বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

গণতন্ত্রের অপমৃত্যু এবং মার্চ ফর ডেমোক্রেসি


২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’র ডাক দিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনী প্রহসনকে ‘না’ বলতে ঐতিহাসিক এই অভিযাত্রায় দল-মত-শ্রেণী-পেশা-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে লাল সবুজের জাতীয় পতাকা হাতে ঢাকায় আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। সরকারকে জেদ পরিহার করে সমঝোতায় আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের হাতে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে, আর বর্তমান নির্বাচন কমিশন হলো গণতন্ত্র বিনাশের দোসর। লক্ষণীয় বিষয় হলো খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যের সাথে ১৮ দলীয় জোটের বাইরের লোকজন এবং সিভিল সোসাইটির প্রাজ্ঞজনরাও দ্বিমত পোষণ করছেন না। তারপরও দেশে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটিয়ে জাতিকে এক অন্ধকার গহ্বরে ঠেলে দিচ্ছে মহাজোট সরকার। কোনো যুক্তি ও বিবেচনা কাজ করছে না তাদের মধ্যে, শুধুই লক্ষ্য করা যাচ্ছে অহংকার ও একগুঁয়েমির জঙ্গি চেতনা। কোনো সুস্থ ব্যক্তি বা দলতো এমন চেতনা লালন করতে পারে না, তাহলে কি বিশেষ কোনো কারণে এমন চেতনা আঁকড়ে থাকতে তারা বাধ্য হচ্ছেন? ভাবতে অবাক লাগে, স্বাধীনতার ৪২ বছরে এসে গণতান্ত্রিক চেতনায় একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আকাক্সক্ষায় জাতিকে মাথাকুটে মরতে হচ্ছে!
আমরা জানি, স্বাধীনতা অর্জনের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্বাধীনতা রক্ষা ও স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে সফল হওয়া। বর্তমান সময়ে অনেক নেতা-নেত্রীকেই স্বাধীনতার চেতনার কথা উচ্চারণ করতে দেখা যায়। কিন্তু তাদের অনেকের আচরণই স্বাধীনতার চেতনা তথা গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সুবিচার ও মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার অনুকূলে যায় না। এমন কি জাতির স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়ার যে রাজনীতি শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়াউর রহমান জাতির সম্ভাবনাকে বাস্তবে ফলপ্রসূ করার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার বিপরীতে চলতেই যেন তারা এখন আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তাদের হিংসা-বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা এবং রাজনৈতিক অনাচারের কারণে এক মাহা দুর্যোগের কবলে পতিত হয়েছে পুরো জাতি। তাই এমন নব্য-নেতাদের প্রহসন ও চাতুর্যপূর্ণ রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে দেশের মানুষ। গণমানুষের উপলব্ধিকে যদি ঐসব রাজনীতিবিদরা কিছুমাত্র গুরুত্ব দেন, তাহলে হয়তো দেশের রাজনীতি সঠিক রোডম্যাপে চলা শুরু করতে পারে।
উপলব্ধির দিন তো ফুরিয়ে এলো। কিন্তু সরকার কি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনী প্রহসন থেকে মুখ ফেরাবে? নির্বাচন কমিশন কি তার দায়িত্ব উপলব্ধি করবে? এসব ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক আচরণ লক্ষ্য করা না গেলে হয়তো বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যই সত্য প্রমাণিত হবে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের হাতে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে, আর নির্বাচন কমিশন গণতন্ত্র বিনাশের কাজে দোসরের ভূমিকা পালন করছে। সরকার ও নির্বাচন কমিশন যে পরস্পরের দোসর হিসেবে কাজ করছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল সরকারী দলের নেতাদের ফুলেফেঁপে ওঠা সম্পদের তথ্য লুকোচুরির ঘটনায়। ফলে পত্রিকায় শিরোনাম হলো; সম্পদ আ’লীগের, লুকোচুরি ইসির’, ‘সম্পদের তথ্য লুকানোর উপায় খুঁজছে ইসি’, ‘হলফনামার তথ্য লুকিয়ে ফেললো ইসি’। পুরো জতি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলো, আমাদের ইসি তথা নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা। উল্লেখ্য যে, হলফনামা আকারে নির্বাচনী প্রার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ঐ নির্দেশনার কারণে সম্পদের বিবরণ দিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। ঐ বিবরণ যথারীতি ওয়েব সাইটে প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতাদের নির্বাচনী হলফনামায় দেয়া অঢেল সম্পদের বিবরণে বিস্মিত হয় দেশের জনগণ। এতে বিব্রত অবস্থায় পড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের নেতারা সম্পদের যে বিবরণ দিয়েছিলেন, তা ক্ষমতার ৫ বছরে অবাক হওয়ার মতো বেড়ে গেছে। কারো কারো সম্পদের পরিমাণ ১০০ গুণেরও বেশি বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি চমক দেখিয়েছেন সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান। তার ২০ একর জমি ৫ বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮৬৫ একরে। সম্পদের এই হিসাব তো যা প্রকাশ করা হয়েছে তা, কিন্তু প্রকাশিত এই হিসেবের বাইরে অপ্রকাশিত আরো কতো সম্পদ রয়েছে তা এই মুহূর্তে জানা সম্ভব না হলেও হয়তো ভবিষ্যতে জানা যাবে। নির্বাচন কমিশনার তার ওয়েব সাইটে আওয়ামী লীগের সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের যে তথ্য প্রকাশ করে, গত কয়েকদিন ধরে গণমাধ্যমে তা প্রকাশিত হতে থাকে। সম্পদের পাহাড় গড়ার এইসব তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় অস্বস্তি শুরু হয় ক্ষমতাসীনদের মধ্যে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা নড়েচড়ে বসেন তাদের সম্পদের বিবরণী নিয়ে। গত রোববার আওয়ামী লীগের নির্বাচন কমিশন সমন্বয় উপ-কমিটির আহ্বায়ক ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকীবউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দেখা করে প্রার্থীদের ব্যক্তিগত সম্পদ জনসম্মুখে প্রকাশের ব্যাপারে আপত্তি জানান। তবে গত ২৪ ডিসেম্বর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি জনপ্রতিনিধিদের সম্পদের পরিমাণ প্রকাশ করা উচিত। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, সুষ্ঠু রাজনীতির ধারার জন্য কোনো রাজনৈতিক দলের এ ধরনের প্রস্তাব নেতিবাচক। নির্বাচন কমিশনের উচিত প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজস্ব ভাবধারায় চলা। একটি দলের চাপে হলফনামার তথ্য প্রকাশ বন্ধ করা হলে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনকে উৎসাহিত করা হবে। সুজনের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আওয়ামী লীগের এ ধরনের প্রস্তাব সুষ্ঠু রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। এদিকে ২৪ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে দেশের ৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক বলেন : নির্বাচন কমিশনের প্রদত্ত হলফনামার তথ্য অনুযায়ী মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের অনেকেরই অস্বাভাবিক সম্পদের মালিক হওয়ার সংবাদ প্রকাশ যখন গণতান্ত্রিক জবাবদিহির সম্ভাবনা সৃষ্টি করে জনমনে বিপুল আলোড়নের সৃষ্টি করেছে, ঠিক তখনই প্রভাবশালী মহলের দাবিতে প্রার্থীদের সম্পদের তথ্য লুকানো এবং প্রকাশ বন্ধ করার জন্য নির্বাচন কমিশনের অশুভ তৎপরতার সংবাদে আমরা বিস্মিত, ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন। তারা বলেন, এটা সুস্পষ্ট যে গত ৫ বছরে মন্ত্রী-এমপিদের এই ব্যাপক সম্পদ অর্জন তাদের জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিধায় তা সম্পূর্ণ বেআইনী ও সংবিধানের ২০(২) ধারা অনুযায়ী অসাংবিধানিক। একই সঙ্গে সম্পদ বিবরণী প্রকাশের ফলে যেভাবে তারা বিব্রত ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছেন, তাতেই এরূপ সম্পদ অর্জনের বৈধতা আরো বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তারা আরো বলেন, হলফনামার তথ্য গোপনীয় দলিল বলে বিশেষ মহল থেকে যে যুক্তি তলে ধরা হয়েছে, তা উচ্চ আদালত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সঙ্গে শুধু সাংঘর্ষিকই নয়, প্রার্থীদের আট ধরনের তথ্য জনগণের কাছে উন্মুক্ত করার ব্যাপারে হাইকোর্টের রায় ও নির্র্দেশনারও পরিপন্থী। ফলে এমন তথ্য গোপন করতে ইসির চেষ্টা আদালত অবমাননারও শামিল। অন্যদিকে হলফনামার তথ্যকে আয়কর বিবরণীর সঙ্গে তুলনাও যুক্তিযুক্ত নয়। তারা বলেন, আইনের অপব্যাখ্যা ও ফাঁক-ফোকর দিয়ে যদি প্রার্থীদের সম্পদের তথ্য প্রকাশ বন্ধ করা হয়, তবে নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা শুধু যে শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে তাই নয়, বরং প্রভাবশালী মহলের কাছে নতি স্বীকার করে গণতান্ত্রিক জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় সৃষ্টিকারীর দোষে কমিশনকে দোষী হতে হবে।
বিস্ময়ের সাথে সাংবাদিকরা লক্ষ্য করলেন, নির্বাচন কমিশনের ওয়েব সাইট থেকে উধাও হয়ে গেছে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের হলফনামা। নির্বাচন কমিশনের ওয়েব সাইটে ২৪ ডিসেম্বর সকাল থেকে ‘প্রার্থীদের প্রদত্ত ব্যক্তিগত তথ্যাদি’ সম্বলিত ট্যাবটিতে প্রবেশ করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে ইসির কেউই কিছু জানাতে পারছেন না। ফলে পত্রিকায় শিরোনাম করা হয়েছে, ‘হলফনামার তথ্য লুকিয়ে ফেললো ইসি’। সরকারি দলের এবং ইসির আচরণে এ বিষয়টি দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, তারা পরস্পরের স্বার্থ রক্ষার দোসর। এদের আচরণে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার বক্তব্যই সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের হাতে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে, আর নির্বাচন কমিশন তাদের গণতন্ত্র বিনাশের দোসর। এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসির’ যে আহ্বান জানানো হয়েছে তাতে সাড়া দেওয়াই এখন নাগরিকদের রাজনৈতিক কর্তব্য বলে বিবেচনা করা যায়। ২৯ ডিসেম্বর লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা হাতে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা যেন আমাদের আশার আলো দেখাতে পারে, এটাই সময়ের দাবি। সেদিন সরকার এ গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার সাথে কেমন আচরণ করে তাও দেখার অপেক্ষায় আছে দেশের জনগণ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads