পাঠকদের মধ্যে অনেকেরই ভালো না-ও লাগতে পারে কিন্তু এটাই বহুবার প্রমাণিত সত্য যে, মারমুখী রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো তুলনা চলে না। প্রতিপক্ষকে ধোয়ামোছা করার ব্যাপারে তিনি যে আসলেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী তার সর্বশেষ প্রমাণ পাওয়া গেছে প্রধানমন্ত্রীর গত কয়েকদিনের বক্তৃতায়। যেমন গত ২৬ ডিসেম্বর ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও গোপালগঞ্জে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী জনসভায় দেয়া বক্তৃতায় আবারও ব্যক্তিগতভাবে বেগম খালেদা জিয়াকে ‘এক হাত’ নিয়ে ছেড়েছেন তিনি। তার অভিযোগ, খালেদা জিয়াই নাকি হরতাল-অবরোধ ও আন্দোলনের নামে মানুষ হত্যা করেছেন। এসব হত্যাকান্ডের কারণে তাকে ‘হুকুমের আসামী’ বানিয়ে ‘বাংলার মাটিতে’ তার বিচার করা হবে (পাঠকরা লক্ষ্য করবেন, প্রধানমন্ত্রী এবং তার সঙ্গি-সাথীরা বাংলাদেশকে সাধারণত ‘বাংলা’ বলে থাকেন। বলেন না, ‘বাংলাদেশের মাটিতে’ যার অন্যরকম ব্যাখ্যা রয়েছে) প্রধানমন্ত্রী বলতে না বলতেই, প্রকৃতপক্ষে তিনি বলারও আগেই পাল্লা দিয়ে ময়দানে হাজির হয়েছেন তার অধীনস্থজনেরাও। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী থেকে আওয়ামী লীগ নেতাদের সকলেও বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের প্রকাশ ঘটাতে শুরু করেছেন। সবার মুখেই ২৯ ডিসেম্বরের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’কে ব্যর্থ করে দেয়ার হুমকি উচ্চারিত হচ্ছে। তারা হুংকার দিয়ে জানাচ্ছেন, ২৯ ডিসেম্বর রাজধানী দখল করে নেবেন তারা। এ উদ্দেশ্যে একের পর এক ‘গণতান্ত্রিক’ কর্মসূচির ঘোষণা এবং কর্মীদের উদ্দেশে হুকুমও আসছে তাদের বেসুরো কণ্ঠ থেকে। একজন প্রতিমন্ত্রী তো পাড়া-মহল্লায় বাঁশের লাঠি নিয়ে পাহারা দেয়ার এবং বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দেখা মাত্র পিটিয়ে লম্বা করারও হুকুম দিয়েছেন! বলেছেন, বিরোধী দলকে মার্চ করতে দেয়া দূরে থাকুক, দাঁড়াতেই দেবেন না। তারাই রাজপথ দখলে রাখবেন। পাশাপাশি আরো কিছু কঠোর ও ব্যঙ্গাত্মক বক্তব্যও শোনা যাচ্ছে। যেমন একজন প্রতিমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন, কার কত শক্তি তা তারা রাজপথেই দেখে নেবেন। সেদিন তারা এমন ব্যবস্থাই নেবেন যার ফলে ১৮ দলের নেতাকর্মিরা নাকি ঢাকা শহরেই ঢুকতে পারবেন না! এভাবে সব মিলিয়েই ক্ষমতাসীন নেতারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, খালেদা জিয়ার ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিকে ভন্ডুল না করা পর্যন্ত ঘুম তো আসবেই না, পেটের ভাতও হজম হবে না তাদের।
প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন নেতারা হঠাৎ কেন এতটা যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠেছেন তার কারণ সম্ভবত উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। প্রায় এক মাস ধরে অবরোধ কর্মসূচি পালনের পর গত ২৪ ডিসেম্বর বেগম খালেদা জিয়া ঢাকা অভিমুখে অভিযাত্রার আহবান জানিয়েছেন। সেদিন সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি শ্রেণী পেশা বয়স ও ধর্ম নির্বিশেষে জনগণের উদ্দেশে বলেছেন, আগামী ২৯ ডিসেম্বর রোববার তারা যেন লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা হাতে দলে দলে এসে নয়া পল্টনে অবস্থিত বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে সমবেত হন। আসার পথে তারা যেন দশম সংসদ নির্বাচনের ঘোষিত তফসিল বাতিল করে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করার দাবি জানিয়ে স্লোগান দেন। খালেদা জিয়া অভূতপূর্ব এ কর্মসূচিটির নাম দিয়েছেন ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’গণতন্ত্রের জন্য অভিযাত্রা। সরকার যাতে ঢাকামুখীন অভিযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের ওপর নির্যাতন না চালায়, ট্রেন-বাস ও লঞ্চ-স্টিমারসহ যানবাহন চলাচল যাতে বাধাগ্রস্ত না করে এবং রাজধানীর হোটেল-রেস্তোরাঁ যাতে বন্ধ করার হুকুম জারি না করে বসে সে দাবিও জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এমন এক সময়ে তিনি কর্মসূচিটি ঘোষণা করেছেন, যখন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ঘোষিত তফসিল বাতিলের দাবিতে চলমান অবরোধে সারাদেশ অচল হয়ে পড়েছে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হওয়ার ধুম পড়ে যাওয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে যখন দেশে-বিদেশে ধিক্কার উঠেছে এবং বিভিন্ন রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থা যখন পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, দেশে-বিদেশে তীব্র নিন্দা-সমালোচনার মুখে প্রধানমন্ত্রী একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রলোভনও দেখাচ্ছেন, যাতে বিরোধী দল ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রতিহত না করে এবং কোনোভাবে তারা নির্বাচনটি সেরে ফেলতে ও তার মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় আসতে পারেন।
সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনটি অত্যন্ত সময়োচিত হয়ে উঠেছিল। পুরো বক্তব্যেও তিনি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার যথার্থ প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। সঠিকভাবেই সব দলকে বাইরে ঠেলে দেয়ার এবং একদলীয় নির্বাচন চেষ্টার অভিযোগ তুলেছেন তিনি। সরকারের প্রতি দাবি মেনে নেয়ার আহবান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেছেন, হত্যা ও দমন-নির্যাতন বন্ধ করে এখন দরকার সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সমুন্নত করা এবং দেশ ও জনগণকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়া। এজন্য প্রথমে দরকার ঘোষিত তফসিল বাতিল করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। অন্যদিকে কর্মসূচির ঘোষণা শুনেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে ক্ষমতাসীনদের, সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তারা। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে কামরুল ইসলাম, হাসানুল হক ইনু, ওবায়দুল কাদের, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ওÍ মাহবুব-উল আলম হানিফ পর্যন্ত এমন কারো নাম বলা যাবে না, যিনি গলা না ফাটাচ্ছেন। এক কথায়, ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিকে প্রতিহত করার জন্য ক্ষমতাসীনদের প্রত্যেকেই যার যার মতো করে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছেন। সকলের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী যে এগিয়ে থাকবেন সে কথা নিশ্চয়ই বলার দরকার পড়ে না। তিনি শুধু এগিয়েই থাকছেন না, এমন দু-একটি কথাও বলেছেন যা শুনে ইতিহাস স্মরণ না করে পারা যায়নি। যেমন গোপালগঞ্জের জনসভায় তিনি বলে বসেছেন, ২৯ ডিসেম্বর বিএনপির পরাজয়ের এবং আওয়ামী লীগের বিজয়ের দিন বলেই নাকি বেছে বেছে ওই দিনটিতেই কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন খালেদা জিয়া। সত্যি বলতে কি, সাধারণ অনেক মানুষের মতো আমারও তারিখটির মহিমা-মাহাত্ম্যের কথা মনে ছিল না। একাধিকবার শোনার পর হঠাৎ মনে পড়ে গেছে, প্রধানমন্ত্রী আসলে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যেদিন অনুষ্ঠিত ‘ডিজিটাল’ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যায় না। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বলেই প্রসঙ্গক্রমে একটু অতীতে ঘুরে আসা যাক। ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচনের নামে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর আসলে যে ‘ডিজিটাল ক্যু’ ঘটানো হয়েছিল সে কথা অনেক আগে সাধারণ মানুষও ধরে ফেলেছে। তাদের ধারণার বাইরে ছিল শুধু একটি বিষয়। তারা ভাবতে পারেনি যে, আওয়ামী জোটকে এতটা ন্যক্কারজনকভাবে ও বিরাট ব্যবধানে জিতিয়ে দেয়া হবে। এজন্যই মানুষ মাত্র স্তম্ভিত হয়েছিল, তাদের স্বাভাবিক জীবনও থমকে গিয়েছিল। বিষয়টি সম্পর্কে কিন্তু জানা যাচ্ছিল নির্বাচনের আগে থেকেই। যেমন নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে বহুদিন পর সুদূর কানাডা থেকে স্বামী-সন্তানসহ উড়ে এসেছিলেন শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। ১৩ ডিসেম্বর শেখ রেহানাও হঠাৎ তার ছোট মেয়ে রূপন্তীকে নিয়ে লন্ডন থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। ২২ ডিসেম্বর এসেছিলেন শেখ রেহানার বড় মেয়ে টিউলিপ, ছেলে রেদওয়ান সিদ্দিকী ববি এবং তার বিদেশী ও অমুসলিম স্ত্রী পেপপি। ‘শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালানো হতে পারে’ এমন এক ভীতিকর প্রচারণার মধ্যেও সপরিবারে শেখ রেহানার দেশে আসার বিষয়টি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং ইঙ্গিতবাহী। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, ভেতরে ভেতরে আসলেও অন্য রকম আয়োজন ছিলÑ বেগম খালেদা জিয়া যাকে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এই আয়োজন চলছিল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার এবং শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর জন্য। অন্তরালে আয়োজন বা ষড়যন্ত্র ছিল বলেই শেখ হাসিনাকে নির্বাচনী প্রচারণার চূড়ান্ত দিনগুলোতেও ‘রিলাক্সড্্ মুডে’ দেখা গিয়েছিল। কোনোভাবে দিনগুলো পাড়ি দিচ্ছিলেন তিনি। অপেক্ষায় ছিলেন শুধু ২৯ ডিসেম্বরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ার জন্য।
আয়োজন নামের যে ষড়যন্ত্রের ভরসায় শেখ হাসিনা নিশ্চিন্তে দিন পাড়ি দিচ্ছিলেন, বাস্তবে সে ষড়যন্ত্রই বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। কৌশলও অতি চমৎকারই ছিল। ব্যবস্থাপনায় যদি শুধু সেনাবাহিনী জড়িত থাকতো তাহলে একে ক্যু দে তাঁ বা সামরিক অভ্যুত্থান বলা যেতো। কিন্তু জড়িত ছিল বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টর বা নির্ধারক শক্তি। তারা সম্মিলিতভাবেই চার দলীয় জোটকে হারিয়ে দিয়েছিল। ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের এই মহাকম্মে প্রধান ফ্যাক্টর হিসেবে ভূমিকা রেখেছিলেন ‘উদ্দিন সাহেবরা’। সংবিধান লংঘন করে ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে বেআইনীভাবে দমন-নির্যাতন ও গ্রেফতার অভিযান চালিয়েছেন তারা। মামলার পর মামলা চাপিয়ে বড় বড় রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীদের অসম্মানিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করেছিলেন। দেশ ও জাতি বিরোধী অনেক ‘কীর্তিও’ ছিল তাদের। নির্বাচনের পর এসবের বৈধতা দেয়ার প্রশ্ন উঠতো। এ ব্যাপারে অনেক চেষ্টা করেও বিএনপি ও জামায়াতসহ চার দলীয় জোটকে রাজি করানো যায়নি। এজন্যই ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ২৯ ডিসেম্বর সে ‘উচিত শিক্ষা’ই দিয়েছিলেন ‘উদ্দিন সাহেবরা’। চার দলীয় জোটকে একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি ক্ষমতাধর ও শক্তিশালী ফ্যাক্টরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছিল। এসবের মধ্যে প্রকাশ্যে ছিল আওয়ামী মহাজোট, অন্যদিকে অদৃশ্য অবস্থায় প্রধানত তৎপর ছিল নির্বাচন কমিশন, প্রশাসনের একটি বিশেষ গোষ্ঠি, তিনটি দেশের দূতাবাস ও গোয়েন্দা সংস্থা এবং কয়েকশ’ এনজিও। ছিল বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ ও জাতিসংঘের এজেন্টরা। বড় কথা, ‘উদ্দিন সাহেবরা’ তো ছিলেনই। এতগুলো ক্ষমতাধর ফ্যাক্টরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসলে কারো পক্ষেই জিতে আসা সম্ভব ছিল না। চার দলীয় জোটও তাই জয়ী হতে পারেনি। চার দলীয় জোটকে আসলে হারিয়ে দেয়া হয়েছিল।
বিষয়টি বুঝতে হলে ফলাফলের কথা স্মরণ করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী ২০০৮-এর ওই নির্বাচনে গড়ে ভোট পড়েছিল ৮৭ দশমিক ১৬ শতাংশ। সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই পরিমাণ ভোট পড়তে হলে প্রতি মিনিটে একজন করে ভোটারকে ভোট দিতে হয়েছিল। নিজের ভোটার নাম্বার ও নাম-ঠিকানা জানিয়ে ও মুড়ি বইতে স্বাক্ষর দিয়ে ব্যালট পেপার সংগ্রহ করা, আঙুলে অমোচনীয় কালি লাগানো, পোলিং বুথের ভেতরে যাওয়া, পছন্দের প্রার্থীর ঘরে সিল মারা এবং ব্যালট পেপার ভাঁজ করে বাক্সে ফেলা পর্যন্ত কাজগুলো সারতে হলে কম করে হলেও আট থেকে ১০ মিনিট পর্যন্ত সময় লাগার কথা। সে হিসাবে প্রতি মিনিটে একজন করে ভোটারের পক্ষে ভোট দেয়া একেবারেই সম্ভব নয়। অন্য কিছু তথ্য-পরিসংখ্যানও যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ। মহাজোটের প্রার্থীরা ২৯৯ আসনের মধ্যে ১৭০ আসনেই ৮৫ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। এদের মধ্যে আবার ৭৪ জন প্রার্থী পেয়েছিলেন ৯০ দশমিক ০১ থেকে ৯৪ দশমিক ৮৯ শতাংশের মধ্যে। অর্থাৎ মহাজোট প্রার্থীদের ৫৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ জনই অস্বাভাবিক হারে ভোট পেয়েছিলেন। এত বেশি ভোট গোপনে বাড়তি সিল মারা ছাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। কথা আরো আছে। প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এমন অন্তত ৮৮টি আসন ছিল যে আসনগুলোতে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পড়েছিল এবং মিনিটে একজন নয়, চার থেকে পাঁচজন পর্যন্ত ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। পরিসংখ্যানে এটাও দেখা গেছে, যে ২৬২ আসনে মহাজোট প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছিলেন সে আসনগুলোতেই তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ভোট পড়েছিল। এখানেই ছিল আসল ‘মাজেজা’Ñ চার দলীয় জোট যাকে ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।
প্রধান দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যকার ভোটের ব্যবধান থেকেও চৌর্যবৃত্তির বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছিল। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের দুটি নির্বাচনে দল দুটির প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ছিল যৌক্তিক পর্যায়ে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এক কোটি ৫৮ লাখ এবং বিএনপি এক কোটি ৪২ লাখ ভোট পেয়েছিল। ব্যবধান ছিল ১৬ লাখ ভোটের। এর পর ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই কোটি ২৩ লাখ এবং বিএনপি দুই কোটি ২৮ লাখ ভোট পেয়েছিল। ব্যবধান ছিল পাঁচ লাখ ভোটের। এটাও স্বাভাবিক। কিন্তু ২০০৮-এর নির্বাচনে দুই প্রধান দলের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান দেখানো হয়েছিল এক কোটি ১১ লাখ আওয়ামী লীগ যেখানে পেয়েছিল তিন কোটি ৪২ লাখ, বিএনপি সেখানে পেয়েছিল দুই কোটি ৩১ লাখ ভোট। এই বিরাট ব্যবধান শুধু অস্বাভাবিক নয়, অগ্রহণযোগ্যও। দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের ভোট যেখানে বেড়েছিল এক কোটি ১৯ লাখ, বিএনপির সেখানে বেড়েছিল মাত্র তিন লাখ! এমন কোনো হিসাব নিশ্চয়ই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না।
এভাবে অতি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায়ও প্রমাণিত হবে, ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে রীতিমতো ‘ডিজিটাল খেল’ দেখানো হয়েছিল। কারচুপি বা জালিয়াতি শুধু নয়, ‘ডিজিটাল চৌর্যবৃত্তি’ও যথেষ্টই করা হয়েছিল। পেছনে কোন কোন বিশেষ শক্তি ছিল সে সম্পর্কে বহুবার বলা হয়েছে। বর্তমান পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো, অমন একটি নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ হওয়ার গালগল্পটাই নতুন করে শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লজ্জা-শরমের মাথা-মুন্ডুকেও তিনি খেয়ে বসে আছেন কি না সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পরিবর্তে বলা দরকার, ভোটের হিসাবে বহু-বহুগুণ পিছিয়ে পড়েছেন বলেই তিনি বিরোধী দলকে বাইরে ঠেলে দিয়ে একদলীয় নির্বাচনে নেমেছেন। সৎসাহস থাকলে তিনি অবশ্যই ভোটের যুদ্ধে অংশ নিতেন। তারও আগে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতেন না। তখন দেখা যেতো কত ধানে কত চাল হয় ২৯ ডিসেম্বর আসলে কার বিজয়ের এবং কার পরাজয়ের দিন! কথা শুধু এজন্য ওঠেনি। এত যে ‘বিজয়ী’ প্রধানমন্ত্রী তিনিও কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার একটি মাত্র কর্মসূচির ঘোষণা শুনেই প্রায় কুপোকাত হয়ে পড়েছেন। এজন্যই ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর থেকে নতুন পর্যায়ে শুরু হয়েছে ধরপাকড় এবং দমন-নির্যাতন। ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বাসভবন ও গুলশান কার্যালয়ের ধারেকাছেও কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব অভিযোগ করেছেন, খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে সরকার। একযোগে সারাদেশেও শুরু হয়েছে গ্রেফতারের অভিযান। অনেক নেতা-কর্মীকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে, যাদের পাওয়া যাচ্ছে না তাদের বাসাবাড়িতে রীতিমতো জানান দিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। ফলে গ্রেফতার এড়াতে নেতা-কর্মীরা পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। পাল্লা দিয়ে চলছে মিথ্যা মামলা দায়ের করার অভিযান। ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিকে বানচাল করার লক্ষ্যে শুরু হওয়া দমন-নির্যাতন ও গ্রেফতার ও মামলার মধ্য দিয়ে আসলে সরকারের ফ্যাসিস্ট নীতিরই সর্বশেষ প্রকাশ ঘটেছে।
ঘটনাপ্রবাহে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে একদলীয় বাকশাল শাসনের কথা। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পিতার পথই ধরেছেন। ৫ জানুয়ারি কোনোভাবে সংসদ নির্বাচন করতে পারলেই প্রকৃত উদ্দেশ্যের প্রকাশ ঘটাবেন প্রধানমন্ত্রী। এমন অনুমানকে হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। উদ্বেগের কারণ হলো, বাকশাল অর্থ এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যার অধীনে ক্ষমতাসীন দল ছাড়া দ্বিতীয় কোনো দল থাকতে পারবে না। ভিন্নমতাবলম্বী কোনো রাজনৈতিক দলকে কার্যক্রম চালাতে দেয়া হবে না। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য স্বাধীনতা-পরবর্তী মাত্র সাড়ে তিন বছরে শুধু রক্ষীবাহিনীই বিরোধী দলের ৩৭ হাজারের বেশি নেতা-কর্মিকে হত্যা করেছিল। এর বাইরে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও লাল বাহিনীসহ আওয়ামী শিবিরের হাতেও অনেকের মৃত্যু ঘটেছিল। এসব হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্মূল করা এবং বাকশাল প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়া। এ লক্ষ্যে সেকালের মুজিব সরকারের প্রচন্ড দমন-নির্যাতনে বিরোধী দলের কোমর ভেঙে গিয়েছিল। ফলে শেখ মুজিবের সামনে কোনো প্রতিপক্ষই তখন ছিল না। তেমন এক পরিস্থিতিতেই, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি শেখ মুজিব বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সব দল নিষিদ্ধ করে সর্বময় ক্ষমতা নিয়েছিলেন নিজের হাতে।
বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পিতার পথেই এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। একই উদ্দেশ্যে তিনি বিএনপি ও জামায়াতের মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলগুলোকে নির্মূল করতে চাচ্ছেন। চাচ্ছেন একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় আসতে। সে লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যেই তিনি একের পর এক ফ্যাসিস্ট পদক্ষেপ নিচ্ছেন, জাতিকে নতুন চেহারার বাকশাল দেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। আশার কথা হলো, প্রধানমন্ত্রী চাইলেই সবকিছু তার ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটবে এমন ভাবনা ঠিক নয়। কারণ, বিএনপির নেতৃত্বে দেশে এখন অত্যন্ত শক্তিশালী বিরোধী দল রয়েছে। রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও। সুতরাং শেখ হাসিনার পক্ষে পিতার মতো একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা উল্টো ফলেরও কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া বেগম খালেদা জিয়া বলে রেখেছেন, ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’কে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। আমরা জানি না, প্রধানমন্ত্রী এই কথাটার মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারবেন কি না। তেমন লক্ষণ অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে শুনিয়েছেন, ২৯ ডিসেম্বর তাদের ‘বিজয়ের দিন’। এবারও তারাই ‘বিজয়’ অর্জন করবেন!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন