রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

জাতীয় অর্থনীতির রক্তক্ষরণ


রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ব্যবস্থাপনায় চরম অনিয়ম ও দুর্নীতি, হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির ফলে ব্যাংকিং খাতে মূলধন সঙ্কট, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, যুবক, ইউনি পে টু ও ডেসটিনির মালটিলেভেল মার্কেটিং ব্যবসার নামে প্রতারণার ফাঁদ এবং শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি যা এখনো চলছেÑ এসব কারণে বাংলাদেশ প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিগত ৪২ বছরেও এত ক্ষতি হয়নি যা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের পৌনে পাঁচ বছরে শাসনামলে হয়েছে। দেশ বিদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের গবেষণালব্ধ লেখায় এসব আর্থিক দুর্নীতির চিত্র ফুটে উঠেছে। । পণ্ডিত ব্যক্তিরা রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের দূরদর্শিতার অভাব অর্থাৎ রাজনৈতিক সমঝোতার অভাবকে দায়ী করছেন। দেশ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান এবং সমঝোতার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার। এটা বিগত পৌনে পাঁচ বছরে না থাকার কারণে দেশ অর্থনৈতিকভাবে বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হলো। জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলছে, যেকোনো রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা হিসেবে কমপক্ষে ৬০ দিনের খাদ্য মজুদ থাকা প্রয়োজন। সে হিসেবে বাংলাদেশের খাদ্য মজুদ প্রয়োজন ২৭ লাখ ৬০ হাজার টন খাদ্য। অথচ গুদামে মজুদ মাত্র ২২ দিনের খাবার। দেশের মোট জনসংখ্যার এক দিনের খাদ্য চাহিদা প্রায় ৪৬ হাজার টন। এক মাসে প্রয়োজন ১৩ লাখ ৮০ হাজার টন। খাদ্য অধিদফতরের সর্বশেষ খাদ্যমজুদ আছে মাত্র ১০ লাখ ৯১ হাজার ৮৪ টন। দেশের জন্য এটা একটি বড় ঝুঁকি। কৃষকদের অবস্থা এখন ভালো নয়। কারণ চার টাকার সার এখন ২০ টাকা। গত অর্থবছরে সরকার ৪২ লাখ টন খাদ্য আমদানি করেছে। প্রশ্ন থেকে যায়, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে খাদ্য আমদানি করতে হবে কেন? খাদ্যে যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় তাহলে কি আমদানির নামে এই টাকা লুট করা হয়েছে? বিলবোর্ডের ৬০ কোটি টাকার উৎস জনগণ জানতে চায়। ৪ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে লিড নিউজ প্রকাশিত হয়েছেÑ বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচার দেশটির অর্থনীতির টুঁটি চেপে ধরেছে।যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন ছিল এটি। ৪ আগস্ট আরেকটি দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠার হেডলাইন ছিলÑ দূষিত রাজনীতি বিশৃঙ্খল ব্যাংক ব্যবস্থা, আইনশৃৃঙ্খলার অবনতি, বিনিয়োগবিনাশী বার্তা দেশ বিদেশে পৌঁছে যাচ্ছে। ৩ আগস্ট দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল লিখেছে, বিদায়ী অর্থবছরে আমদানি কমেছে। ফলে বিনিয়োগ পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। ১২-১৩ অর্থবছরে জুলাই-জুন পর্যন্ত পণ্য আমদানির জন্য তিন হাজার ৫৮৪ কোটি ৯৬ লাখ ডলার ঋণপত্র খোলা হয়, যা গত অর্থবছরের (১১-১২) একই সময়ে ছিল তিন হাজার ৬৯২ কোটি ৬১ লাখ ডলার। আমদানির হার কমেছে ২ দশমিক ৯২ শতাংশ। এক বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ দরে তালিকাভুক্ত ১১টি ব্যাংক। প্রিমিয়ার ব্যাংকের শেয়ারের বাজারদর নেমে এসেছে ১০ টাকায়, যা ব্যাংকটির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের সমান। এ ছাড়া ৪ আগস্ট দরপতনে অভিহিত মূল্যের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে আরো ১০টি ব্যাংকের বাজারদর । শেয়ারবাজারে ব্যাংকের অবস্থা এতই শোচনীয় যে, পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও বেসরকারি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর মোহাম্মদ মুসা প্রথম আলোকে বলেছেনÑ অনেক ব্যাংকের শেয়ারের দাম ৪ আগস্ট দিন শেষে যেখানে নেমে এসেছে তা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œব্যাংক খাতের শেয়ারের দামে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। এর মূল কারণ, ব্যাংকের দুর্নীতি ও ব্যবসায়িক মন্দা এবং ঋণ জালিয়াতি। সম্প্রতি বেসিক ব্যাংকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি ঘটেছে। ব্যাংকিং খাতের কুঋণের যে অবস্থা, তাতে নিকট ভবিষ্যতে আয় বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ব্যাংক খাতে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তাই এ খাতের অনেক শেয়ারের দাম অবমূল্যায়িত পর্যায়ে নেমে এসেছে। ডিএসইর সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী বলেছেন, হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংকের দাম মাঝে কয়েকবার অভিহিত মূল্যের নিচে থাকলেও গত ১০ বছরের মধ্যে এতটা নিচে আর কখনো নামেনি। দুই বছর আগেও ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড (এনবিএল) শেয়ারহোল্ডারদের ৯০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড দিয়েছিল। অথচ ২০১২ সালে এসে ডিভিডেন্ডের পরিমাণ এতই কমে গেছে যা অবিশ্বাস্য। মাত্র ৬ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে শেয়ারহোল্ডারদের। বেসরকারি সব ব্যাংকের ডিভিডেন্ড গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১২ সালে (বিগত অর্থবছর) সবচেয়ে কম ছিল। কিছু ব্যাংক মুনাফার লভ্যাংশ শেয়ারহোল্ডারদের দিতে পারেনি। এমনকি এজিএমে কিছু ব্যাংক কোনো গিফটও দেয়নি শেয়ারহোল্ডারদের। শেয়ারবাজারে ব্যাংকিং খাতে এমন করুণ অবস্থা স্বাধীনতার পর আর কখনো দেখা যায়নি। মুনাফা কমেছে ২১ ব্যাংকের। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ২৯টি ব্যাংকের মধ্যে ২১টির নিট মুনাফা কমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে প্রিমিয়ার ব্যাংকের। লোকসানে রয়েছে তিনটি ব্যাংক। চলতি বছরের ছয় মাসে প্রিমিয়ার ব্যাংকের লোকসান দাঁড়িয়েছে ১৯৯ কোটি ৭৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা। অথচ ওই ব্যাংক আগের বছর একই সময়ে মুনাফা করে ছিল ১১ কোটি ৫৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ন্যাশনাল ব্যাংকের ছয় মাসে লোকসান হয়েছে ১৮৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অথচ এর আগের বছর একই সময়ে মুনাফার পরিমাণ ছিল ১৩৯ কোটি ৩৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ব্যাংকটির লোকসান হয়েছে ১৭২ কোটি ৪৬ লাখ ২০ হাজার টাকা। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের মুনাফা কমেছে ৯১ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম দিকে যমুনা ব্যাংকের মুনাফা কমেছে ৮৭ শতাংশ। দেশের বৃহত্তর আর্থিক খাতকে যদি এই দুর্ভোগে পড়তে হয়Ñ তাহলে অর্থনীতির অবস্থা যে খারাপ এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সরকার বিলবোর্ডে যে আর্থিক বিবরণ দেখিয়েছে তার সাথে বাস্তবের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান মেলে না। বিদায়ী অর্থবছরে সরকার ব্যাংক ঋণ নিয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এই ঋণ মূল বাজেটে নেয়া লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরের শেষ মাসে বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার। প্রথম ১১ মাসে ব্যাংকব্যবস্থায় সরকারের নিট ঋণ ছিল ১২ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা। এক মাসের ব্যবধানে ৩০ জুন এসে সেই ঋণ দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। এসব কারণে ব্যাংকগুলো মূলধন সঙ্কটে পড়েছে বিধায় লভ্যাংশে আঘাত হেনেছে। এসব ঋণ নিয়ে সরকার কী উন্নয়ন করেছে তার ফিরিস্তি পাওয়া যায়নি। বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসের হিসাবে উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশের সার্বিক উন্নয়নের সর্বশেষ পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, প্রথম ১১ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মোট ৬৭ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরের উন্নয়নকাজ বাস্তবায়নের এই হার গত তিনটি অর্থবছরের তুলনায় কম। বিগত অর্থবছরের (২০১২-১৩) অবশিষ্ট এক মাসেই ৩৩ শতাংশ উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা এও বলেছেন, অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসের পরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাস্তবায়নের হার এ সরকারের আমলে সর্বনি¤œপরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড: শামসুল আলম বলেছেন, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য পরিকল্পনা করেই এডিপ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু পরিকল্পনাতেও কিছু ফাঁক থাকে, যে কারণে শতভাগ উন্নয়ন বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক জটিল পরিস্থিতির কারণে দেশের সার্বিক বিনিয়োগ পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। শুধু জুলাই মাসেই রাজধানী ঢাকায় রাজনৈতিক খুন হয়েছে ২৬ জন। কোনো কোনো বড় রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্ব আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দখলে। এ তথ্য সত্য হলে বলা যায়, দেশে আইনের শাসন বলতে যা বুঝায় সেটা এখন নেই। দেশী বিদেশী বিনিয়োগ অনেক কমে গেছে। শিল্প ও বাণিজ্য কেন্দ্রে মোটা অংকের চাঁদাবাজি বিনিয়োগ কমার আরেকটি বড় কারণ। রাজনৈতিক বিবেচনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রণীত, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ সঙ্কুচিত করেছে। এর ফলে সার্বিক ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পরিবর্তে কর্মসঙ্কোচনের আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে স্বাভাবিক মুদ্রাপ্রবাহও বাধাগ্রস্ত হবে। নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করতে না পারলে নতুন কর্মসংস্থান ও জাতীয় প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে না। ক্যাপিটাল মার্কেটে একশ্রেণীর আপার লেভেলের জুয়া সংগঠকদের বিতাড়িত করতে সরকার ব্যর্থ হলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়বে না। চরম তারল্য সঙ্কটে ভুগবে দেশের পুঁজিবাজার। যে অস্থিরতা বিগত চার বছর ধরে চলছে, তারও অবসান ঘটবে না। সেখানে পুঁজিবাজার যদি স্থিতিশীল বাজারে পরিণত হতো তাহলে শিল্প বাণিজ্যেরও ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটত। শিল্প বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো পুঁজিবাজার থেকেই পুঁজি সংগ্রহ করে। ৩৩ লাখ ুদ্র বিনিয়োগকারীর পুঁজি হারানোর বেদনায় তাদের হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ সৃষ্টি হয়েছে সে ব্যাপারে সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কয়েকজন আত্মহত্যা করেছেন। অনেকে পুঁজি হারানোর বেদনায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন। মানসিক বৈকল্য দেখা দিয়েছে অনেকের। এমএলএম ব্যবসায়ের প্রতারকেরা কয়েক হাজার কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে আত্মসাৎ করলে ক্ষতিপূরণ দেয়নি এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থাও করেনি সরকার। সরকারের নাকের ডগার ওপর দিয়ে এত মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেছে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে। সেটা সরকার দেখেও না দেখার ভান করেছে। সচেতন জনগোষ্ঠী মনে করে, উচ্চমহলের সংশ্লিষ্টতা থাকার কারণে বিষয়টির সুরাহা হচ্ছে না। দেশের সড়কপথে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের চেয়ে দামি প্রাইভেট কারের চলাচল বৃদ্ধির মূল কারণ হলো অবৈধ টাকা উপার্জন। পুনরায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড রাজস্ব ঘাটতির আশঙ্কা নিয়ে চলতি অর্থবছর (২০১৩-১৪) শুরু করল। তিনটি কারণে এই শঙ্কা আরো বাড়ছে। প্রথমত, অর্থনীতির গতিশীলতা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় মন্থর হতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির কারণে ভিত্তি ছোট হয়েছে। এর ফলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আরো বেড়েছে। আগের বছরের চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে এবার। তৃতীয়ত, সংশোধিত অর্থবিলে করের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেয়া হয়েছে। কীভাবে তা সমন্বয় করা হবে, সেই পরিকল্পনা স্পষ্ট নয়। এনবিআরের বর্তমান প্রশাসন দিয়ে রাজস্ব আদায়ের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। চলতি অর্থবছরে বিদায়ী বছরের তুলনায় এডিপির কর্মসূচির আকার বেড়েছে ১৮ শতাংশের মতো। এই এডিপি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অনেক বেশি হারে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। এখানেও রয়েছে কিছু অসঙ্গতি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাকে উচ্চাভিলাষী বলে উল্লেখ করেছেন খোদ এনবিআরের চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন। তিনি বলেছেন, করবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য তিনটি বিষয়ের প্রতি নজর দিতে হবে। প্রথমত, রাজস্ব প্রদানে সেবাগুলো নিশ্চিত করা, দ্বিতীয়ত, অনুকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং তৃতীয়ত, আইনকানুন সময়োপযোগী করা। সামনে রাজনৈতিক কর্মসূচি যাতে রাজস্ব আদায়ে বাধা না হয়ে দাঁড়ায় সেজন্য দুটি বড় দলের মধ্যে সমঝোতার প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন। চলতি অর্থবছরের (২০১৩-১৪) মূসক খাতে ৪৯ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা এবং আয়কর ৪৮ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকাসহ মোট ৯৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেভাবে টালমাটাল হয়ে উঠছে তাতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। রাজস্ব আদায় যথানিয়মে না হলে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে। ফলে ব্যাংকের ওপর চাপ বাড়বে ঋণ গ্রহণের কারণে। নতুন অর্থবছরে তাই নানা শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, দেশে পাঁচ কোটি মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। বছরে ২০ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের পথে পা বাড়াচ্ছে। সে হিসাবে তেমন কর্মসংস্থান গড়ে ওঠেনি। মানুষ কর্মহীন হলে অনৈতিক কাজ করে এবং অবৈধ পথে আয়ের প্রচেষ্টা চালায় টেন্ডারবাজি, কোটি টাকার ফুটপাথ বাণিজ্য, দখলবাণিজ্য এসব বাড়তে থাকে। ফলে জনজীবনে নানা দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। ব্যাংক, বীমা, চামড়া, চিনি, পাট, সুতা ও কাগজসহ সেক্টর করপোরেশনগুলো দিন দিন রুগ্ণ হয়ে পড়ছে। পাটকলগুলোও বন্ধ বা রুগ্ণ হয়ে যাচ্ছে। বৈদেশিক বাণিজ্যে সমতা নেই বহু আগে থেকেই। বাংলাদেশকে নিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। ৪২ বছর পর আমাদের মাথাপিছু গড় আয় মাত্র ৯২০ ইউএস ডলার। স্বাধীনতার আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে মাথাপিছু গড় আয় যাদের কম ছিল, অর্থাৎ ১০০ থেকে ২০০ ডলার ছিল, তাদের গড় আয় কারো কারো এখন তিন থেকে পাঁচ হাজার ডলারের মধ্যে ওঠানামা করছে। উদ্ভাবনশীলতা সূচকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ১৮ ধাপ নিচে নেমে গেছে। বাংলাদেশ এখন ১৪২টি দেশের মধ্যে ১৩০তম। এক বছরে ১৮ ধাপ অবনতি হয়েছে। জ্ঞান, চিন্তা, সংগঠন ও সম্পদ বিকাশে উদ্ভাবনশীলতা বৃদ্ধির জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সবকিছুরই অভাব রয়েছে এ দেশে। এখানে মানবসম্পদ উন্নয়নবলতে শুধু কায়িক দক্ষতা ও প্রাথমিক জ্ঞানার্জনকে বোঝায়। বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বোঝায় না। বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণায় ব্যয় না থাকার কারণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে এখনো পেছনে পড়ে আছে। বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা যেখানে বিদেশের মাটিতে তাক লাগানো উদ্ভাবনার জন্য পুরস্কৃত হচ্ছেন, সেখানে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার কারণটি যে রাজনৈতিক, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। উদ্ভাবনার বিবেচনায় বাংলাদেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের চেয়েও পেছনে। জাতীয় আয়ের বিবেচনায় বাংলাদেশ শিক্ষা ব্যয়ে অনেক পেছনে অর্থাৎ ১০৮তম। (তথ্যসূত্র : আন্তর্জাতিক গ্লোবাল ইনভেনশন ইনডেক্স বা জিআইআইয়ের বিশ্বব্যাপী সমীক্ষা।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads