আমাদের এই সময়ের
অসুস্থ রাজনীতির একটি বড় উপহার ও উপমা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। একটি নির্বাচিত সরকার
থেকে তিনি ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন। এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত তিনি আর কত দিন ভোগ করবেন
সেটা ভবিষ্যতের বিষয়। ক্ষমতার জোরে তাকেই এখন ‘অসুস্থ’ বানিয়ে রাখা হয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকে ফোন
করে তিনি জানিয়ে দিলেন, আত্মসমর্পণ করবেন না, অসুস্থও নন, তিনি এই পাতানো নির্বাচনে এমপি হতে চান না তাকে সরকার জোর করে এমপি বানাতে চায়। তিনি
নির্বাচনে যাবেন না, তাকে জোর করে
নির্বাচনে নিতে চায়। তিনি নির্বাচনকালীন সরকারেও থাকতে চান না, তাকে জোর করে সরকারে রাখতে চায়। তিনি
মনোনয়ন প্রত্যাহার করার আবেদন করলেন সেই
আবেদন গ্রহণ করা হলো না। সর্বশেষ তাকে জোর করে বিদেশে পাঠানোর সকল আয়োজন সম্পন্ন
করা হলো।
এটা
যে ক্ষমতার দাপট কিংবা জোর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর মাধ্যমে বর্তমান সরকারের
চেহারা আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে যায়। দলান্ধ প্রশাসনের স্বরূপও চিহ্নিত করা সম্ভব।
নির্বাচন কমিশন কতটা আজ্ঞাবহ তারও ধারণা পাওয়া গেল। আরো ধারণা মিলে র্যাব-পুলিশ
এমনকি প্রশাসন যন্ত্র কতটা অনুগত এবং কী পরিমাণ গণদুষমন। পূর্বাপর আনপ্রেডিক্টেবল
এরশাদের এই আহাজারি জাতীয় দৈনিকের পাতায় ছাপা হওয়ার পরও আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে
তার নাগরিক ও মানবাধিকার রক্ষায় কোনো ভূমিকা পালন করল না। কেন এমনটা হলো এটা কোনো ছোট প্রশ্ন নয়।
ব্রিটেনের
প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের মন্তব্য অনুযায়ী আমার স্বদেশ এখন ‘বাংলাদেশ নামের জেলখানা’। পুরো বাংলাদেশ এখন কার্যত একটা অন্তহীন
কারাগার। ভিন্ন অর্থে জল্লাদখানা বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। তফসিল ঘোষণার পর এ ক’দিনে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে একশত, আহতের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজারের ঘর অতিক্রম
করেছে। মামলার সংখ্যা বেশুমার, গুমের তালিকা বাড়ছে।
এভাবে পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যার নজির এই দেশে এর আগে কখনো দেখা যায়নি।
বর্বর পাকিস্তানি ও তাদের দোসরদের যুদ্ধকালীন গণহত্যার ঘটনাগুলো যেন এখন হার
মানছে। আওয়ামী লীগ এবং গৃহপালিত বামপন্থীরা প্রথম মুক্তিযুদ্ধ অসমাপ্ত রেখেই
দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে। নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ যুদ্ধ
খেলা কেন তার কোনো সদুত্তর নেই। ‘দালাল’ খতম করার এই রক্ত উৎসব কোন ধরনের
মুক্তিযুদ্ধ তারও ক্যামেস্ট্রি বুঝতে অক্ষম। মুক্ত মানুষকে রাষ্ট্রশক্তির জোরে, জনগণের খাজনা ট্যাক্সের টাকায় লালিত পালিত
পুলিশ-র্যাব দিয়ে হত্যা করিয়ে সরকার কাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে! সীমান্ত
অরক্ষিত রেখে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী বিডিআর যা কি না এখন বিজিবি তাদের দিয়ে বিরোধী
দল দাবড়ানোর এই খেলাও জনগণকে দেখতে হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন, দুদক ও অন্যান্য সাংবিধানিক সংস্থা অসহায়ের
মতো আত্মসমর্পণ করে বসে আছে।
তারা
শর্তহীন আনুগত্য প্রদর্শন করছেÑ সরকার যেন দেশের
প্রতিটি নাগরিকের দণ্ড মুণ্ডের মালিক সেজে তাদের নিঃশর্ত আনুগত্য আদায় করতে চায়।
অবস্থা এমন যে হয় পোষ মানতে হবে, নয়তো গুলির মুখে
ঝাঁজরা হয়ে যেতে হবেÑ এ ধরনের বর্বরতার নজির
পৃথিবীর অন্য কোনো স্বৈরতান্ত্রিক দেশে পাওয়া যাবে কি?
বান
কি মুন, জন কেরি থেকে শুরু করে
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যেকোনো প্রতিনিধির অভিমত ও পরামর্শকে দেখা হচ্ছে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপের দৃষ্টিতে। বাংলাদেশের শাসকদের আচরণ
মিসরের সাবেক ও বনেদি একনায়কদের দম্ভ-অহমিকাকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বের খ্যাতিমান ও
নামী-দামি পত্রিকাগুলোর মন্তব্য নিয়ে আমাদের শাসনকর্তারা টিপ্পনি কাটেন।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পরামর্শ নিয়ে বিদ্রপ
করেন।
আগে
জানতাম খলের ছলের অভাব হয় না। এখন দেখছি শাসকের ছলনারও শেষ নেই। এখন ক্ষমতার কোনো
ব্যাকরণ থাকতে হয় না। আইন মানতে হয় না। কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। জনগণকে
এভাবে ছাগল ভেড়া ভেবে কোনো দেশের সরকারই এমন যুক্তিহীন আচরণ করে না। এখন আইন
আদালতের কাছে তো বটেই জনগণের সামনে কোনো কৈফিয়ত দিতে হয় না। এরপরও ক্ষমতার লোকদের
দেশপ্রেম নাকি উথলে উঠছে। সংবিধানের মায়াকান্না থামছে না। গণতন্ত্র প্রেমের বিলাসী
তাজমহল গড়তে তাদের যেন জুড়ি নেই।
দৃঢ়ভাবে
বিশ্বাস করি, দেশের সব মানুষের মানবিক
অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়নি। বস্তুত সম্মানিত লোকরা এই সরকারের আমলে অতীতে যেভাবে
লাঞ্ছিত হয়েছেন তারা অবশিষ্ট সম্মানটুকু
নিয়ে বাঁচতে চান। এই দেশের ভিন্ন মতাবলম্বী সব বুদ্ধিজীবী, সুশীল, এনজিও
ব্যক্তিত্ব, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী বারবার ক্ষমতার
সংযমহীন লকলকে জিহ্বা থেকে নিঃসরিত বিষাক্ত লালায় ভিজেছেন। তারা আর কোনো
বিড়ম্বনাকে আমন্ত্রণ জানাতে চান না। কেউ বোবা হয়ে থাকাকে ভাবছেন নিরাপদ। কেউ
দৃষ্টির আড়ালে পড়ে থাকাকে ভাবছেন সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষার একটা উপায়। এটাই গণতন্ত্রহীন
অন্ধকার রাজনীতির বড় আলামত। এভাবে আত্মগোপন বা স্বেচ্ছা নির্বাসনের পথ ধরা কতটা
সমীচীন এবং বিবেকের সাথে প্রতারণা কি না সেই প্রশ্ন এখন গৌণ।
দেশবাসী
দেখছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়িয়ে ফায়দা তুলতে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর-দোকানপাটে
হামলার জন্য সরকারের পেটুয়া বাহিনী কি ভূমিকাই না পালন করছে। সাম্প্রদায়িক উসকানির
এই কুৎসিত খেলার দায় চাপানো হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর। ঠাণ্ডা মাথায় গুলি
করে দোষ দেয়া হচ্ছে বিরোধী দলের মাঠকর্মীদের ঘাড়ে। সরকারের লোকজনের যেকোনো কর্মকা ‘জনগণের প্রতিবাদ’। প্রতিপক্ষের সব প্রতিবাদ নাশকতা, সহিংসতা, পাশবিকতা, নৃশংসতা। বোমা ছুড়ে
পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে সরকারি দলের কর্মী, নাম
হয় বিরোধী দলের। শহীদ মিনার ভাঙতে গিয়ে ধরা পড়ে সরকার অনুগত কর্মী, দোষ চাপে মৌলবাদের ওপর। বোমার কারখানার
সন্ধান মিলে পুলিশকে দিয়ে তোতা পাখির মতো বলানো হয়, বিরোধী দলের বিপক্ষে। বোমা বানাতে গিয়ে হাতের কব্জি উড়ে যায়
সরকারি দলের লোকদের, দোষ চাপানো হয়
বিরোধীপক্ষের ওপর। পুলিশের জ্যাকেট পরে, বন্দুক
হাতে, পুলিশের কাতারে দাঁড়িয়ে
প্রতিবাদী কর্মসূচি পালনরত বিরোধী দলের কর্মীদের গুলি ছুড়ে সরকারদলীয় ক্যাডার, জাতীয় দৈনিকে ছবি ছাপা হয়, কারো কোনো টনক নড়ে না।
এক
সময় এ ধরনের বাড়াবাড়ির কারণে সর্বহারা চরমপন্থীরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নক্সালবাদের
জন্ম নিয়েছে। চারু মজুমদারেরা অস্ত্র হাতে লড়েছেন আমৃত্যু। ভারতে সেই খণ্ড যুদ্ধের
চিত্র ক’দিন আগেও ছত্রিশগড়ে
প্রত্যক্ষ করা গেল। আমাদের উত্তর ও দক্ষিণ জনপদে সর্বহারাদের তৎপরতা সবার জানা।
এখন জনমনে, পেশা নির্বিশেষ সর্বস্তরে, এমনকি প্রশাসনেও অজানা আতঙ্ক গ্রাস করেছে।
দেশ যেভাবে কারাগার ও নিপীড়নের দোজখখানায় রূপান্তরিত হয়েছে, রাষ্ট্রের সন্তানতুল্য নাগরিক হত্যা করে
যেভাবে পৈশাচিক উল্লাস ও ক্ষমতার দম্ভ জাহির করা হচ্ছে তাতে আমাদের জাতির ভাগ্য
বিড়ম্বনা, জনগণের দুর্গতি ও শাসককুলের
মন্দ বরাতের কোনো হেরফের হওয়ার কথা নয়। সব প্রহসন ও তামাশার একটা জের আছে, সব হিংস্রতারও একটা পরিণতি আছে। জোর
জবরদস্তির ক্ষমতারও শেষ আছে। সব বাড়াবাড়ির একটা পরিসমাপ্তি আছে। সাধারণ মানুষ, দোকানি থেকে খেটে খাওয়া মুটে মজুর, সবার আহাজারি- হে মহাশক্তিমান ও শাশ্বত
সত্যবাদীদের প্রভু, এই সরকারের অন্যায্য
চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হিংসাত্মক রাজনীতির বিষাক্ত ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত এই
জনপদ থেকে উদ্ধার করো। ত্রাণকর্তা পাঠাও এবং জুলুম-অত্যাচার, নিপীড়ন ও দুঃশাসনের কারাগার থেকে মুক্ত
করো। এই আহাজারির আওয়াজ আরশের প্রভুর দরবারে পৌঁছে গেলে রহমত কিংবা গজব দু’টোই অনিবার্য হয়ে যাবে।
বিশ্বসম্প্রদায়
‘না’ বলা শুরু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত
কূটনীতিকরা স্মৃতিসৌধে গর হাজির থেকে জানান দিলেন- তারা কী ভাবছেন। এ ধারা প্রলম্বিত
হতে যাচ্ছে।
ববি
হাজ্জাজ আমাদের রাজনীতির অনেক বেশি চেনা জানা কোনো বরপুত্র নন, আলোচিত চরিত্র মুসা বিন শমসেরের সন্তান।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছিলেন। একটা থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও গবেষণা
সেলের কর্ণধার, জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের
নবীন উপদেষ্টা। হালে আলোচনায় এসেছেন। এরশাদ সুস্থ কিন্তু তাকে প্রকারান্তরে কৌশলী
খেলায় বন্দী করে রাখা হয়েছে এটা বলাই তার অপরাধ।
একদিন গুজব বেরুল ববি হাজ্জাজকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
সর্বশেষ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে রাজনৈতিক বঞ্চনা এড়াতে তিনি বিলাতে পাড়ি দিতে বাধ্য
হয়েছেন। নিরাপত্তাহীনতার চাদরে ঢাকা এই দেশটিতে আর কি ঘটনা ঘটলে আমরা বলব সাধু! সাধু!!
একজন ববি হাজ্জাজ এবং এরশাদই কি বর্তমান চিত্রকে উদোম করে তুলে ধরে না!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন