গুরুতর অনিশ্চয়তার মুখে নিক্ষিপ্ত হয়েছে নির্বাচন। ততোধিক গুরুতর অনিশ্চয়তার মুখে নিক্ষিপ্ত হয়েছে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা। এখন তো আর এই বিষয়টি গোপন নয়। পথে ঘাটে শুনবেন একই কথা। বাসে অফিসে, রেষ্টুরেন্টে শুনবেন একই কথা। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কি হবে? গত শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ঘটনা প্রবাহ যেভাবে গড়াচ্ছিল সেগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যে, দেশে আর নির্বাচন হবে না এবং অতি সহসাই জরুরি অবস্থা জারি হবে। জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার সাথে সাথেই বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থে সেনাবাহিনী ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসবে।
এই রকম একটি পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছিল জেনারেল এরশাদের একটি আকস্মিক সিদ্ধান্তে। সকলেই জানেন যে, অনেক নাটক এবং ডিগবাজির পর অনেক স্ববিরোধী কথার পর এরশাদ শেখ হাসিনার নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন এবং তার দল হাসিনার মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন। অথচ তার ঠিক ৪৮ ঘন্টা পর এরশাদ হঠাৎ করে বেঁকে বসেন। বলেন যে, তিনি নির্বাচনে যাবেন না এবং তার দলের যেসব সদস্য হাসিনার মন্ত্রীসভায় যোগদান করেছেন তাদেরকে পদত্যাগ করতে হবে। তিনি আরো বলেন যে, তার দলের তরফ থেকে যারা ইলেকশন করার জন্য নমিনেশন পেপার দাখিল করেছেন, তাদেরকে সেই নমিনেশন পেপার প্রত্যাহারের জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আরো জানান যে, যারা মন্ত্রিসভায় যোগদান করেছেন তাদেরকে অবিলম্বে পদত্যাগ করার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। সাংবাদিকদের মধ্যে তার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক দ্বিধাদন্দ্ব ছিল। তারা বলেই ফেলেন যে তার মন্ত্রীদের ভেতর ২/৩ জন তো পদত্যাগ করতে চান না। সে ক্ষেত্রে কি হবে? এরশাদ দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, তাদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অন্য কথায় তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।
দুই
তার এসব ঘোষণার পর থেকে শুরু হয় ভানুমতির খেল। তার আপন ভাই বাণিজ্য মন্ত্রী জি.এম কাদের বড় ভাইয়ের নির্দেশের পরেও সেক্রেটারিয়েটে গিয়ে অফিস করেন। তিনি যখন এই নির্দেশ দেন তখন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং জিয়াউদ্দিন বাবলু তার পাশে ছিলেন না। এরা কেউ পদত্যাগে আগ্রহী নন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ঘটে তখন যখন তিনজন মন্ত্রী এরশাদের নির্দেশের পর প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে যান। ধারণা করা হয়েছিল যে এরা মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর নিকট দাখিল করতে যাচ্ছেন। সংবিধান বলে যে, কোন মন্ত্রী পদত্যাগ করে যদি সেই পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতে অর্পণ করেন তখন সেই পদত্যাগপত্র তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়ে যায়। অফিসিয়াল আনুষ্ঠানিকতা হলো এই যে, প্রধানমন্ত্রী সেই পদত্যাগপত্র প্রেসিডেন্টের নিকট পাঠাবেন। প্রেসিডেন্ট সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন। মন্ত্রীদের কিন্তু প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত দৌড়াতে হয় না। প্রেসিডেন্ট পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলেন কি না সেটি নিয়েও তাদেরকে মাথা ঘামাতে হয় না। প্রধানমন্ত্রীর হাতে পদত্যাগপত্র অর্পণ করতে পারলেই তারা খালাস। এটিই হলো সংবিধানের বিধান।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, ¯্রােত উলটো দিকে বইছে। তিন মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেলেন। আড়াই ঘণ্টা ধরে গপসপ করলেন। চা বিস্কুট খেলেন। আড়াই ঘণ্টা পর যখন বেরিয়ে এলেন তখন কিন্তু পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর নিকট জমা দিলেন না। তারা ফিরে এলেন তাদের নেতা এরশাদ সাহেবের কাছে। শুরু হলো নাটক। বোঝা গেল, বিরোধী দলের সাথে সরকারি দলের সংলাপ হোক আর নাই হোক, জাতীয় পার্টির মন্ত্রিত্বলোভীদের সাথে সংলাপ শুরু হয়ে গেছে। শুধু এরশাদকে দোষ দিয়ে লাভ কি? বলতে গেলে ওরা সবাই একই পদের। মাত্র একমাসের জন্য মন্ত্রী হয়েছেন। সেই মন্ত্রিত্ব ছাড়তে এতই কষ্ট?
তিন
যাই হোক, বোঝা গেল, এরশাদের নির্দেশ ওরা পুরাপুরি মানছেন না। অবশেষে বললেন যে, ৭ জনের মধ্যে ৫ জন এরশাদের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। ২ জন দেননি। যারা দেননি তারা হলেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়া উদ্দিন বাবলু। এই পর্যায়ে একটি নতুন সংবাদ প্রচারিত হলো। বলা হলো যে, প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ সিঙ্গাপুর আছেন। শুক্রবার রাতে তিনি ঢাকায় ফিরবেন। প্রেসিডেন্ট ফিরলে জেনারেল এরশাদ পদত্যাগপত্রগুলো নিয়ে তার কাছে যাবেন। অন্যরা যে যাই বলুক, এই সংবাদে আমি ব্যক্তিগতভাবে চরম বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। ঐ সব পদত্যাগপত্র প্রেসিডেন্টের কাছে যাবে কেন? আর গেলেও এরশাদ সেগুলো বহন করবেন কেন? প্রেসিডেন্ট তো সোজা বলে দেবেন যে, এগুলো আমার কাছে এনেছেন কেন? এগুলো প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেন। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ তো একজন ব্যারিস্টার। তিনি তো জাতীয় পার্টির মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তিনি কি এসব নিয়ম-কানুন জানেন না? অবশ্যই জানেন। তাহলে কি তারা যেনে শুনেই এভাবে সহজ বিষয়কে জটিল করছেন? তাহলে উদ্দেশ্য কি? আমার কাছে মনে হলো যে, উদ্দেশ্য হলো সময় ক্ষেপণ করা।
চার
এসব হলো বৃহস্পতিবারের ঘটনা। আজ শনিবার দুপুর বেলা ৭২ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। ওরা পদত্যাগও করেননি, আর এরশাদও তাদের বিরুদ্ধে কোন দলীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। তাহলে সমগ্র বিষয়টাই কি একটি সাজানো নাটক? যার মধ্যে এরশাদও রয়েছেন? এরশাদ আগ বাড়িয়ে বলেন যে, তিনি নির্বাচনে যাবেন না। নির্বাচনে যেতে হলে মৃত্যু ছাড়া তার সামনে আর কোন পথ নাই। আরো বললেন যে, তিনি মরতে রাজি আছেন, জেলে যেতে রাজি আছেন, তবুও নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে নড়বেন না। এমন একটি পটভূমিকায় তার দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন যে, সরকারের সাথে তাদের কথাবার্তা চলছে। ইতোমধ্যেই সরকারের সাথে তাদের কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। আরো কয়েকটি বৈঠক হবে। সাধারণ মানুষের কাছে এটি বোধগম্য হয় না যে, তারা যেখানে পদত্যাগ করছেন সেখানে আবার সরকারের সাথে বৈঠকের কি আছে? তাও আবার এক-দুইটি নয়, একাধিক বৈঠক।
বেলা ৫টার সময়ও এরশাদ বললেন যে, তিনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটিই ফাইনাল। তিনি মরে গেলেও এই সিদ্ধান্ত পাল্টাবেন না। কিন্তু রাত ৮টার সময় জাতীয় পার্টির রাজনীতির চাকা উল্টো দিকে ঘুরতে লাগলো। এরশাদ বললেন যে, তিনি নির্বাচনে যেতে পারেন দুইটি শর্তে। একটি হলো, তফসিল ১০ দিন পিছাতে হবে। দ্বিতীয়টি হলো অন্যান্য সব দলকে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে হবে। এই দুটি শর্ত পরস্পর বিরোধী। নির্বাচন কমিশন হাসিনা সরকারের তল্পীবাহক। সরকার হুকুম করলেই তফসিল ১০ দিন পিছিয়ে যাবে। কিন্তু সব দল নির্বাচনে আসবে কিভাবে? বিশেষ করে প্রধান দুইটি বিরোধী দল একটি নীতি এবং আদর্শের জন্য লড়ছে। ঐ নীতি এবং আদর্শ সরকার না মানলে তারা নির্বাচনে যাবে না। এ কথা বিরোধী দল ২০১১ সাল থেকেই বলে আসছে। মূল দাবি হলো, দলীয় সরকার বা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নয়, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। বিরোধী দল গত দুই আড়াই বছর থেকেই বলে আসছে যে, তাদের দাবি মানা না হলে তারা যে শুধু নির্বাচন বয়কট করবে, তাই নয়, তারা নির্বাচন প্রতিহতও করবে।
পাঁচ
সেই প্রতিহত করার কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে এবং সেই সংগ্রামে ইতোমধ্যেই তিন শতাধিক ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন। ১৮ দলীয় জোট এ সব শহীদকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে শহীদ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। এরশাদ কি মনে করেন যে, দুই চারটি মন্ত্রিত্ব পেলেই বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি এবং জামায়াত এই তিন শতাধিক শহীদের রক্ত মাড়িয়ে নির্বাচনে যাবেন? এরশাদেরই সেদিনের সেকেন্ড ইন্ড কমান্ড কাজী জাফর আহম্মেদ বলেছেন যে, এরশাদ এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বিশ্বাস ঘাতক। বিএনপি এবং জামায়াত শহীদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। এখানেই বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর সাথে এরশাদদের পার্থক্য।
ছয়
শনিবার বেলা দেড়টার সময়েও আমরা জানিনা যে, জাতীয় পার্টি ইলেকশনে যাচ্ছে কি না। তবে তাদের যাওয়াতে খুব একটা এসে যায়না। কারণ যাচাই বাছাইয়ের পর দেখা যাচ্ছে যে, ১৬ কোটি মানুষের দেশে ৩০০টি আসনের জন্য বৈধ নমিনেশন পেপারের সংখ্যা মাত্র ৮৪৭টি। একটি স্মরণ কালের সবচেয়ে ক্ষুদ্র সংখ্যা। আসন সংখ্যা হলো ৩০০। এর মধ্যে ৩৩টি আসনে মাত্র ১ জন প্রার্থী। তার মানে হলো এই যে, আন অফিসিয়ালী এরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন। তাহলে আর বাকি রইল ২৬৭ আসন। এই আসনগুলোর মধ্যে ১০৩টি আসনে ওয়ান টু ওয়ান ফাইট। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ এবং অন্য কেউ। তাহলে অবশিষ্ট রইলো ১৬৪টি আসন।
এই হলো এবারের ইলেকশন চিত্র। এটি কি ইলেকশন? নাকি ইলেকশনের নামে প্রহসন? ইলেকশনের নামে তামাশা? এই ধরনের নির্বাচনে বিএনপি জামায়াত তথা ১৮ দলীয় জোট কোন অবস্থাতেই যেতে পারে না। এরশাদ বলছেন যে, বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনতে হবে। খুবই ভাল কথা কিন্তু নির্দলীয় সরকারের দাবি না মানলে তারা আসবে কি ভাবে? আরো বড় কথা হলো, শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বে তারা নির্বাচন করবেন কিভাবে? বিচারপতি কে এম হাসান যখন চিফ জাস্টিস হন তখন তার ৩০ বছর আগে উনি রাজনীতির সাথে সমস্ত সংশ্রব ত্যাগ করেছিলেন। সেই যে গায়ে বিএনপির গন্ধ একবার লেগেছিল সে জন্য তাকে প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে গ্রহণ করতে আওয়ামী লীগ অস্বীকার করে। তাহলে যে হাসিনা ৩২ বছর হলো আওয়ামী লীগের সভাপতি আছেন এবং আজও সেই পদে বহাল আছেন তাকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বিরোধী দল কিভাবে মেনে নেবে?
এসব অত্যন্ত গুরুতর পয়েন্ট। লোভ এবং ক্ষমতার নেশায় মত্ত এরশাদ এবং জাতীয় পার্টি এ সব পয়েন্ট ইগনোর করতে পারে। কিন্তু জাগ্রত জনগণ কোন দিন সেটা পারে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন