ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকার জনগণের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এতোদিন র্যাব-পুলিশ-বিজিবি লড়ছিল জনগণের বিরুদ্ধে। সরাসরি গুলী করে হত্যা করছিলো সাধারণ মানুষকে। এখন তাদের দিয়েই আবার গঠন করেছে দায়-দায়িত্ববিহীন যৌথ বাহিনী। এসব হত্যাকা- দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় ধরনের বিধান অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কে কাকে শাস্তি দেয়! কে কার বিচার করে! সরকারি বাহিনীর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ সমানে চলছে। এর কোন বিচার নেই। জনগণ এরকম পরিস্থিতির শিকার হলে প্রথমে পুলিশের শরণাপন্ন হয়। তাতে যদি প্রতিকার পাওয়া না যায় তাহলে উচ্চতর আদালতের দারস্থ হয়। সরকারের কাছে নিরাপত্তা দাবি করে। আর তাতেও যদি প্রতিকার না হয়, মার খেতে খেতে যদি জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায় তাহলে তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আর বর্তমান সরকার সেই প্রতিরোধের নাম দিয়েছে জঙ্গিবাদের উত্থান।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে হত্যা বা ফাঁসির রায় কার্যকর করা গোটা দেশবাসী এবং বিশ্ববাসীকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া কখনও সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচার বলে মনে করেনি পৃথিবীর কেউ। জাতিসংঘও নয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান নাবি পিল্লাই সরকারকে খুব স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে যে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনের সনদ স্বাক্ষর করেছে। সুতরাং তাদের মানবাধিকার কমিশনের সনদগুলো অবশ্যই মানতে হবে। তা না হলে তারা সংশ্লিষ্ট দেশের রাজনীতিবিদদের সমন করতে পারে ও বিচার করতে পারে। এই সতর্কবাণীকে থোড়াই পরোয়া করেছে শেখ হাসিনা সরকার। পৃথিবীর সকল মানবাধিকার কমিশন সরকারকে সতর্ক করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব পর্যন্ত বিতর্কিত বিচারের মাধ্যমে এই ফাঁসির রায় কার্যকর করায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এই ফাঁসির রায় কার্যকর না করার অনুরোধ করেছিলেন। সে অনুরোধ সরকার রাখেনি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মুখে মুখে বলছে যে, এ তো ফাঁসি নয়, একজন মানুষকে আটকে রেখে নির্মম হত্যাকা-।
দেশের বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য দীর্ঘকাল ধরে আন্দোলন করে আসছে। প্রথমে তা অনুরোধ, আবেদনের পর্যায়ে ছিলো। এখন আর তা নেই। গত মাস দুই ধরে তারা ধারাবাহিকভাবে রাজপথ-রেলপথ-নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। এই অবরোধে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে রাজধানী। এখন সরকার রাজধানীতে বন্দী। শাহবাগে কিছু লাফাঙ্গা জোগাড় করে তাকে যদি এদেশের জনগণ দাবি করা হয়। তাহলে সেটি হবে মারাত্মক ভুল। এখানে যদি টাকা-পয়সা দিয়ে টোকাই, লুঙ্গী পরা মজুর, গেঞ্জি গায়ে মানুষ এনে হাজির করা হয়। আর কিছু সুবেশ অশিক্ষিত তরুণ এসে হাজির হয়, তবে তাকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল কিছু বলে অভিহিত করা যাবে না। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের দাবির সঙ্গে তাদের দাবি বা উল্লাসের কোন সম্পর্কই নেই। তাও বুঝতাম, এই যে সরকার প্রতিদিন পাখির মতো গুলী করে ডজন ডজন মানুষকে হত্যা করছে, যদি ঐ সমাবেশ থেকে তারও প্রতিবাদের ধ্বনি উঠতো। কিন্তু না, সেই প্রতিবাদ ধ্বনি শাহবাগের তরুণেরা একবারও উচ্চারণ করেনি।
আমরাও তরুণ ছিলাম। একটি হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে সারাদেশে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতাম। হরতাল, অবরোধ ডাকতাম। কিন্তু শাহবাগের তরুণেরা একবারের জন্য সে প্রতিবাদ ধ্বনি উচ্চারণ করলো না। এ কেমন তারুণ্য! তবে কি শাহবাগে সমবেত তরুণেরাই বাংলাদেশের মানুষ? বাকি ১৫ কোটি ৯৯ লাখ ৯৫ হাজার লোক এদেশে পরবাসী? আর পরবাসী হলেও তো সরকার নির্বিচারে তাদের হত্যা করতে পারে না। এই সরকার আসলে আমাদেরকে পরবাসী বলে বিবেচনা করছে। অথচ সরকার ও শাহবাগীরা যাদের পরবাসী বলে চিন্তা করছেন, তারা এদেশের প্রকৃত জনগণ। তারা প্রতিদিন রুখে দাঁড়ায় না। জমিতে লাঙল ঠেলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তারা এই সুবেশ নাগরিকদের জন্য ফসল ফলায়। তারা কারখানার চাকা ঘোরায়। অথৈ সমুদ্রে নৌকা ভাসিয়ে জলের ঐশ্বর্য রূপালী মাছ ডাঙায় তুলে আনে। জনগণ তারাই। তাদের দোষ তারা ধর্মে মুসলমান।
একথা আর কতোবার বলবো যে, এই ভূখ-ের মানুষ গরিষ্ঠ সংখ্যায় মুসলমান ছিলো বলে এটি বাংলাদেশ হয়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম হয়েছে। হয়েছে বললে কম বলা হয়। লাঙল, কারখানা, জাল ফেলে দিয়ে তারা অস্ত্র ধরেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীকে ঠেলতে ঠেলতে গ্রাম-গঞ্জ থেকে শহরে নিয়ে এসেছে। ভারতের বড়াই বড়। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সহায়তা করেছে। আমাদের আশ্রয় দিয়ে ভারত যা খরচ করেছে তার চারগুণ আন্তর্জাতিক সহায়তা তহবিল থেকে লাভ করেছে। আর যুদ্ধ করেছে ১১ দিন। ভারত এই যুদ্ধে অংশ না নিলেও এদেশের লড়াকু মানুষ হয়তো আর দুই এক মাসের মধ্যেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করতো। ভারত মাত্র ১১ দিন যুদ্ধ করেছে। তাও বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য নয়। পাকিস্তানকে বিভক্ত করার জন্য। সেই ১১ দিনের যুদ্ধের ক্রেডিটে ভারত এখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব গিলে খাওয়ার চেষ্টা করছে। সিকিমের লেন্দুপ দর্জি আর মণিপুরের প্রিয়ব্রাত্তার মতো মেরুদ-হীন ভারতের দাসানুদাস সরকার এখন ক্ষমতায় আছে। শোনা যায়, ভারত নাকি এদেশে ৬০ লক্ষ দালাল তৈরি করেছে। এই দালালদের কাজই হলো, বাংলাদেশকে কীভাবে ভারতের পদানত করা যায়।
এখন এদেশের মর্যাদা ভারতের একটি প্রদেশের চেয়েও অধম অবস্থায় চলে গেছে। ভারতের বড় বড় কার্গো বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিতাস নদীতে মাসের পর মাস বাঁধ দিয়ে রেখেছে সরকার। কিন্তু এটি ভারতের কোনো অঙ্গরাজ্যে সম্ভব নয়। সে রকম কাজ যদি ভারত করতে যায় তাহলে সেখানে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। টিপাইমুখে ভারত যে বাঁধ দেবার পরিকল্পনা করেছে, তা নিয়ে ভারতব্যাপী আন্দোলন সংগ্রাম হচ্ছে। পরিবেশবাদীরা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সে আন্দোলন সংগ্রামে শরীক হচ্ছে। এই সংগ্রামীরা বাংলাদেশেও এসেছিলেন। এসে সিলেট অঞ্চলেও গেছেন। সেখানেও বলেছেন, আপনারা জেগে উঠুন। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। আমরা সঙ্গে আছি। একসঙ্গে লড়াই করে এই বাঁধ ঠেকাতে হবে। অথচ সরকারের পানিমন্ত্রী বললেন, আগে বাঁধ দিক তো। তারপর দেখা যাবে কী ক্ষতি হয়। এমন অথর্ব লাফাঙ্গাও এদেশে মন্ত্রী হয়! এতে রাগান্বিত হয়ে একজন সাবেক সিএসপি সচিব মন্তব্য করেছিলেন, এই মন্ত্রীকে এখনই ঘাড় ধরে মন্ত্রিসভা থেকে বের করে দেয়া উচিত।
বাংলাদেশের অবস্থা এখন অনেকটা নেপালের মতো হয়ে গেছে। ভারত এখানকার গার্মেন্ট শিল্প ধ্বংস করে দিচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে নাশকতা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশীয় উদ্যোক্তাদের হতাশ করে দিচ্ছে। আর সেসব শিল্প ক্রমেই চলে যাচ্ছে ভারতীয়দের হাতে, যেখানে এদেশেই লাখ লাখ শিক্ষিত যুবক বেকার। সেখানে লাখ লাখ ভারতীয় যুবক উচ্চপদে চাকরি করছে। আর কয়েক দিন আগে এক আজব ঘটনা লক্ষ্য করলাম। একজন স্কুটার ড্রাইভার হিন্দিতে কথা বলছিলো। জিজ্ঞেস করলাম, হিন্দিতে কথা বলছো, তোমার বাড়ি কোথায়? সে নির্দ্বিধায় অকপটে বললো, পাঞ্জাবে। জিজ্ঞেস করলাম, এখানে এসেছো কেনো? বললো, এখানে স্কুটার চালিয়ে ভারতের চেয়ে তিন গুণ উপার্জন করা যায়। সেজন্য এসেছি। ঘটনাটা যদি সীমান্তে হতো তাহলে হয়তো এতো বেশি গায়ে লাগতো না। কিন্তু ঘটনাটি ঢাকা শহরে। এরকম কতো লাখ স্কুটার ড্রাইভার বাংলাদেশী কতো স্কুটার ড্রাইভারের জীবিকা কেড়ে নিচ্ছে, সে কথা বলতে পারি না।
এভাবে সরকার আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অবস্থাকে ক্রমেই ভারতের অঙ্গরাজ্যের মর্যাদায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছে। এটাই ভারত চায়। শেখ হাসিনা সরকারের ভারত তোষণ নীতির ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
যেকথা বলছিলাম তা হলো, পূর্ব বাংলার মানুষ হাজার বছর ধরে আলাদা জাতি হিসেবে গড়ে উঠেছে। ৮০০ সালের মধ্যে এদেশে মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেছে। দ্বাদশ শতাব্দীতে এসে পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের মানুষ প্রায় একযোগে ইসলাম গ্রহণ করে। ফলে তাদের সংস্কৃতি, রুচি, আচার-আচরণের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এই যে ইসলাম গ্রহণ করলো তারও কারণ ছিলো। আর তা হচ্ছে নদী। কারণ নদী, সমুদ্র, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করেই এই জনপদের মানুষকে পরস্পরের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয়েছে। ইসলাম সাম্যের ধর্ম। সে কারণে সকল মানুষ পরস্পরের ভ্রাতৃত্ববোধ থেকে ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় নিয়েছে। ভারত বিভাগের প্রশ্ন যখন উঠলো তখন বর্ণ হিন্দুদের দ্বারা নিপীড়িত এই অঞ্চলের মানুষ সেই অত্যাচার নিপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলো। সেটা এমনি এমনি নয়। আমাদের পূর্বপুরুষেরা সেটা নির্ধারণ করেছিলেন ভোটের মাধ্যমে। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে যখন বনিবনা হলো না, তখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলো। সে সময় তো মওলানা ভাসানী পশ্চিম বঙ্গের নেতাদের ডাক দিয়েছিলেন, আসুন একসাথে লড়াই করি। স্বাধীন এক বাংলা প্রতিষ্ঠা বরি। কিন্তু পশ্চিম বঙ্গের নেতারা সে প্রস্তাবকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারও কারণ ছিলো। কারণ পশ্চিম বঙ্গের নেতারা ভারতের সাথে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছিলেন। আমাদের লড়াই আমাদেরই করতে হয়েছে। এই ইতিহাসও কম বিস্ময়কর নয় যে, দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশের মানুষই যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। অন্যরা তা করেছে আলোচনার টেবিলে বসে।
সেই লড়াকু জাতিকে শেখ হাসিনা সরকার পাখির মতো গুলী করে হত্যা করে শাসন ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছে। কিন্তু আজ প্রায় দু’মাস ধরে প্রতিবাদে প্রতিরোধে উত্তাল দেশ। রাজধানীর বাইরে যেতে পারছে না সরকার। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে। তারা এসব অস্ত্রের নল ঘুরিয়ে যারা গুলী ছোটাচ্ছে তাদের দিকেই ফিরিয়ে ধরতে পারে। সময় থাকতে সাবধান হওয়াই ভালো।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন