রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সরকারের বৈধতা প্রসঙ্গে


আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সংবিধানে সে দেশকে বলা হয়েছে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (Sovereign Democratic Republic)কিন্তু আমরা আমাদের দেশকে সংবিধানে উল্লেখ করেছি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ (People’s Republic of Bangladesh) হিসেবে। কিন্তু গণপ্রজাতন্ত্রী কথাটার অর্থ মোটেও স্বচ্ছ নয় আমাদের কাছে। যত দূর জানি, চীনের বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা মাও জে ডং শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন চীনা ভাষায় তার সরকারের কাঠামো বর্ণনা করতে যেয়ে। অন্যান্য কমিউনিস্টের মতো মাও জে ডং বহুদলীয় উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না। চীন বাজার অর্থনীতি গ্রহণ করলেও এখনো সেখানে চলেছে একদলীয় শাসন। জানি না, যদি কোনো ব্যক্তি গণপ্রজাতন্ত্রের ব্যাখ্যা চেয়ে আমাদের সর্বোচ্চ আদালতে রিট করেন, তবে বিচারযোগ্য বলে গৃহীত হবে কি না এবং বিজ্ঞ বিচারকেরা এ ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা দিতে প্রয়াসী হবেন কি না। আমাদের সংবিধান আমার কাছে যথেষ্ট গোলমেলে মনে হয়। সংবিধানে বলা হয়েছে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়তে হবে। কিন্তু সংবিধানে কি সমাজতন্ত্র কথাটা আদৌ আসা উচিত। কারণ এটা এখনো হয়ে আছে একটি বিশেষ মতবাদ। আর সেটা সবার কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়। অনেকের মতে সমাজতন্ত্র একটা দেশের অর্থনৈতিক উৎপাদন শেষ পর্যন্ত কমিয়ে দেয়। কমিয়ে দেয় মানুষের আত্মনির্ভরশীলতাকে। বিরাট শক্তিধর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর, এখন আর বিষয়টি আগের মতো বিতর্কমূলক হয়ে নেই। আর চীনে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় থাকলেও সে অনুসরণ করতে চাচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতিকেই। কিন্তু আমাদের দেশের সংবিধানের এই দুর্বলতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছেন না। আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইনটিকে বলা হলো সর্বতোভাবেই সংবিধানবিরোধী। আর তাই আইনটি পুরোপুরি বাতিল হয়ে গেল। তাকে সংশোধনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হলো না। যদিও সংবিধান অনুসারে আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয়, আইনটিকে সংশোধন করে সংবিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করার সুযোগ অনেকটাই ছিল। এখন প্রশ্ন যেটা দেখা দিচ্ছে আমাদের মনে, তা হলো, ২০০৮ সালের নির্বাচন হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসাংবিধানিক হলে, তার অধীনে নির্বাচিত বর্তমান সরকারকে বৈধ বলা সঙ্গত নয়। বলা উচিত বর্তমান সরকার অবৈধ। কারণ সে বৈধভাবে নির্বাচিত হয়নি। তবে রোমান আইনে বলে, যা হওয়া উচিত ছিল না, তা যদি বাস্তবে ঘটে গিয়ে থাকে, তবে সেই বাস্তবতাকে বৈধ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে : Factum valet quod fieri non debuit ্এ থেকেই আইনে এসেছে প্রয়োজনের স্বীকৃতি দেয়ার ধারণা। যাকে ইংরজিতে বলে Doctrine of necessityএই ধারণার ওপর নির্ভর করে সাবেক পাকিস্তানের বিখ্যাত বিচারপতি জাস্টিজ মুনির জেনারেল আইয়ুবের ক্ষমতা দখলকে প্রদান করেছিলেন আইনি বৈধতা। পরে আবার অবশ্য তিনি বলেছিলেন, বিচারটি তার ঠিক যথাযথ হয়েছিল না। বিচারপতিরা অনেক সময় ভুলও করতে পারেন। কারণ তারাও মানুষ। আর প্রাণের ভয় প্রচ্ছন্নভাবে তাদের মধ্যেও থাকতে পারে ক্রিয়াশীল। ছাত্রপাঠ্য বইতে সংবিধানকে দুভাগে ভাগ করে আলোচনা করা হয়। অলিখিত ও লিখিত। অলিখিত সংবিধানের দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয় ইংল্যান্ডের কথা। ইংল্যান্ডে কেউ কখনো পৃথকভাবে সংবিধান রচনা করার চেষ্টা করেননি। তবে ইংল্যান্ডের আছে কতকগুলো সুনির্দিষ্ট আইন, যা ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ভিত্তি। অর্থাৎ ব্রিটেনের কোনো লিখিত সংবিধান না থাকলেও আছে লিখিত আইন। তার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রিক কাঠামো কেবলই অলিখিত প্রথানির্ভর নয়। অন্য দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান হলো লিখিত সংবিধানের দৃষ্টান্ত। কিন্তু এরও আবার আছে অলিখিত বিধিবিধান। যেমন, মার্কিন সংবিধানে রাজনৈতিক দলের কোনো স্বীকৃতি নেই। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক দল। সে দেশে চলেছে কার্যত দ্বিদলীয় গণতন্ত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে কোনো মন্ত্রিসভা গঠনের বিধান নেই। অথচ সে দেশের সরকারের বিভিন্ন প্রধান কর্মসচিব (Secretaries)প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত মন্ত্রিসভার মতোই কাজ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানে লেখা না থাকলেও গড়ে উঠেছে কংগ্রেসের বিভিন্ন বিষয়ে কমিটি গঠন প্রথা। যেসব কমিটি সে দেশে পালন করছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আমাদের দেশেও এ রকম আইনের বাধ্যবাধকতামুক্ত (Extra legal) পদ্ধতিতে অনেক প্রয়োজনীয় বিধান গড়ে উঠতে পারে। সংবিধানের নামে যাদের বাতিল করতে গেলে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাবে না আমাদের আইনি চিন্তা-চেতনা, যা ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক জীবনের জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট এক সময় বলেছিলেন, শ্রমিকদের ইউনিয়ন গড়ার এবং মজুরি বৃদ্ধির জন্য ধর্মঘট করার অধিকার মার্কিন সংবিধানের পরিপন্থী। পরে আবার সুপ্রিম কোর্টের নতুন বিচারপতির দল বলেন, মার্কিন সংবিধানে আছে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বীকৃতি। তাই থাকতে পারে স্বাধীন মানুষ হিসেবে শ্রমিকদের ইউনিয়ন গড়ার অধিকার। এবং মজুরি বৃদ্ধির জন্য থাকতে পারে ধর্মঘটের অধিকার। যেমন থাকতে পারে, মালিক পক্ষের বাছাই করে শ্রমিক নিযুক্ত করার এবং লোকসান হলে কলকারখানা বন্ধ করে দেয়ার অধিকার। যদিও এর জন্য কর্মসংস্থান হারাতে পারেন বহু শ্রমজীবী মানুষ। অর্থাৎ একই সংবিধানের ব্যাখ্যা সুপ্রিম কোর্ট ভিন্ন সময়ে দিতে পারেন ভিন্নভাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এরও নজির আছে। সংবিধানের ব্যাখ্যা হতে পারে অনেক রকম। সুপ্রিম কোর্টের একদল বিচারক বাতিল করতে পারেন, আর একদল বিচারকের সংবিধান ভাষ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের কথা বিশেষভাবে মনে আসছে, কারণ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বসবাস করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু মার্কিন গণতান্ত্রিক চেতনা তাকে খুব একটা প্রভাবিত করতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে না। মার্কিন গণতন্ত্রের ইতিহাস অনুশীলন করলে আমরা দেখি, জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৩২-১৭৯৯) সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ করে দেশটাকে স্বাধীন করেছিলেন। তার ওপর ছিল তার দেশবাসীর গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তিনি পরপর দুইবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হন। কিন্তু ইচ্ছা করেই তিনি আর তৃতীয়বার নির্বাচনে প্রার্থী হন না। বলেন, তিনি চান না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজা হতে। কেবল মার্কিন সংবিধান নয়, মার্কিন এই গণতান্ত্রিক চেতনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করেছে। এক সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিক (জন্মগত) একাধিকবার প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন। কোনো আইনগত বাধা ছিল না এ ক্ষেত্রে। কিন্তু কোনো প্রেসিডেন্টই দুবারের বেশি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাননি। কেবল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্ট (১৮৮২-১৯৪৫) পরপর তিনবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইন প্রণীত হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যোগ্যতা থাকলেও দুইবারের বেশি (আট বছরের বেশি) মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। এভাবে আইন করা হয়েছে এই ভেবে যে, কেউ যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে না নিতে পারেন। তাকে ঘিরে গড়ে উঠতে না পারে কোনো কায়েমি স্বার্থ গোষ্ঠী। আমাদের দেশে আমরাও অনুসরণ করতে চেয়েছি ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রকে। ব্রিটেনে দেশ শাসন করে কেবিনেট। ক্যাবলই প্রধানমন্ত্রী নন। কিন্তু আমাদের দেশে এখন প্রতিষ্ঠা পেতে পেরেছে প্রধানমন্ত্রীর শাসন। তাই আইন থাকা উচিত, কেউ দুইবারের বেশি (১০ বছর) হতে পারবেন না বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আপাতত এর কোনো আইন করার চিন্তা ভাবনা হচ্ছে বলে মনে হয় না। সজীব ওয়াজেদ জয় যদি মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণ করে থাকেন তখন প্রশ্ন উঠবে। বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘তিনি (বাংলাদেশের কোনো নাগরিক) যদি কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন, তবে বাংলাদেশের সংসদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা হারাবেন।জয়ের কথা শুনে মনে হচ্ছে, তিনি আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের সংবিধান অনুসারে তিনি কি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পেতে পারবেন? আমরা জানি না। হয়তো প্রধানমন্ত্রীর পুত্র হিসেবে তিনি পেতে পারেন বিশেষ বিবেচনা। আমি যত দূর জানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন বলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নাগরিক যদি অন্য কোনো রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য দেখান, তবে তিনি হারাবেন তার মার্কিন নাগরিকত্ব। আমি জীবনে আইন পড়িনি। সংবিধান বিশেষজ্ঞও নই। তবে নিজের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য নানা দেশের রাজনীতির ইতিহাস কিছু কিছু পড়েছি। তা থেকে আমার মনে হয়েছে, কেবল আদালতের নির্দেশে একটা দেশের রাজনীতি পরিচালিত হতে পারে না। রাজনীতির গোড়ার কথা হলো, কে আমাকে শাসন করবে এবং কেন আমি তার শাসন মেনে নেব। কোনো ব্যক্তি যদি এমন কিছু করেন যাতে গণ-অসন্তোষ বাড়ে, তাহলে তিনি শেষ পর্যন্ত আর পারেন না ক্ষমতায় থাকতে। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads