রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার শুদ্ধাচারী সৈনিক কারা?


চলতি বছরটির যবনিকাপাতের অপর অর্থ বর্তমান সরকারের চলতি শাসন মেয়াদেরও যবনিকাপাত। হাতে আর মাত্র চারটি মাস। এর পরই এ সরকার তার পাঁচ বছর মেয়াদের ইতি ঘটাবে। অতএব বলা যায়, বর্তমান সরকার এখন চলতি মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এই শেষ প্রান্তে এসে সরকার হাতে নিতে যাচ্ছে নতুন এক প্রকল্প। এ প্রকল্পের মহান লক্ষ্য শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়া। শোনা যাচ্ছে, এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকার এরই মধ্যে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্রপ্রণয়ন করেছে। তবে এ-ও শোনা যাচ্ছে, সরকার প্রণীত এই কৌশলপত্রে শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য ৮৬টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সুনির্দিষ্ট সুপারিশও রয়েছে এই কৌশলপত্রে। ধরে নেয়া যায় সেসব সুপারিশের আলোকে খুব শিগগিরই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজে নেমে পড়বে সরকারের রাজনৈতিক পক্ষ এবং সেই সাথে সরকারের নির্বাহী পক্ষও। সব কিছু ভালোয় ভালোয় চললে, আশা করা যায় এ দেশের মানুষ বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের কাছ থেকে সর্বশেষ মহা উপহার হিসেবে একটি শুদ্ধ বাংলাদেশউপহার পাবে। তখন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বিদায় নেবে বর্তমান অশুদ্ধ বাংলাদেশ। সে স্থান দখল করবে নতুন এক শুদ্ধ বাংলাদেশ। আমরা জানি না, বর্তমান সরকারের এই শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার খায়েশের সূচনা কবে ঘটেছে। কবে থেকে এ নিয়ে চিন্তাভাবনার শুরু। কারণ গণমাধ্যমে এর আগে এ সম্পর্কে কোনো কিছুই প্রকাশ হতে দেখিনি। সরকারি দল বা জোটের কোনো নেতানেত্রীর বক্তব্য-বিবৃতিতেও শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কোনো প্রকল্পের কথা উল্লেখ হতে দেখিনি, শুনিনি। গত পরশু ৩১ আগস্ট একটি সহযোগী জাতীয় দৈনিকের শীর্ষ সংবাদ পাঠে জানা গেলÑ সরকার এরই মধ্যে একটি জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে। কোন পদ্ধতি-প্রক্রিয়ায় এই কৌশলপত্র প্রণীত হলো সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা হয়নি দেশের সাধারণ মানুষের। তবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ওই জাতীয় দৈনিক তথা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, ‘দুর্নীতি দমন ও সুশাসনের জন্য বহু আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। দুর্নীতিকে কেবল আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে দমন করা সম্ভব নয়। তাই সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ ও শুদ্ধাচারকে সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এ রূপরেখার আলোকে কাজ করা হবে।মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বক্তব্য অনুযায়ী উল্লিখিত কৌশলপত্র বা রূপরেখা অনুযায়ী শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য একটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ আসছে, সেই সাথে আসছে সেই লক্ষ্য অর্জনে একটি সামাজিক আন্দোলন। কারা হবেন এই সামাজিক আন্দোলনের সৈনিক? বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারি দলের নেতাকর্মীরাই হবেন এই সামাজিক আন্দোলনের মুখ্য নিয়ামক শক্তি। সেই সাথে সমাজের সাধারণ মানুষকে যদি তাদের এই শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে উৎসাহী করে তোলা যায়, তবে সাধারণ মানুষ হতে পারে তাদের সহায়ক শক্তি। এখানে আরেকটি বিষয় অপরিহার্যভাবে আসে, সরকারি দলের যেসব নেতাকর্মী এই শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার নিয়ামক শক্তি হবেন, তাদেরকে অবধারিতভাবে হতে হবে শুদ্ধাচারী। নইলে কী করে উল্লিখিত শুদ্ধাচার কৌশলপত্রে সূত্রায়িত কৌশল অনুসৃত শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলন সাফল্যের মুখ দেখবে? কিন্তু সরকারি দলের নেতাকর্মীদের কি এই শুদ্ধাচার আন্দোলনে পাওয়া যাবে? এরা তো বরাবরের মতো সরকারের শেষ সময়ে এসেও অন্য কাজে ব্যস্ত। একটি জায়মান উদাহরণে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। গত পরশু যেদিন কালের কণ্ঠে সরকারের এই শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার শুদ্ধাচার কৌশলপত্র প্রণয়নের খবর প্রকাশিত হলো, সে দিনের দৈনিক যুগান্তর জানালো সরকারি দলের লোকজন এ সরকারের শেষ সময়ে এখন বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই চাঁদাবাজি অভিযানে বিরোধী দলের কাউকে কাউকে সাথে রাখছেন চাঁদাবাজি নিরঙ্কুশ করে তোলার জন্য। পত্রিকাটি জানিয়েছে, সরকারের শেষ সময়ে এসে বিভিন্ন স্পটে চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। সড়কে বাঁশ ফেলে বিভিন্ন পয়েন্টে, বাস টার্মিনাল, ফেরিঘাটসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি পরিবহন থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা তোলা হচ্ছে। খোদ রাজধানীও এর বাইরে নয়। চাঁদার হারও বেড়ে গেছে। সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে চাঁদাবাজরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ব্যানারে সারা দেশে সার্ভিস চার্জের নামে প্রতিটি যানবাহন থেকে ৭০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হচ্ছে। আর এই সংগঠনের নেতা হচ্ছেন বর্তমান নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি জানিয়েছেন, এ টাকা তুলতে সরকারের কোনো অনুমোদন লাগে না। একে তিনি চাঁদা বলতে নারাজ, তার মতে এটি সার্ভিস চার্জ; কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, এ চাঁদার ভাগ সরকারের মন্ত্রী, এমপিসহ বিভিন্ন দলের কর্তা ব্যক্তিরাও পাচ্ছেন। পরিবহনে চাঁদাবাজির বিষয়ে সম্প্রতি রেলভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, চাঁদাবাজদের মধ্যে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিও রয়েছেন। এসব ব্যক্তির বাহুবল আছে। তাদের ছত্রছায়ায় চলছে চাঁদাবাজি। তাই বলছিলাম সরকারের শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনের শুদ্ধাচারী সৈনিক মিলবে কোথা থেকে? বলার অপেক্ষা রাখে না আলোচ্য শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার এই রাষ্ট্রিক ও সামাজিক আন্দোলনে থাকবেন বর্তমান মহাজোট সরকারের নেতানেত্রীরাই। আবারো প্রশ্ন, এসব নেতানেত্রী কি আমরা পাবো এই শুদ্ধাচারী আন্দোলনে? প্রশ্নটা এ জন্যই যে, বর্তমান সরকারের বিগত সাড়ে চার বছরের শাসন সময়ে আমরা কি এদের শুদ্ধাচার অনুশীলন করতে দেখেছি। বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের ওপর অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক দমনপীড়নে শুদ্ধাচারের বিন্দুমাত্র প্রদর্শন করতে পেরেছেন কি সরকারি দলের নেতকর্মীরা। দলবাজ পুলিশ দিয়ে রাজপথে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের পাখির মতো গুলি করে হতাহত করার মধ্যে কি শুদ্ধাচারের কোনো উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়? বিরোধী দলের অফিসে নেতাকর্মীদের ঢুকতে না দেয়া, তাদের যথেচ্ছা গ্রেফতার, হত্যা, খুন, গুম ও অপহরণের মহাযজ্ঞ পরিচালনা করার মধ্যে কি কোনো শুদ্ধাচার থাকতে পারে? এ ধরনের কর্মকাণ্ডে যে সরকার দুর্বিনীত, সে সরকারের মুখে যখন শোনা যায় শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে যাচ্ছে সরকার এবং এ জন্য জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্র রচনা করা হয়েছে; কিংবা সরকার এর রূপরেখা তৈরি করছে আর এখন থেকে সে রূপরেখা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে চলবে শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার সামাজিক আন্দোলন, তখন হাসি চেপে রাখা দায় হয়ে দাঁড়ায়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বললেন, ‘দুর্নীতি দমন ও সুশাসনের জন্য বহু আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। দুর্নীতিকে শুধু আইনি ব্যবস্থায় দমন করা সম্ভব নয়। তাই সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ ও শুদ্ধাচারকে সামাজিক আন্দোলন হিসেবে রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এ রূপরেখার আলোকে কাজ করা হবে।’Ñ তার এই বক্তব্য অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। প্রথমত তিনি বলেছেন, ‘দুর্নীতি দমন ও সুশাসনের জন্য বহু আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।আসলে কি তাই? আসল সত্যটা ভিন্ন। এ সত্যটি বেরিয়ে এসেছে গত ২৬ আগস্টের দৈনিক কালের কণ্ঠের এক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটির শিরোনামÑ ‘ক্ষমতার স্বার্থে বারবার আইন সংশোধন?’ এতে বলা হয়Ñ এ সরকারের আমলে দলীয় স্বার্থে বিভিন্ন আইন সংশোধন করা হয়েছে। সংবিধান থেকে শুরু করে তথ্যপ্রযুক্তি আইন, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, বার কাউন্সিল আইন সংশোধনের পেছনে সরকারের দলীয় স্বার্থ কাজ করেছে। বিভিন্ন মহলের অভিযোগÑ ক্ষমতায় টিকে থাকা, বিরোধী মতাদর্শের লোকজনকে হয়রানির হাতিয়ার হিসেবেও এসব সংশোধিত আইন ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। সরকারপক্ষ এ অভিযোগ খণ্ডন করবেন কিভাবে? সরকার ক্ষমতায় এসেই উচ্চ আদালতে বিচারাধীন দুটি রিট আবেদন নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে শুনানি হয়। রায়ও হয়। কয়েক দিনের মধ্যে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল নিয়ে করা মামলারও চূড়ান্ত শুনানি হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধানসংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করার আগেই সরকারি দল সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে সংবিধান সংশোধন করে। বিরোধী দলের সাথে কার্যত কোনো আলোচনা ছাড়াই সংবিধান সংশোধন বিল উত্থাপন করা হয় এবং তা পাস হয়। ফলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনব্যবস্থা ফিরে আসে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নির্দলীয় ত্তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হলেও অভিমত ছিল দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে সংসদ ইচ্ছা করলে অন্তত আরো দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে; কিন্তু তা গ্রাহ্য না করে বাতিল করা হয়। অভিযোগ ওঠে, ক্ষমতায় টিকে থাকতেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সংবিধান সংশোধন করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনী ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনে। বিশিষ্টজনেরা মনে করেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে নির্বাচন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অর্ন্তভুক্ত করা যেত; কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায় বলেই সে পথে যায়নি। এ দিকে গত ২১ আগস্ট তড়িঘড়ি করে অধ্যাদেশ জারি করে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে বিতর্কিত সংশোধনী আনা হয়। সংসদ আহ্বান করার পর অধ্যাদেশ জারির কোনো আইনগত যুক্তি না থাকলেও সরকার অধ্যাদেশ জারির এ আইনের সংশোধন করল। সুধী সমাজ, আইন বিশেষজ্ঞ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদেরা এ সংশোধনীর কঠোর সমালোচনা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ সাইট ব্যবহার করে যাতে কেউ সরকারবিরোধী প্রচারণা চালাতে না পারে, সে জন্যই এ সংশোধনী পুলিশকে সরাসরি মামলা করা ও পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া, কয়েকটি ধারা অজামিনযোগ্য করা এবং আমলযোগ্য হিসেবে গণ্য করার প্রস্তাব করায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনের অপব্যবহার নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। সংশোধিত আইনটি কার্যকর হলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আইনজীবীরা। এখানে দলীয় স্বার্থে এ আইনের তড়িঘড়ি সংশোধনের জোরালো অভিযোগ উঠেছে। যারা সংশোধিত এ আইনটির বিস্তারিত জেনেছেন, তারা এই অভিযোগের সাথে নিশ্চিত একমত হবেন। গত জুনে সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধন করেছে। এই সংশোধনী নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী বলে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। এর বিভিন্ন ধারা পাঠে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। এ লেখায় এর বিস্তারিত যাওয়ার অবকাশ নেই। গত ২১ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট-২০১২অধ্যাদেশ জারি করেন। এটি পরে আইনে পরিণতও হয়। বার কাউন্সিল আইনজীবীদের তালিকাভুক্ত করে থাকে। এজন্য পাঁচ সদস্যের একটি নিয়োগ বা এনরোলমেন্ট কমিটি গঠনের জন্য আইন সংশোধন করা হয়। সংশোধিত আইনে বলা হয়, নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান হবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারক। এ ছাড়া হাইকোর্ট বিভাগের দুজন বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল ও বার কাউন্সিলের একজন সদস্য হিসেবে থাকবেন। তাদের মধ্যে হাইকোর্টের দুই বিচারকও মনোনীত হবেন প্রধান বিচারপতির মাধ্যমে। বার কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল পদাধিকার বলে এই কমিটিতে আসবেন। এ ছাড়া বার কাউন্সিল অন্য একজন সদস্যকে এই এনরোলমেন্ট কমিটির জন্য মনোনীত করবে। আগের আইনে বার কাউন্সিলের নিয়োগ কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল তিন। তাদের মধ্যে একজন বিচারক এবং বাকিরা বার কাউন্সিলের মনোনীত সদস্য। কমিটিকে আরো শক্তিশালী করতে আইন সংশোধন করা হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও ওই বছর বার কাউন্সিল নির্বাচনে ১৪টি আসনের মধ্যে ১৩ আসনে বিএনপিসহ জোট নেতারা জয় লাভ করায় সরকার নিজেদের স্বার্থে এই আইন সংশোধন করে। এভাবে সরকার একের পর এক আইন সংশোধন করেছে শুধু দলীয় সঙ্কীর্ণ স্বার্থচিন্তা মাথায় রেখে। দলীয় স্বার্থে এভাবে যথেচ্ছাচারভাবে আইন সংশোধন নিশ্চয়ই কোনো শুদ্ধাচার নয়; শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কোনো লক্ষ্যও এখানে কাজ করেনি। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কথায় বোঝা গেল দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এ সরকার নানা আইন করে এ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। তাই এখন সরকার সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শুদ্ধাচারকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিয়ে দেশে দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে এই শুদ্ধাচার রূপকল্প প্রণয়ন করেছে। এই সাড়ে চার বছর যারা দুর্নীতি করেছেন, তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে তাদের দিয়ে আর যাই হোক শুদ্ধাচার আন্দোলন সম্ভব নয়, শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়াও সম্ভব নয়। কারণ এ দেশের মানুষ দেখেছে, এ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে প্রবাদসম নানা দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার ব্যাপারে। এসব কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার ব্যাপারে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের নাম বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। মন্ত্রী-উপদেষ্টারাও এ অভিযোগ থেকে বাদ পড়েননি। হলমার্ক, ডেসটিনি ও সরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিসহ রেলওয়ে নিয়োগবাণিজ্য কেলেঙ্কারির হোতাদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আড়াল করে রেখে কী করে শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখে এ সরকার? কী করে ভিন্নমত দমনের নামে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আঘাত হেনে সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল বন্ধ করে প্রতিবাদী সাংবাদিকের ওপর নিপীড়ন নির্যাতন অব্যাহত রেখে শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কথা উচ্চারণ করে সরকারের লোকজন? সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে সংবাদপত্রের ওপর বিষোদগার করে কী করে শুদ্ধ বাংলাদেশ বাস্তবায়ন হতে পারে? কী করে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর মামলা-হামলা জারি রেখে বিপরীতক্রমে রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করে এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড ও জেল-জরিমানা রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে মওকুফ করিয়ে দিয়ে শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হতে পারে? এ ধরনের নানা প্রশ্ন জনমনে জাগা খুবই স্বাভাবিক। দেশের সাধারণ মানুষ মনে করে, সরকার যদি সত্যি সত্যিই কোনো শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে একান্ত আগ্রহী হয়, তবে সবার আগে সেই শুদ্ধাচার অনুশীলনের বাস্তব প্রক্রিয়াটি শুরু করতে হবে সরকারপক্ষ থেকেই। প্রথমেই শুদ্ধাচার অনুশীলন করতে হবে সরকারি দলের নেতাকর্মীদেরকে। মন্ত্রী-এমপিদেরকে। সরকার যদি এমনটি করে জনগণকে দেখাতে পারে, জনগণ যদি বিশ্বাস করে এমনটি ঘটছে, কেবল তখনই নামা সম্ভব শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কোনো আন্দোলনে। নইলে এ ধরনের জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্র শুধু হাসির খোরাকই হবে। সবশেষে আরেকটি কথা। বর্তমান সরকারের নেতাকর্মীরা একধরনের ইন্ডিভিজুয়ালিজমে বা ব্যক্তিবাদে ভুগছেন। এই ইন্ডিভিজুয়ালিজম একধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শনগত তত্ত্ববিশেষ। এই তত্ত্ব মতে, ইন্ডিভিজুয়ালিস্ট বা ব্যক্তিবাদীরা নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থকে সব কিছুর ওপরে স্থান দিয়ে তাদের আচরণ-কৌশল নির্ধারণ করেন। ফলে সেখানে আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা ও ব্যক্তিতান্ত্রিকতা প্রতিষ্ঠা পায়। কারণ ব্যক্তিবাদীদের কাছে রাষ্ট্রের আধিপত্যের চেয়ে ব্যক্তির কর্মতৎপরতা ও ইচ্ছা-অনিচ্ছা বেশি গুরুত্ব পায়। তাই বলছি, যত দিন দেশের সরকারি দল-জোটের নেতাকর্মীরা নিজেদের এই ইন্ডিভিজুয়ালিজম থেকে মুক্ত না করতে পারবেন, তত দিন শুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন আমাদের অপূর্ণই থেকে যাবে।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads