গ্রিক Demokratia শব্দ থেকে গণতন্ত্র বা Democracy শব্দটির উৎপত্তি। এর মানে
হলো ‘জনগণের মতায়ন’ বাংলাদেশে কাগজে-কলমে যে গণতন্ত্র
বিদ্যমান তা কি আদৌ এই অর্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ? এর উত্তর নিঃসন্দেহে ‘না’। ১৬ কোটি জনগণের এই দেশ পরিচালনায় ‘নগণের মতায়ন’ কিংবা তাদের মতামতের প্রতিফলন কত সামান্য, তার একটি উদাহরণ, সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা
বাতিল। বিভিন্ন জরিপের ফলাফল অনুযায়ী দেশের ৯০ শতাংশ জনগণের দাবি, পরবর্তী সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের অধীনে সম্পন্ন হোক। কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে? গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায়
বিরোধী দল সরকারেরই অংশ। সরকার ও বিরোধী দল আলাপ, আলোচনা করে মিলেমিশে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, সেটাই জনপ্রত্যাশা। কিন্তু এ দেশে তা দেখা
যায় না। বিরোধী দলের দাবি মানা তো দূরের কথা, তাদের
দাবি সরকারি দল কখনো সহজে মন দিয়ে শুনেছে বলেও খুব একটা জানা যায়নি। এসব কারণেই
উভয়ের মধ্যে অবিশ্বাস এবং আকাশ, পাতাল মতপার্থক্য।
বিরোধী দল বাধ্য হয়ে তাদের দাবি মানতে সরকারকে চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে বেছে
নেয় হরতালের মতো চরম কর্মসূচি, যার কুফল ভোগ করে
জনগণ।
জাতীয়
সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সঙ্কট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি
জনজীবনের নিরাপত্তা করছে বিঘিœত। দেশের বর্তমান
পরিস্থিতিতে জাতিসঙ্ঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীনসহ বিশ্বের বহু দেশ ও সংস্থা গভীর
উদ্বেগ প্রকাশ করছে। বাংলাদেশের সম্ভাব্য অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ
করছে মার্কিন কংগ্রেস। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘দেশের রাজনীতিতে এমন অস্থিরতা চলতে থাকলে
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ।’ বিশ্ব কমিউনিটির দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের দিকে।
এক দিকে পরিবর্তিত সংবিধানের দোহাই দিয়ে সরকার কথিত ‘সর্বদলীয়’ মন্ত্রিসভা গঠনসহ নানা কূটকৌশলের মাধ্যমে বিরোধী দলকে দূরে
রেখে নির্বাচন করতে চাচ্ছে; অন্য দিকে বিরোধী দল
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
সরকারি দল উৎসবমুখর পরিবেশে মনোনয়নপত্র বিক্রি করছে, অন্য দিকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে রিমান্ডের
নামে নিপীড়ন চালানোসহ দলীয় অফিস অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। পুলিশের প্রতিবেদন
অনুযায়ী, সম্প্রতি গ্রেফতারকৃত বিরোধীদলীয়
নেতা এম কে আনোয়ার, মওদুদ আহমদ ও রফিকুল
ইসলাম মিয়ার বয়স যথাক্রমে ৮১, ৭৩ ও ৭১ বছর। এই তিনজন
মানুষের ব্যক্তিগত প্রোফাইল এবং সর্বোপরি তাদের বয়স বিবেচনা করলে সরকারি দলের
কোনো নেতাকর্মীও বিশ্বাস করবেন না যে, তারা
হরতালের সময় ঘটে যাওয়া সহিংসতায় জড়িত ছিলেন। অথচ আদালত তাদের প্রত্যেককে আট দিনের
রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। উচ্চ আদালত সে রিমান্ড বাতিল করে দিয়েছেন। গ্রেফতারের পর
মতাসীন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী
জাফরুল্লাহ বলেছেন, ‘সহিংসতা ছেড়ে আলোচনায়
এলে এই নেতাদের ছেড়ে দেয়া হবে। এই অবস্থা স্বৈরশাসনকেও হার মানায়।
বাংলাদেশের
রাজনীতিতে সবচেয়ে সমালোচিত, অনির্ভরযোগ্য, অসৎ, অনৈতিক
ও হাস্যকর চরিত্রের খলনায়কের নাম ‘এরশাদ’। কামরুল হাসানের দেয়া ‘বিশ্ববেহায়া’ খেতাবের সাথে এখন যোগ হয়েছে ’থুথু বাবা’ এবং ‘কোরবানির গরু’ খেতাব। কথিত ‘সর্বদলীয়’ সরকার গঠনের প্রয়োজনে স্বৈরশাসক এরশাদের জাতীয় পার্টির কদর
সরকারের কাছে বেড়ে যায় বহু গুণে। স্বঘোষিত সর্বদলীয় (যদিও মহাজোটীয় সরকারের নতুন
সংস্করণ! সরকারে জাতীয় পার্টিকে দেয়া হয় ছয়টি মন্ত্রিত্বের আসন। স্বৈরশাসক এরশাদ
শাসনের অবসান এবং গণতন্ত্র মুক্তির আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেন এবং ডা: মিলনের আত্মার
সাথে এ কেমন নিষ্ঠুর রসিকতা? দেশের বড় দুই দল
বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, উভয়ই নব্বইয়ের পর
স্বৈরাচারী এরশাদের বিচারের দাবিতে অনড় ছিল। অথচ সেই আওয়ামী লীগই তাকে জামাই আদরে
রাষ্ট্রীয় মতার অংশীদারিত্ব দিয়েছে। কথিত ফার্স্ট লেডি রওশন এরশাদও এখন মন্ত্রী।
কোনো দেশেই পতিত স্বৈরশাসকেরা ও একনায়কেরা আর রাষ্ট্রমতায় আসতে পারে না। নানা
অপকর্মের অপরাধে তাদের জন্য অবধারিত থাকে চরমদণ্ড, নয়তো কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ। অথচ মামলার পাহাড় মাথায়
নিয়েও এ দেশের স্বৈরশাসক এখন দিব্যি রাষ্ট্রীয়মতার অংশীদার। গণ-অভ্যুত্থানে মতা
থেকে বিতাড়িত হওয়ার ২৩ বছর পর এখনো তিনি রাজনীতির কিংমেকার। ভাবতে অবাক লাগে, জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থান কোথায়?
১১
জন উপদেষ্টাসহ এই মহাজোটীয় নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রীদের সংখ্যা ৩৯। এত বিশাল
কলেবরের নির্বাচনকালীন আজব সরকারের ফর্মুলা কি আদৌ সংবিধানসম্মত? এ মন্ত্রিসভা মহাজোটের শরিকদের মধ্যে
কৌশলগত মতার পুনর্বণ্টন ছাড়া কিছুই নয়। এক দিকে সরকারি দল যখন অনির্বাচিত
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতা করছে, তখন
অনির্বাচিত উপদেষ্টাদের নির্বাচনকালীন সরকারে রাখা নৈতিক দিক থেকেও ঠিক নয়। আর
সরকার যেহেতু রুটিন ওয়ার্কের বাইরে বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, সেহেতু এই উপদেষ্টারা কী প্রয়োজনে কাকে
উপদেশ দেবেন কিংবা তাদের উপদেশে জনগণ কিভাবে উপকৃত হবেন, তা বোধগম্য নয়। অন্য দিকে এই একপক্ষীয়
মন্ত্রিসভা সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে সুষ্ঠু নির্বাচনে ভূমিকা
রাখবে, সেটা ভাবারও কারণ নেই। এই
মন্ত্রিসভার আর এক পরিহাস হলো স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নিহত আওয়ামী লীগ
নেতা ময়েজউদ্দিন আহমদের কন্যা মেহের আফরোজকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী পদ
থেকে বাদ দিয়ে সে পদে এরশাদেরই মহিলা কোটার সদস্য সালমা ইসলামকে নিয়োগদান। অনেকেই
বলেন, এরশাদ এমন একজন মানুষের নাম
যার কাছে ‘লজ্জাও লজ্জা পায়’।
অন্য
দিকে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নিরপেতার সাথে সব দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করে
সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা। কিন্তু অনেক বিতর্কিত কাজ করে নির্বাচন কমিশন তাদের
নিরপেতা এবং ভাবমূর্তি হারিয়েছে। বহুল বিতর্কিত নতুন রাজনৈতিক দল বিএনএফকে
উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিবন্ধন প্রদানের দীর্ঘমেয়াদি কূটকৌশল এবং এই খেলায় নির্বাচন
কমিশনের সরাসরি নেমে পড়া নিজেদের নিরপেতা হারানোর নগ্ন উদাহরণ। নির্বাচনের আগে
প্রধান বিরোধী দল বিএনপির তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও এ রকম একটি অচেনা ও সন্দেহজনক
দলের নিবন্ধন প্রদান সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করা যায় না। এমন পরিস্থিতিতে
নির্বাচন কমিশন যদি বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে মহাজোটের শরিক ও কিছু নামসর্বস্ব দল নিয়ে
একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করে, তা হবে আত্মঘাতী
সিদ্ধান্ত। কারণ এমন নির্বাচনে দলান্ধ ব্যক্তি ছাড়া ভোটারের উপস্থিতির সম্ভাবনা কম, নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হবে না, সহিংসতা হবে অবধারিত এবং বিদেশী পর্যবেক
আসার সম্ভাবনাও ীণ। এর প্রতিটিই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অন্তরায়। দেশ-বিদেশে কোথাও
এই নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না, তা
নিশ্চিত করেই বলা যায়। যদি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে এ রকম কোনো অগ্রহণযোগ্য
সরকার রাষ্ট্রমতায় চলেও আসে, সে সরকার হবে
নৈতিকভাবে দুর্বল এবং দেশ-বিদেশে শুরু থেকেই ব্যাপকভাবে সমালোচিত। বিরোধী দল প্রথম
থেকেই চাইবে আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের পতন ঘটাতে। এমন পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি
সঙ্ঘাত ও সহিংসতা অনিবার্য। নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন-পরবর্তী এমন সঙ্ঘাত ও
সহিংসতার যেকোনো পর্যায়ে আশঙ্কা রয়েছে অন্য শক্তির অবাঞ্ছিত হস্তেেপরও। এতে
দীর্ঘমেয়াদে তিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। এ দেশ পরিণত হতে
পারে ব্যর্থ রাষ্ট্রে। এটা স্পষ্ট যে, প্রধান
বিরোধী দলহীন নির্বাচন দেশ ও জাতির জন্য শুধু সঙ্কটই ডেকে আনবে। সরকারি দল ও
বিরোধী দল সবাইকে বুঝতে হবে, চরম বিপর্যয় ডেকে আনা
গণতন্ত্র চর্চার অন্তরায়।
অবিলম্বে
সরকারের উচিত সবার অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং এ
লক্ষ্যে বিরোধী দলের সাথে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছা।
সরকার যেহেতু রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে, সুতরাং, সব অহং, জেদ
ও কূটকৌশল ছেড়ে সংলাপের আয়োজন তাদেরকেই করতে হবে। সঙ্ঘাত কোনো সভ্য সমাধান নয়, গণতান্ত্রিক সমাধান তো নয়ই। রাজপথে শক্তি
পরীা করতে গেলে শেষ পর্যন্ত জিতটা কিন্তু বিরোধী দলের হয়ে থাকে। এ দেশে ১৯৭১, ১৯৯০, ১৯৯৬
ও ২০০৬ সালের ইতিহাস তাই বলে। বিষোদগার নয়, গালিগালাজ
নয় বরং যুক্তি ও সুবিবেচনা দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে, এমন প্রত্যাশা কি আমরা করতে পারি না? গণতন্ত্র রায়, জাতির মর্যাদা রায় সংলাপ অপরিহার্য। নয়তো
অপশক্তি আবারো উঁকি দিতে পারে। সাধারণ জনগণ এতটুকু আশা করে যে, সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, আলোচনার পথ ধরে রাজনীতির কাল মেঘ কেটে যাবে, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে আর আমরা পাব
সন্ত্রাস-দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও ুধামুক্ত
সুখীসমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন