাংলাদেশে রফতানি করছেন। আবার অন্য জায়গায় বলা হয়েছে যে, পশ্চিমবাংলার শিল্পায়ন তৎপরতা শ্লথ হয়ে যাবার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে শিল্প-কারখানায় বিদ্যুৎ চাহিদা কমে গেছে এবং বর্তমানে ঐ রাজ্যে ১০ শতাংশ অতিরিক্ত বিদ্যুৎ রয়েছে। গত এক বছরে পশ্চিমবাংলায় ৩০ হাজার মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ তাদের জাতীয় গ্রীডে যুক্ত রয়েছে এবং তারা প্রায় মাত্র তিন হাজার মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করতে সক্ষম হয়েছে। এই হিসাবটি মিলানো মুশকিল। তথাপিও পশ্চিমবাংলা থেকেই বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আসছে বলে মনে হয়। পশ্চিমবাংলার শিল্প-কারখানার চাহিদা যখন বৃদ্ধি পাবে তখন কি হবে? এই রাজ্যটির ৬০ শতাংশ বাসিন্দা বিদ্যুৎ থেকে বর্তমানে বঞ্চিত রয়েছে। তারা বঞ্চিত থেকে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ সরবরাহে রাজী থাকবে কি? শিল্প-কারখানায় চাহিদা বৃদ্ধি এবং জনগণের চাপ অব্যাহত থাকলে রফতানির এই ধারাবাহিকতা কখনো নিরবচ্ছিন্ন থাকতে পারে না এবং বাংলাদেশের পক্ষেও তাদের সাধারণ ভোক্তা এবং শিল্প-কারখানা ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর চাহিদা উপেক্ষা করে আগামী দিনগুলোতে ভারতকে ক্যাশ দেয়ার নিশ্চয়তা দেয়া যায় বলে আমার মনে হয় না। ভারতের ব্যাপারে আরো কয়েকটি কথা বলা দরকার। সেখানে গড়ে পল্লী এলাকায় ৪৪ শতাংশ ঘরবাড়ি বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছে। কিন্তু এই সংযোগ পাওয়ার অর্থ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নয়। দৈনিক ১২ ঘণ্টা তারা লোডশেডিং-এর যন্ত্রণা ভোগ করে। দিল্লী, উত্তর প্রদেশ, তামিলনাড়ু, বিহার, উড়িস্যা, আসাম, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান ও অন্ধ্রপ্রদেশে একই অবস্থা বিরাজ করছে। পাঞ্জাব, গোয়া, গুজরাট এবং কেরালা রাজ্য লোডশেডিং-এর দিক থেকে অনেকটা ভালো অবস্থানে আছে। তাদের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইতে বিদ্যুতের পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে। পশ্চিম বাংলার অবস্থা আগেই বলেছি এবং তা ক্ষণস্থায়ী। ভারতে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তার বেশিরভাগ হয় কয়লা (৫৭%) থেকে। দ্বিতীয় অবস্থান হচ্ছে জলবিদ্যুতের (১৯%); তৃতীয় অবস্থান বায়োমাস ও অন্যান্য পদার্থ (১২%) থেকে। এখানে গ্যাস থেকে উৎপাদিত হয় শতকরা (৯%) বিদ্যুৎ এবং নিউক্লিয়ার বা পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত হয় (২%) এবং (১%) হয় ডিজেল থেকে। তাদের কয়লার সরবরাহ কমে গেছে এবং গ্যাসের রিজার্ভও মাত্র ৪৩.৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এই অবস্থায় তারা গ্যাস ও কয়লা সংগ্রহে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিদ্যুতের নামে যদি তারা বাংলাদেশ থেকে গ্যাস ও কয়লা নিতে পারে তাহলে সঙ্কট উত্তরণ তাদের জন্য সহজতর হবে। বাংলাদেশকে এই বিষয়টি ভালোভাবে ভেবে দেখে তার পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে আমি মনে করি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন