বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৩

জনতার বিজয় অনিবার্য


আজিজুল বারী হেলাল

চলমান সহিংস আন্দোলন বা পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে? অথবা চলমান আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ও সহিংসতার কারণ কী? এ নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক তোলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও অনুগত সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীরা টিভি টকশো ও গণমাধ্যমে উপস্থিত হয়ে শান্তির কথিত সুমহান বাণী যেমন আন্দোলনে সহিংসতা কেন?’, ‘সাধারণ জনতা কেন ভুক্তভোগী?’ এমন প্রচারে তৎপর হয়ে উঠেছেন। এসব প্রচারণার উদ্দেশ্য হচ্ছে, জোরপূর্বক ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা যে অন্যায় এবং আজকের সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণ তা জনগণকে বেমালুম ভুলিয়ে দেয়া। জনগণের দৃষ্টিকে অন্যত্র সরিয়ে সহজে নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দেয়া। যেন এক ঢিলে দুই পাখি শিকার। পুরনো এ খেলার জবাবে দক্ষিণ বাংলার গ্রামীণ জনপদে বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদের তুলনা চলে। টাউট কিসিমের লোক যখন গ্রামের সহজ সরল মানুষকে ভুল বুঝিয়ে কোনো স্বার্থসিদ্ধি করতে নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয়। তখন ওই সরল মানুষই সেটা বুঝতে পেরে ব্যঙ্গ করে স্থানীয় ভাষায় বলেÑ ‘ওভাবে সুপারি পাড়া যাবে           না-নে’, অর্থাৎ ডালপালাহীন সরু লম্বা গাছ থেকে যেমন সুপারি সংগ্রহ সহজ নয়, তেমনি জোরপূর্বক ক্ষমতায় থেকে জনগণকে ভুল বুঝিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়াও সম্ভব নয়।
নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা একটি মীমাংসিত সিদ্ধান্ত, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থনে প্রতিষ্ঠিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও একসময়ের আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সহযোগী জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা ছিল। জনসমর্থিত ও উপযুক্ত এই ব্যবস্থাকে বাতিল করে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার জোরপূর্বক নির্বাচন প্রচেষ্টাই আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এই মূল কারণ এড়িয়ে শুধু সহিংসতার বিবরণ এখন তুলে ধরা হচ্ছে।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতকে উপেক্ষা করে পাক শাসকগোষ্ঠী নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে সামরিক কায়দায় নিরীহ জনগণের ওপর আক্রমণ, হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ অগ্নিসংযোগ করেছিল। প্রতিবাদে বাংলার স্বাধীনতাকামী দামাল সন্তানেরা যখন অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। জনগণের এই সংগ্রামে কত সহস্র লক্ষ তাজা প্রাণ ঝরে গেল, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হলো, তখন অবৈধ পাক শাসকগোষ্ঠী ও তাদের এদেশীয় দালালেরা আজকের মতোই ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার অন্যায়কে বড় করে না দেখে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে দায়ী করে, জনতার আন্দোলনকে সহিংস অমানবিক এমনকি ধর্মহীন বলে অপপ্রচার করেছিল।
নব্বইয়ের দশকে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিল। টানা নয় বছর প্রতিবাদী ছাত্রজনতার ওপর দমনপীড়ন চালাল। একসময় প্রচণ্ড বিক্ষোভে যখন ছাত্রজনতা ফেটে পড়ে, এর ফল হিসেবে প্রাণ বিসর্জন দিতে হলো কত তাজা তরুণের। কত শত সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ঘটল তখনো আজকের মতো সামরিক সরকার ও তার দোসররা তাদের অন্যায়কে নগণ্য বিবেচনা করে গণ-আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট সহিংসতার জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে দায়ী করে ছাত্রজনতার আন্দোলনকে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস বলে অপপ্রচার করে।
শেখ হাসিনা ও তার অনুগামীরা নতুন বোতলে পুরনো সেই মদ একইভাবে জাতির সামনে পরিবেশন করছে। একচেটিয়া ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ইচ্ছেমতো সংবিধানকে কাটাছেঁড়া ও বিরোধী জনমতকে উপেক্ষা করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের মতো বহুল প্রচলিত ও জনসমর্থিত ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে পুরনো বাকশালী ব্যবস্থার উদ্যোগ বিরোধী দল ও সচেতন জনগণ কখনো মেনে নেয়নি। সভা-সেমিনার, পত্রপত্রিকা ও রাজপথে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করে সরকারকে বারবার সতর্ক করা হয় তখনো বিরোধীদের ওপর হয়েছে দমনপীড়ন। ধরণীর ধূলিতে ক্রমাগত পদাঘাত করলে ধূলিও ক্ষিপ্ত হয়ে ছিটকে ওপরে এসে কাপড় নোংরা করে, তখন তো আর ধূলিকে দোষ দেয়া যায় না।
বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আকাক্সা প্রতিষ্ঠায় পৃথিবীর কোনো দেশে কখনোই কোনো আন্দোলন হয়নি যাকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বলে চালিয়ে দেয়া যায়, এমনকি মহাত্মা গান্ধীর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনও শেষ পর্যন্ত অহিংস ছিল না। জনগণের অধিকার আদায়ে বা জনসমর্থিত কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগে প্রতিবাদী জনগণের বিক্ষোভ, ক্রোধ, আক্রোশ যে সহিংসতায় রূপ নেয়, এটাই স্বাভাবিক ও আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য। স্বৈরাচারী শাসকেরা তা জানে না, এটা মনে করলে ভুল হবে। তারা জানে এবং কখনো কখনো সহিংসতাকে উসকে দেয় এবং নিজেরাই সহিংস ঘটনা ঘটিয়ে আন্দোলনকারী রাজনৈতিক শক্তিকে দায়ী করে জনগণের সমর্থন ও সমবেদনা সংগ্রহে সচেষ্ট হয়। সম্প্রতি একটি টিভি টকশোতে নিউএজ সম্পাদক নুরুল কবীর বলেছেন, যে গুলিস্তান-নরসিংদী রুটের একটি বিআরটিসি বাস কিভাবে আজিমপুরে অগ্নিদগ্ধ হয়। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাসটি কিভাবে দূরবর্তী স্থান অর্থাৎ আজিমপুরে জোরপূর্বক নিয়ে যায়। তিনি যথার্থই সরকারি কোনো সংস্থার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন অনলাইন সংবাদমাধ্যমে একজন পুলিশের এসআইর বরাতে জানা যায়, জামায়াতের ডাকা মার্চ মাসের একটি হরতালে সদরঘাট থেকে মিরপুরগামী বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাস থেকে পরপর দুটি ককটেল বিস্ফোরণ হয়। জুলাই মাসে বিরোধীদলীয় নেত্রীর সরকারি গাড়িকে সংসদ ভবনের সামনে ধাক্কা দেয় বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাস। পুলিশের ডেপুটি সার্জনের বরাতে তা জানা যায়। সম্প্রতি শাহবাগে যে বাসটি সাংবাদিক ও আইনজীবীসহ ১৮ জন দগ্ধ হলো। মারা গেল কয়েকজন। সেখানেও অগ্নিদগ্ধ বাসটি ছিল বিহঙ্গ পরিবহনের। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিহঙ্গ পরিবহন সংস্থাটির মালিক আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন শীর্ষপর্যায়ের নেতা। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিভিন্ন সময় বিরোধী দলের আন্দোলনকে কটাক্ষ করে উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। শেখ হাসিনা নিজেই বিরোধী দলের প্রতি রাজপথে নামার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে প্রমাণ করেছেন, তাদের অপকর্ম আড়াল করতে রাজপথে সহিংসতা শেখ হাসিনার খুব প্রয়োজন।
অতি সম্প্রতি প্রথম আলোর রিপোর্টে বলা হয়, তাদের উদ্যোগে পরিচালিত জনমত জরিপে শতকরা প্রায় ৯১ ভাগ জনতা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে সমর্থন ও মতপ্রকাশ করে। ওই পত্রিকা আরো প্রকাশ করে এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে বিএনপি শতকরা ৫৩ ভাগ ভোট পাবে আর আওয়ামী লীগ মাত্র শতকরা ২৮ ভাগ জনসমর্থন আদায় করতে সক্ষম হবে। প্রথম আলো পত্রিকায় এই রিপোর্টের পক্ষে যৌক্তিক উদাহরণ হলো গত চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের সব কটিতে বিপুল বিজয়। সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো নবগঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করলেও বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কু দল থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বড় ব্যবধানে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করে। সুতরাং স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যেÑ শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয় জেনেই বিএনপিকে বাদ দিয়ে একদলীয় নির্বাচনে মেতে উঠেছেন। জনগণের আকাক্সা ও ইচ্ছার প্রতিফলনে ভীত হয়ে আত্মরক্ষার্থে রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে নিজেরা পুনরায় ক্ষমতায় থাকতে চান। শেখ হাসিনা নিজেও চান না বিএনপি নির্বাচনে আসুক। এ জন্য শুধু নিজে সরকারপ্রধান থেকেও আশ্বস্ত হতে পারেননি নিজের পছন্দমতো মেরুদণ্ড হীন একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে। সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট এই নির্বাচন কমিশন বিরোধী দলের সাথে আলোচনা ছাড়াই তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার দিন ধার্য করে। উদ্দেশ্য বিপুল জনপ্রিয়তার প্রধান বিরোধী দল ইচ্ছা থাকলেও যেন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে।
সরকারের স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে চাতুর্যের সাথে সহিংস বানিয়ে, সরকার আন্দোলনকামী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে মামলা ও হামলা অব্যাহত রাখে। সরকার তার নিজের অন্যায়কে স্বীকার না করে আন্দোলনের সহিংসতাকে মুখ্য আলোচনায় এনে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads