রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৩

একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার


দেশজুড়ে জনগণ যখন ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ডাকে ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’তে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখনই হঠাৎ করে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগের দিন, গত ২৮ ডিসেম্বর ঘোষিত ইশতেহারের নামও দিয়েছেন আহামরি ধরনের- ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’! ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, গত পাঁচ বছরে তারা অতীতের অন্ধকার ঘুঁচিয়ে বাংলাদেশকে আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সেই সঙ্গে আরো একবার তাকে ‘সেবা’ করার সুযোগ দেয়ার জন্য জনগণের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। ৪৮ পৃষ্ঠার দীর্ঘ এই ইশতেহারে ‘প্রিয় দেশবাসী’কে অনেক আশ্বাস ও অঙ্গীকারের কথাও শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। উল্লেখযোগ্য একটি তথ্য হলো, ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি ‘রূপকল্পÑ২০২১’ উপস্থাপন করেছিলেন। এবার ২১-এর স্থলে এসেছে ৪১। প্রধানমন্ত্রী হাজির করেছেন ‘রূপকল্পÑ২০৪১’। বলেছেন, আরেকবার ‘সেবা’ করার সুযোগ দেয়া হলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তারা মধ্যম আয়ের স্তর পার করে সুখী-সমৃদ্ধ শান্তিপূর্ণ জনপদে পরিণত করবেন। এ লক্ষ্যে বহুবার উচ্চারিত বহু অঙ্গীকারও করেছেন তিনি নতুন করে। দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি ও দুর্বৃত্তায়ন নির্মূল এবং ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া থেকে শুরু করে দ্বিতীয় পদ্মা ও দ্বিতীয় যমুনা সেতু নির্মাণ পর্যন্ত এমন সব বিষয়েই তিনি বলেছেন যেগুলো গত পাঁচ বছরে শিশু-কিশোরদেরও মুখস্ত হয়ে গেছে। অমন অঙ্গীকারের ঘোষণা তিনি দিতেই পারেন। কিন্তু কথা উঠেছে বিশেষ কিছু  কারণে। প্রথম কারণ হলো, ২০০৮-এর ‘রূপকল্পে’ শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন, প্রতিবছর মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের অর্থ-সম্পদের বিবরণী জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। কিন্তু প্রতিবছর দূরে থাকুক, পাঁচ বছরেও তেমন কোনো বিবরণী জানতে পারেনি জনগণ। মনোনয়নপত্রে দেয়া হলফনামার সূত্র ধরে তাদের সামনে বরং উল্টো ধরনের বিবরণীই সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা গেছে, মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদ বেড়েছে অবিশ্বাস্য হারে ও পরিমাণে। মন্ত্রীদের ২৪৩ ভাগ, প্রতিমন্ত্রীদের ৪৬৪ ভাগ এবং সংসদের উপনেতা, চিফ হুইপ ও হুইপদের সম্পদ বেড়েছে ৩০৭১ ভাগ। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে তাক লাগিয়েছেন ডেপুটি স্পিকার। তার সম্পদ বেড়েছে ৪৪৩৫ ভাগ। সে তুলনায় পিছিয়ে থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রয়েছেন তালিকায়। তার সম্পদ বেড়েছে ১৩৬ ভাগ। শেয়ারবাজারের লুণ্ঠন এবং পদ্মাসেতুকেন্দ্রিক হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির মতো তথ্যগুলো নিশ্চয়ই স্মরণ করিয়ে দেয়ার দরকার পড়ে না। পরিবর্তে বলা দরকার, যে দল ও সরকারের নেত্রী নিজেও সম্পদ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় সাফল্যের সঙ্গে অংশ নিয়েছেন সে দলের ‘এগিয়ে যাচ্ছে’ বা ‘রূপকল্প’ ধরনের কোনো ইশতেহারই জনগণকে আকৃষ্ট করতে পারে না।
ইশতেহারে ২৬ দফা অগ্রাধিকার কর্মসূচিও ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ভোটার জনগণের উদ্দেশে আবেদন জানিয়ে বলেছেন, আরেকবার দেশ সেবার সুযোগ দেয়া হলে তারা রাজনীতি থেকে হিংসা, হানাহানি ও সংঘাতের অবসান ঘটাবেন। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে মানুষের আবারও গ্রিক সম্রাট নিরোর সেই বাঁশি বাজানোর কাহিনীই মনে পড়ে গেছে। কারণ, বিগত কয়েক মাস ধরে হত্যা ও গ্রেফতার এবং দমন-নির্যাতনের অভিযান চালানোর ধারাবাহিকতায় গতকাল ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’কে ভ-ুল করার উদ্দেশ্যে বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়াকে অসম্মানিত করাসহ রাজধানীতে যে ভয়ংকর কর্মকা- সরকার চালিয়েছে সে সরকারের প্রধান হিসেবে এত ‘লম্বা’ কথা তার মুখে মানায় না। বড় কথা, এমন এক সময়ে প্রধানমন্ত্রী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন যখন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ঘোষিত তফসিল বাতিলের দাবিতে চলমান অবরোধে সারাদেশ অচল হয়ে পড়েছে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ জন পর্যন্ত ‘নির্বাচিত’ হওয়ার ধুম পড়ে যাওয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে যখন দেশে-বিদেশে ধিক্কার উঠেছে এবং বিভিন্ন রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থা যখন পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ দেশ-বিদেশের কোথাও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন মোটেও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সে কারণে শুধু নয়, সব মিলিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেও শেখ হাসিনা ঘোষিত এই ইশতেহারের ব্যাপারে জনমনে তেমন আগ্রহ তৈরি হয়নি। দুর্নীতি থেকে হত্যা-সন্ত্রাস পর্যন্ত যে কোনো বিষয়কেই উদাহরণ হিসেবে নেয়া হোক না কেন, কোনো একটিতেই পয়েন্ট পাবেন না প্রধানমন্ত্রী। কারণ, দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনা ও বিদ্যুৎ সংকট কাটিয়ে ওঠা থেকে ঘরে ঘরে চাকরি দেয়া এবং দুর্নীতি উচ্ছেদ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা পর্যন্ত হেন কোনো বিষয় নেই যে প্রসঙ্গে অঙ্গীকার ছিল না ২০০৮-এর নির্বাচন উপলক্ষে উপস্থাপিত ‘রূপকল্পÑ২০২১’ নামের ইশতেহারে। বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করা, পুলিশকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার না করা এবং বিচার বিভাগের ‘প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার’ অঙ্গীকার তো বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গেই করেছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু কোনো একটি ক্ষেত্রেই ভালো কিছু করে দেখাতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী। একই কারণে জনসমর্থন অর্জনেও এবার লজ্জাজনকভাবে ব্যর্থ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এজন্যই সুচিন্তিত কৌশলের ভিত্তিতে তারা ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আয়োজন করেছেন, যে নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ কোনো বিরোধী দলই অংশ নিচ্ছে না। নিলে তাকে যুৎসই জবাবই পেতে হতো। আর যা-ই হোক, আবারও ক্ষমতায় তিনি আসতে পারতেন না। সেজন্যই শেখ হাসিনার সরকার এখনো বিরোধী দলকে ফ্যাসিস্ট কায়দায় দমন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ ১৯৭২-৭৫ সময়ের কথা স্মরণ না করে পারছে না, যখন বিরোধী দলের ৩৭ হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল। আমরা অবশ্য চলমান ফ্যাসিস্ট দমন-নির্যাতনের অনিবার্য পরিণাম সম্পর্কে এখনই কিছু বলতে চাই না। তবে একথা অবশ্যই বলা দরকার, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে উপলক্ষ বানিয়ে জনগণের সঙ্গে যথেষ্ট রসিকতাই করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads