বিএনপির চেয়ারপারসন ও ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া চলমান সংকট কাটিয়ে উঠে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে একগুঁয়েমি ছেড়ে শান্তি ও সমঝোতার পথে আসার জন্য আবারও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গত ১২ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, এজন্য সরকারকে নির্বাচনের ঘোষিত তফসিল স্থগিত ও সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে এবং বিরোধী দলের গ্রেফতারকৃত নেতা-কর্মীদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবির পুনরাবৃত্তি করার পাশাপাশি সরকারের প্রচ- দমন-নির্যাতন, হত্যা এবং অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টারও তীব্র সমালোচনা করেছেন বেগম জিয়া। তিনি বলেছেন, সরকারের হঠকারিতার পরিণতিতে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আজ ধ্বংসের কিনারায় এসে পৌঁছেছে। কিন্তু সরকার শুধু বিরোধী দলের দাবিই প্রত্যাখ্যান করে চলছে না, একই সঙ্গে সংকট নিরসন ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নেয়া সকল উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাকেও নস্যাৎ করে দিচ্ছে। বেগম জিয়া প্রসঙ্গক্রমে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা ও রাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। সরকারকে বলেছেন অবিলম্বে দমন-নিপীড়ন বন্ধ করে সমঝোতার পথে ফিরে আসতে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারের উস্কানিতে দেশজুড়ে চলমান সহিংসতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের পরিপ্রেক্ষিতে সমঝোতার আহবানসহ বিবৃতি দেয়ার মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়া প্রকৃত দেশপ্রেমিক জাতীয় নেত্রীর পরিচয় দিয়েছেন। সরকারের প্রতি আহবান জানানোর পাশাপাশি ভারতের প্রতি তার আহবান এসেছে বিবৃতির একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হিসেবে। রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জাতিসংঘের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও গণচীনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার উল্লেখ করে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দাবি, অনুভূতি ও মনোভাবের প্রতি সম্মান দেখানোর এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থানের সঙ্গে একাত্ম থাকার জন্য তিনি ভারতের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। বেগম খালেদা জিয়া বিশেষ করে ভারতের প্রতি কেন পৃথকভাবে এমন আহবান জানিয়েছেন তার কারণ সম্পর্কে নিশ্চয়ই বিস্তারিত বর্ণনার দরকার পড়ে না। সংক্ষেপে বরং বলা যায়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার সমগ্র প্রক্রিয়ায় ভারতের কর্মকা- প্রাথমিক দিনগুলোতেই প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। ক্ষমতায় আসার পর থেকে সরকারও সর্বতোভাবে শুধু ভারতের স্বার্থেই ভূমিকা পালন করে চলেছে। ফলে দেশটির সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের সখ্যের ও আনুগত্যের বিষয়টিকেও গোপন রাখা যায়নি। ভারত যে আওয়ামী লীগকেই আবারও ক্ষমতায় আনতে চায় সে সম্পর্কেও বিভিন্ন উপলক্ষে খোদ ভারতীয়রাই জানান দিয়েছেন। সর্বশেষ একটি উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক সফরকালে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং-এর তৎপরতার কথা স্মরণ করা যায়। একজন সরকারি কর্মকর্তা হলেও সুজাতা সিং তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য অনুরোধের আড়ালে চাপ সৃষ্টি করে গেছেন। এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের কাছে তথ্য প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচন যাতে একতরফা হিসেবে বিতর্কিত না হয়ে বরং গ্রহণযোগ্য হতে পারে সেজন্য নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য ভারতের পররাষ্ট্র সচিব তাকে চাপ বা তাগিদ দিয়ে গেছেন। তিনি যে সম্মত হননি সে কথাটাও জানিয়েছেন এরশাদ। এ থেকেও পরিষ্কার হয়েছে, ভারত ব্যস্ত রয়েছে কেবলই আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় আনার জন্য। দেশটির কাছে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষার কোনো মূল্যই নেই।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, গণচীন ও জাতিসংঘসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থা কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যকেই যুক্তিসঙ্গত মনে করেছে। একই কারণে তারা এমনভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে আগামী নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটসহ সব দল অংশ নেয় এবং সে নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। আমরা মনে করি, ভারতের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থান ও ভূমিকার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার আহবান জানানোর মধ্য দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া আরো একবার দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রীর অবদানই রেখেছেন। কারণ, এ সত্য এখন আর গোপন নেই যে, মূলত ভারতের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই সরকার একতরফা তথা একদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে এগিয়ে চলেছে। বড়কথা, ভারতও গোপনে ও প্রকাশ্যে সরকারের পক্ষেই ভূমিকা পালন করছে। আহবান জানানোর মধ্য দিয়ে বেগম জিয়া তাই বলে কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি। তিনি বরং এমন পরামর্শই দিয়েছেন যাতে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মধ্যে ভারত সম্পর্কে আগে থেকে বিদ্যমান নেতিবাচক মনোভাব আরো গভীর না হয়। জনগণ যাতে ভারতকে সরকারের পৃষ্ঠপোষক মনে না করে। বলা বাহুল্য, বেগম জিয়ার আহবানে সাড়া দিলে ভারতই বেশি লাভবান হবে। কারণ, বাংলাদেশের মতো ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে গেলে জনগণও ভারতকে সরকারের মতোই শত্রু বা প্রতিপক্ষ মনে করবে।
উদ্বেগের কারণ হলো, বেগম খালেদা জিয়া দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিলেও সরকার কিন্তু এখনো গণবিরোধী অবস্থানেই রয়ে গেছে। দমন-নির্যাতন চালানোর এবং বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ঢালাওভাবে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে এ কথাটাই বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, বিরোধী দল যতো নমনীয়তা ও সদিচ্ছাই দেখাক না কেন, সরকার সামান্যও ছাড় দেবে না। আমরা মনে করি, সরকার যে নীতি-কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে এবং যে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে দমন-নির্যাতন চালাচ্ছে তার ফলে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা ও একদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। এভাবে রাজনৈতিক সংকটই শুধু আরো ঘনীভূত হবে না, সারা দেশে সহিংসতাও অনেক বেড়ে যাবে। এ ধরনের পরিস্থিতি অবশ্যই আশংকাজনক এবং জনগণের আকাক্সক্ষার পরিপন্থী। এজন্যই সরকারের উচিত রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার এবং সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সদিচ্ছার প্রমাণ দেয়া। প্রধানমন্ত্রীর উচিত বেগম জিয়ার আহবানে সাড়া দিয়ে অবিলম্বে সভা-সমাবেশের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া, বিরোধী দলের ওপর হামলা ও নির্যাতন বন্ধ করা, গণমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ বন্ধ করা এবং বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাব অনুযায়ী সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের বিধান যুক্ত করা। বলা দরকার, সময় যেহেতু দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে সেহেতু প্রধানমন্ত্রীকেও উদ্যোগ নিতে হবে আজকালের মধ্যেই।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন