এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে- গানের এমন বাণী আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, কিন্তু তার মর্ম উপলব্ধি করি না। এ কারণেই হয়তো আমাদের সমাজ বর্তমান দুরবস্থায় উপনীত হয়েছে। মানুষ তো উন্নত জীবনযাপনের প্রয়োজনে কতগুলো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে সমাজবদ্ধ হয়েছে। মানুষ যখনই সমাজবদ্ধ হয়, তখনই প্রয়োজন হয় নিয়মনীতি, শৃঙ্খলা ও নেতৃত্বের। নেতৃত্বের দায়িত্ব হলো, সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজের মানুষের আশা আকাক্সক্ষা পূরণের লক্ষ্যে পৌঁছা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, যারা নেতৃত্বে আছেন তারা অনেক সময়ই নেতৃত্বের দায়িত্ব পালনের বদলে কর্তৃত্বের ছড়ি ঘুরিয়ে থাকেন। তখন মানুষের দুঃখ বাড়ে, সমাজে দেখা দেয় হিংসা-বিদ্বেষ ও সংঘাতম পরিস্থিতি। তেমন পরিস্থিতি আমরা বর্তমানে লক্ষ্য করছি প্রিয় স্বদেশে। আমরা জানি যে, ক্ষমতার একটি মোহ আছে, আছে দম্ভ ও দর্প। যারা প্রকৃত নেতা তারা মোহ ও দম্ভকে জয় করে বরং ত্যাগ-তিতিক্ষা, ক্ষমা, ধৈর্য ও বিনয়ের নীতি অবলম্বন করে দেশ ও জনগণের সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দেন। এমন নেতাদের নামই ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হয়। কিন্তু আমাদের ট্র্যাজেডি হলো, তেমন কোনো নেতার উপস্থিতি বর্তমানে আমরা লক্ষ্য করছি না। আমাদের শাসকরা বরং সুশাসন ও নীতি-নৈতিকতার কথা ভুলে গিয়ে দমন-পীড়ন ও চাতুর্যের নীতি অবলম্বন করে যে কোনোভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চান। এমন আচরণে দেশ-জাতি গোল্লায় গেলেও তাদের যেন কিছু আসে যায় না। ক্ষমতার মোহ আর দম্ভ যেন তাদের অন্ধ করে রেখেছে। এমন বাস্তবতায় গানের সেই কথাটি বারবার মনে বাজেÑ এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে। ক্ষমতাসীনদের এই দিন তো একদিন ফুরিয়ে যাবে এই পৃথিবীতে, আর পরকালে বিচারের দিন তো সবার জন্যই অপেক্ষা করছে। মানুষকে কৃতকর্মের জবাবদিহিতা এই পৃথিবীতেও করতে হয়, আর পরকালে জবাবদিহি করতে হবে নিশ্চিতভাবেই। তাই শাসক-শাসিত নির্বিশেষে সবারই এ কথাটি ভালভাবে মনে রাখা প্রয়োজন যেÑ এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে।
শুধু বাংলাদেশের জনগণকে নয়, গোটা দুনিয়ার মানুষকেই বিস্মিত ও হতভম্ব করেছে বাংলাদেশের এবারের নির্বাচন। নির্বাচনের আগেই জনগণের ভোট ছাড়াই ১৫৪টি আসনে সরকারি দলের লোকজন বিজয়ী হতে চলেছে, এখন শুধু ঘোষণার বাকি। বিরোধী দলহীন এই নির্বাচনে বাকি আসনগুলোতেও সরকারি ঘরানার লোকজনই বিজয়ী হবে। বিগত পাঁচ বছরে সরকারি দলের দমন-পীড়ন, চাতুর্য ও প্রহসনের পর জনগণ এখন লক্ষ্য করছে গণতন্ত্র বিসর্জনের এক বিয়োগান্তক দৃশ্য। এমন দৃশ্যে শুধু যে বিরোধী দলসহ দেশের জনগণই ব্যথিত ও মর্মাহত তা নয়, সরকারি দলেরও কাউকে কাউকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের রামুর ঘটনা উল্লেখ করা যায়। এবার রামুতে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সোহেল সরওয়ার কাজল আনসার, পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দমন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বর্তমান সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর কড়া সমালোচনা করেন। সরওয়ার কাজল বলেন, একদলীয় ও ভোটারবিহীন নির্বাচন দেশবাসী কখনো মেনে নেবে না। অতি উৎসাহী ব্যক্তিরা গণজাগরণ মঞ্চের নামে রাজপথ দখল করে যানজট ও অন্যান্য সমস্যার সৃষ্টি করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আওয়ামী লীগের এই নেতার মুখে আসলে জনগণের অন্তরের কথাই যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বর্তমান সময়ে সরকারের একদলীয় নির্বাচনের গোয়ারতুমিতে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা বিক্ষুব্ধ একথা আমরা সবাই জানি। বিরোধী দল রাজপথে আন্দোলন ও অবরোধ কর্মসূচিতে নেমে এসেছে। আর সরকার পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি দিয়ে তাদের দমন-অবদমনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ফলে দেশে এখন বিরাজ করছে এক সহিংস পরিবেশ। প্রতিদিনই মানুষ নিহত হচ্ছে, আহত হচ্ছে। আগুন জ্বলছে রাজপথে ও জনপদে। বাসে অগ্নিকা-ে মানুষ দগ্ধ হচ্ছে। বিচারপতিদের বাড়িতেও হামলা হচ্ছে। কোনো কোনো জায়গায় সংখ্যালঘুদের বাড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকার এসব সুনির্দিষ্ট ঘটনায় অপরাধীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বরং ঢালাওভাবে বিরোধী দলের উপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। বিরোধী দল সরকারের এই ঢালাও অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বরং বিভিন্ন অমানবিক ও নৃশংস ঘটনার জন্য সরকারের এজেন্ট ও সরকারি দলের লোকদের অভিযুক্ত করছে। এ প্রসঙ্গে সেনবাগের কথা উল্লেখ করা যায়। গত সোমবার নোয়াখালির সেনবাগ উপজেলার বিএনপি নেতৃবৃন্দ সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করেছেন, মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের গ্রামের বাড়িতে পেট্রলবোমা হামলা ও গুলীবর্ষণের ব্যাপারে বিএনপি জড়িত নয়, এ ঘটনার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন জড়িত। সরকার হয়তো বিরোধী দলের এমন অভিযোগকে উড়িয়ে দিতে চাইবে। কিন্তু সাতক্ষীরায় হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনায় সরকার কী বলবে? উল্লেখ্য যে, সাতক্ষীরার দেবহাটায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি বাড়িতে আগুন দিয়ে পালানোর সময় জনগণের হাতে আটক হয় যুবলীগ নেতা আবদুল গাফফার। গত রোববার জেলার ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিম অপরাধী গাফফারকে এক বছরের কারাদ- দিয়ে জেল হাজতে পাঠান। এমন উদাহরণ এ কথাই প্রমাণ করে যে, উদোরপি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপাবার কৌশল থেকে সরকার মুক্ত নয়।
মানুষ তো সমাজবদ্ধ হয়েছে, রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েছে উন্নত জীবন-যাপনের উদ্দেশ্যে। নাগরিকদের উন্নত জীবন-যাপন উপহার দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা বা পরিস্থিতির দায় বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে দেয়ার মধ্যেই সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বরং সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বিচক্ষণতার সাথে শান্তি স্থাপনের মাধ্যমে দেশকে অগ্রগতি ও প্রগতির পথে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে সরকারের সাফল্য। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা সরকারের আচরণে তেমন বিচক্ষণতা ও দায়িত্ববোধের পরিচয় পাচ্ছি না। বরং যেনতেনভাবে একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা ও নির্যাতন-নিপীড়ণের মাধ্যমে বিরোধী দলকে দমন করার নীতিতেই সরকারের আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকারের এমন নীতি ও আচরণের সমালোচনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে দেশে এবং বিদেশে। সম্প্রতি জাতিসংঘ সদর দফতরে এক নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনেও আমরা সরকারের ভুল নীতির সমালোচনা লক্ষ্য করেছি। উক্ত সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মুখপাত্র বলেন, জামায়াতে ইসলামীর নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। তিনি আরো বলেন, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে স্পর্শকাতর সময়ে সহিংসতাকে উস্কে দেয়ার সম্ভাবনাও যে কোন পরিস্থিতিতে, এমন কি সবচেয়ে গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধের ক্ষেত্রেও মৃত্যুদ-ের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের দৃঢ় অবস্থান বিবেচনায় কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করতে নিরুৎসাহিত করেছিলেন বান কি মুন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ক্ষমতা পাগল ও প্রতিশোধপরায়ণ বর্তমান সরকার জাতিসংঘ মহাসচিবের দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞার প্রতি সম্মান প্রদর্শনে সক্ষম হননি। এর ফল যা হবার তাই হচ্ছে।
স্বাধীন বাংলাদেশকে এখন একটি কারাগার হিসেবে মন্তব্য করেছেন ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের সাংবাদিক জন পিলজার। ‘দ্য প্রিজন দ্যাট ইজ বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তিনি আরো বলেন, নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সুকৌশলে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এজন্য বিরোধীদলীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজের হাতে থাকায় গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তি নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর ওপার। জন পিলজার আরো লিখেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা ও বিরোধী দল বিএনপি’র শীর্ষ ৬ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে একই সময়ে। বিরোধী দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে এভাবে অভিযোগ এনে তাদের নীরব করে দেয়া একটি পরিচিত খেলা।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকার আসলে এক ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে উঠেছে। এই খেলায় চাতুর্য আছে, প্রহসন আছে, দম্ভ আছে কিন্তু সত্য নেই। জনগণের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের চেতনাও নেই। দমন-অবদমন ও সংঘাতের এই পথ জাতিকে বিপর্যয়ের কিনারে নিয়ে এসেছে। দেশপ্রেমিক কোনো নেতা এমন অবস্থায় যৌক্তিক ভূমিকা পালনে নির্বিকার থাকতে পারেন না। অথচ আমাদের সরকারের শীর্ষ নেতারা জাতির এমন দুঃসময়েও কি নির্বিকারভাবেই না আবারো ক্ষমতার মসনদে আরোহণের অপেক্ষায় আছেন। অথচ এরাই নেলসন ম্যান্ডেলার জন্য ৩ দিন শোক পালন করেছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা তো ক্ষমতাপাগল হয়ে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধস্পৃহায় জাতিকে ভুল পথে পরিচালিত করেননি। বরং তিনি বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে ক্ষমা, উদারতা ও সংহতির চেতনায় জবপড়হপরষরধঃরড়হ বা সমঝোতার পথে হেঁটেছেন। অথচ আমাদের সরকার হাঁটছেন নেলসন ম্যান্ডেলার বিপরীত পথে। ভাবতে গেলে বিস্মিত হতে হয়, আমাদের সরকারের শীর্ষ নেতারা মুখে গণতন্ত্রের ফেনা তুলে চলেন একদলীয় নির্বাচনের পথে। আর ম্যান্ডেলার গুণকীর্তনে পঞ্চমুখ হলেও সমঝোতার বদলে জাতিকে নিয়ে যান হিংসা-বিদ্বেষ ও বিভক্তির রোডম্যাপে। ফলে তাদের মুখে গণতন্ত্র ও নেলসন ম্যান্ডেলার প্রশস্তি এখন প্রহসনের মত শোনা যায়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন