সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৩

একজন যতটা নন্দিত, অন্যজন ততটাই বিতর্কিত


আবারো সরকার জিতল না, হেরে গেল গণতন্ত্র। বেগম জিয়া আবারো প্রমাণ করলেন তিনি আপসহীন। গণতন্ত্রের প্রশ্নে তার অবস্থান দৃঢ়। মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি একসাথে কয়েকটি সত্য তুলে ধরল।
ক. সরকার গণতন্ত্রচর্চা করবে না। খ. সরকার-বিরোধী দল, জোট ও ভিন্নমত সহ্য করবে না। গ. একতরফা নির্বাচনের যে পরিকল্পনা সেখান থেকেও সরে আসবে না। ঘ. ক্ষমতার জন্য সরকার যত অনৈতিক কাজই হোক, তা করতে কার্পণ্য করবে না। ঙ. পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি সরকারের পেটোয়া হিসেবে নির্লজ্জভাবে আরো কিছু দিন ব্যবহার হতে থাকবে। চ. প্রেস কাব ও হাইকোর্টের মতো স্পর্শকাতর স্থানও সরকারি টার্গেটের বাইরে থাকবে না।
সাংবাদিক ও আইনজীবীরা আক্রান্ত হয়ে চলমান আন্দোলনকে অর্থবহ করলেন। শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করার এই দৃষ্টান্তও সরকারের কপাল পুড়ল। এত দিন খোলসের ভেতর থাকা আজদাহাতুল্য সরকার স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করল। এটিই আজদাহাকে মৃত্যুতুল্য বিষপান করাবেই। কয়েক দফা টানা অবরোধের পর বিরতি দিয়ে সহিংসতামুক্ত, নাশকতা এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ একটি কর্মসূচি ঘোষণার দায় ছিল বিরোধী দলের। যেভাবে সব নাশকতা ও সহিংসতার জন্য জামায়াত-শিবির, হেফাজত ও বিরোধী দলকে অভিযুক্ত করা হচ্ছিল, তার মোকাবেলায় বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার মেনে কর্মসূচি পালনের তাগিদ ছিল।
বিরোধী জোট প্রমাণ করতে পেরেছে এরা প্রতিবাদী ও সংুব্ধ, কিন্তু হঠকারী নয়। অপর দিকে আওয়ামী লীগ ও সরকার প্রমাণ করেছে, এরা হঠকারি ও চরমমাত্রার ফ্যাসিবাদী। কর্মসূচি ছিল বিরোধী দলের অথচ প্রথম দিনের মতো দ্বিতীয় দিনও অস্ত্র ও লাঠি হাতে রাজপথে মহড়া দিয়েছে সরকারি দল। প্রেস কাবের ঘটনা, হাইকোর্টে পুলিশকে সাক্ষীগোপাল সাজিয়ে বর্বর কর্মীদের ভেতরে ঢোকানোর দৃশ্য, গুলশানে খালেদা জিয়ার পথ ও গতিরোধের জন্য বালুর ট্রাক, নজিরবিহীন পুলিশি বাড়াবাড়ি, সরকার ঘোষিত সর্বাত্মক হরতাল-অবরোধ পালন, ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া, লঞ্চ-ট্রেন-বাস সরকারি নির্দেশে বন্ধ রাখা, দেশজুড়ে গণগ্রেফতার ও তল্লাশি, রাজধানীজুড়ে অঘোষিত ১৪৪ ধারা জারি, সারা দেশ থেকে ঢাকাগামী মানুষের জনস্রোত জোর করে আটকে দেয়ার ঘটনায় সাধারণ মানুষ আরো বিগড়ে গেছে। কারবালায় হুসাইন খুন হলেও মরে যায় এজিদ। বাংলাদেশেও শেখ হাসিনা সরকার গঠন করবে পাতানো ও প্রহসনের নির্বাচনে, রাষ্ট্রশক্তির আনুকূল্যের কারণে সরকারি দল চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি করলেও হেরে যাবে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি, মৃত্যু ঘটবে গণতন্ত্রের।
এখনো আমরা রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্য বুঝতে চাই না। রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কোনো দিন কোনো দল জিততে পারে না; জনগণ ও আন্দোলন কার্যত জিতে যায় ব্যর্থ, দুর্বিনীত, দুর্নীতিবাজ ও স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে কিংবা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়। রাষ্ট্র সব নাগরিকের। সরকার আওয়ামী-বিএনপির কিংবা অন্য কোনো দলেরই হয়ে থাকে। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষে বিরোধী দলের আন্দোলন নতুন মাত্রা পেয়েছে। রাষ্ট্রশক্তির এ অপব্যবহার অচিরেই রাষ্ট্রশক্তি ও সরকারের মধ্যে ফারাকটা আরো স্পষ্ট করে দেবে। তখন জনগণ ও বিরোধী দলের জয় অবশ্যম্ভাবী। নির্বিচারে রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহার আর কত দিন! রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই রাষ্ট্রশক্তির বোধোদয় ঘটতেই হবে।
রাষ্ট্রশক্তির সঠিক ব্যবহার হলে হাইকোর্টে তালা খুলে পুলিশ দলীয় ক্যাডার ও গুণ্ডা ঢুকতে দিত না। আইনজীবীরা বিক্ষোভ করতেন ভেতরে। আওয়ামী লীগ ক্যাডার মিছিল করত রাজপথে। প্রেস কাবে হামলাও হতো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর সরকারদলীয় ক্যাডারদের হামলে পড়ার দৃশ্য দেখতে হতো না। খালেদা জিয়াকেও পুলিশের বাড়াবাড়ির মুখোমুখি দাঁড়াতে হতো না। বিরোধী দলের কর্মসূচি ভণ্ডুল করতে বিরানি-খিচুড়ি খাইয়ে দলীয় ক্যাডার নামানোর প্রয়োজন হতো না। সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে পুলিশকে দেয়া নির্দেশনাই যথেষ্ট হতো। পুলিশ সিদ্ধান্ত নিতে পারত তার কতটুকু যাওয়া দরকার, কতটুকু নয়।
এখন বিরোধী দলের কর্মসূচি পালন করে দিচ্ছে সরকার এবং পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি। অবরুদ্ধ থেকেও বিরোধীদলীয় নেতা তার ঝাঁঝালো ভাষায় বিুব্ধ মনের কথাগুলো বলে জাতিকে আলোড়িত করছেন। অবরুদ্ধ খালেদা জিয়া যেন আরো বেশি শক্তিমান, আরো বেশি প্রতিবাদী ও সোচ্চার। শত সমাবেশ করে যে কথাগুলো তিনি বলতে চাইলেও বলতে পারতেন নাÑ সংুব্ধ মনে নির্ভয়ে সে কথাগুলো তিনি বলেছেন। দেশবাসী তার বক্তব্যে উজ্জীবিত-অনুপ্রাণিত। তিনি চাওয়ার চেয়েও বেশি অর্জন করেছেন, অপর দিকে প্রধানমন্ত্রী নিজেকে আরো বেশি বিতর্কিত করলেন। বিরোধী দল, জোট, সুশীলসমাজ ও পেশাজীবীদের পক্ষ থেকে পাতানো ও একতরফা নির্বাচন বাতিলের দাবি আরো যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণিত হলো। সরকারের ফ্যাসিবাদী চরিত্র আর লুকানো সম্ভব হলো না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে চটজলদি মন্তব্য করা কঠিন। তার পরও বিগত কটা দিনের ঘটনাপ্রবাহ এমন কিছু বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যা সুখকর মন্তব্যের জন্য জুৎসই নয়। সরকার এখন দিশেহারা। রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করেও স্বস্তি পাচ্ছে না। দলীয় ক্যাডার বাহিনীকে লাঠি হাতে নামিয়েও ভরসা পাচ্ছে না। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের দৌড়ের ওপর রাখা ছাড়াও গণগ্রেফতার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। বিরোধী দলের প্রায় সব নেতা হাজার হাজার মামলা মাথায় নিয়ে হয় জেলে রয়েছেন, নয়তো স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকারের ভাষা হচ্ছে, দেখামাত্র গুলি, নজরে আসামাত্রই গ্রেফতার। জেলখানাগুলো ঠাঁই নেই অবস্থায় রয়েছে। দেশের মানুষের কোনো নিরাপত্তা নেই। স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা পাওয়াও কঠিন। তার ওপর দেশজুড়ে স্থবিরতা নেমে এসেছে। ভয়ভীতি আর নিরাপত্তাহীনতা গ্রাস করে আছে সমগ্র জাতিকে। যৌথবাহিনীর অস্বচ্ছ কর্মকাণ্ডে জনজীবনে যে বিভীষিকা নেমে এসেছে, তা রীতিমতো ভয়াবহ এক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। জনগণ যেন এখন কোনো এক ত্রাণকর্তার জন্য অপেক্ষমাণ। একটা জাতির জন্য এমন গুমোট ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
দীপুমণির বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে, তিনি খালেদা জিয়াকে পাকিস্তানি বানিয়ে সব সমস্যার সমাধান করতে চান। অথচ সবার দৃষ্টি এখন গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ার একটি বাড়ির দিকে। বিশ্ববাসীর নজরও রয়েছে বেগম জিয়ার সেই বাড়িকে ঘিরে। এক দিকে সরকারের সীমাহীন বাড়াবাড়ি, অন্য দিকে খালেদা জিয়ার নির্দেশনা। সারা দেশ থেকে রাজধানী ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। জনবিচ্ছিন্ন সরকার পরিচালিত হচ্ছে রাষ্ট্রশক্তির জোরে। প্রতিবাদী জনতা অনুসরণ করছে বিরোধীদলীয় নেতার আদেশ-নির্দেশ। একটি দেশের একজন নেতা বা নেত্রী যখন সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেন, দল-মত নির্বিশেষে সবাই যখন তার জন্য প্রহর গোনেন, তখন দেশ-জাতি একটা পরিবর্তনের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। তখন রাষ্ট্রশক্তি এবং সরকার আলাদা হয়ে যেতে বাধ্য হয়। জনগণের বিজয় তখন শুধুই অপেক্ষার বিষয়। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads