বুধবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৩

সহিংসতা থামান : গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই


বিগত ২৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শাহবাগ মোড়ের কাছে চলন্ত বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ১৯ যাত্রী আহত হলে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে যাত্রীসাধারণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। আহতদের কয়েকজন পরে হাসপাতালে মারা যান। চিকিৎসাধীন কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বিরোধী বিএনপি শিবিরে তার প্রতিক্রিয়া হয় অন্য রকম। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই আক্রমণের জন্য সরকারি দলকে দায়ী করেন। আন্দোলনের কাজে ব্যস্ত, আরো অনেক মামলায় জামিনপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন সিনিয়র বিএনপি নেতাকে বাসে অগ্নিসংযোগের মামলার আসামি করায় তাদের মধ্যে ধারণা হয় যে হরতাল বা আন্দোলনের কর্মসূচিবিহীন শুক্র-শনিবারে গ্রেফতার আরো বাড়বে। হলোও তাই। ফলে অধিকতর গ্রেফতার ঠেকানোর কৌশল হিসেবে ছুটির দিন শনিবার থেকে তারা দিলেন নতুন অবরোধ কর্মসূচি। শুক্রবার দিবাগত রাতে বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিস ভাঙচুর করে গ্রেফতার করা হয় যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ কয়েকজন নেতাকর্মীকে। চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মীসহ সারা দেশে গ্রেফতার হন আরো অনেকে। অন্যান্য ঘটনায় সারা দেশে নতুন করে বেশ কিছু মামলা দায়ের করা হয় হাজার হাজার বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীর বিরুদ্ধে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অফিস ভাঙচুর এবং নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় দলের নেতৃত্বের আশঙ্কা প্রমাণিত হয়। বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচন নিয়ে সহিংসতা বা মানুষ হত্যা কোনোটাই চায় না, কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এখানে নির্বাচনই মুখ্য। কারণ, নির্বাচনের মাধ্যমেই ঠিক হবে পরের পাঁচ বছর কারা সরকার চালাবেন। সরকার ও বিরোধী দলের মতপার্থক্য থাকবেই। কিন্তু কিছু মৌলিক বিষয়ে একমত না হলে তারা গণতন্ত্রের সর্বনাশ ডেকে আনবেন।
 
যেহেতু প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের নিরিখে তারাই শাসক শ্রেণী, তাদের গ্রহণযোগ্যতা রক্ষার কিছু নিয়মনীতি তারা নিজেরাই মেনে না চললে বর্তমান ব্যবস্থাও কি হুমকির মুখে পড়বে? সপ্তাহ দুয়েক আগে এ দেশের একজন খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক মন্তব্য করেছেন, দেশে এখন সংসদীয় গণতন্ত্রের ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। জাসদ নেতা আ স ম আবদুর রব তার বহুলপ্রচারিত দুই কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠনের দাবি তুলে বলেছেন, নির্দলীয় ব্যক্তিদের দিয়ে গঠিত উচ্চকক্ষের সদস্য নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার করলে তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। যারা বাম রাজনীতি করেন তারা বলছেন বিএনপি-আওয়ামী লীগ মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ, গুণগত কোনো পার্থক্য নেই। ইসলামি আদর্শের রাজনীতিকদের অনেকে মনে করেন বড় দুই দলকে দিয়ে যত দূর সম্ভব ইসলামের কাজ করিয়ে নেয়া ভালো। তবে চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে ইসলামি বিপ্লব। ওপরের বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে এখন যে টানাপড়েন দেখা দিয়েছে, তা সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সব শ্রেণী ও পেশার মানুষের ধৈর্যের সীমানায় এসে গেছে। কারণ এটা সবাই বোঝে একটা মামুলি বিষয় নিয়ে এত মারামারি-কাটাকাটি হতে পারে না। নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা অপরিহার্য। এটা কোনো বাড়তি দাবি নয়, এ দাবি সবারÑ তা এ দেশের মানুষ বহু মতামত জরিপের মাধ্যমে জানিয়েছে। কেউ এ দাবির জন্য আন্দোলন করলে তা অন্যায় নয়। আন্দোলনকারীদের দুষ্কৃতকারী আখ্যা দিয়ে তাদের ওপর যেকোনো নিপীড়ন হালাল করা যাবে না। অন্য দিকে সহিংসতাও কাম্য নয়।
বিএনপি ও তার জোটভুক্ত শরিক দলগুলোর বহু দিনের অভিযোগÑ এরা সরকারি বাধার জন্য সভা সমিতি, মিটিং মিছিল করতে পারছে না। হরতাল ডাকলে লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস, টিকিট কালোবাজারিদের মতো রাস্তায় রাজনৈতিক কর্মীদের ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিচার করে জেলে পাঠানো, গ্রেফতার এবং বাড়িতে বাড়িতে হানা কোনো ধরনের দমন-নিপীড়ন বাদ যাচ্ছে না। তাদের দাবিও মানা হচ্ছে না। তাহলে আন্দোলন ছাড়া তাদের করণীয় কী? নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের আন্দোলন অতীতেও হয়েছে। নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সমাপ্তিতে এসে উভয় দলের তথা জোটের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি না পাওয়া যাওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে মেনে নেয়া হয়েছিল। পরবর্তী ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের কারণেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখন এই ব্যবস্থা পাকিস্তান ও নেপাল গ্রহণ করেছে। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে গণতন্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করেন। তবে তিনি পরবর্তী দুটি নির্বাচন এই ব্যবস্থার অধীন করার পক্ষে তার দেয়া রায়ে মতপ্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে সংসদে পাস করা ১৫শ সংশোধনীর মাধ্যমে তা সম্পূর্ণভাবে বাদ দেয়ার পরই বর্তমান জটিলতার জন্ম হয়। জাতীয় সংসদের সংশ্লিষ্ট স্থায়ী কমিটির রিপোর্ট ছিল তা রাখার পক্ষে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও দুটি শর্ত জুড়ে দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রেখে দেয়ার পক্ষে মতপ্রকাশ করেছিলেন বলে জানা যায়। বিরোধী দল আগাগোড়া ১৫শ সংশোধনীর বিরোধিতা করেছে।
১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেছেন, সরকার চাইলে এক মিনিটে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এ বক্তব্যের কারণে তিনি ক্ষমতাসীনদের মারাত্মক বিরাগভাজন হয়েছেন। পরে তিনি দুঃখ করে বলেছেন, গণতন্ত্রে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্য সৃষ্টি হয়, তা নিয়ে সমালোচনামুখর হওয়ার কিছু নেই। বর্তমানে সরকারি মন্ত্রী-এমপিরা সরকার চালাচ্ছেন আবার নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সাথে সাথে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রয়োগ করছেন। নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন তাদের কাজ হবে শুধু নির্বাচন সম্পন্ন করার সীমিত কাজ করা। তার কাছ থেকে এখন আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। অন্যেরা অনেক বাড়তি কথা বলেছেন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে। কয়েক দিন পরপর ঠিক হচ্ছে নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীনদের কার কী ভূমিকা হবে। এমন নির্বাচনী কাজে এ দেশের মানুষ অভ্যস্ত নয়। এই প্রক্রিয়ার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও প্রার্থীদের মধ্যে সমতাভিত্তিক লড়াই কী করে সম্ভব? বিরোধী দল কি বলার অধিকার রাখে না, তাদের ওপর অসম নির্বাচন চাপিয়ে দিয়ে তা বর্জন করতে বাধ্য করা হচ্ছে? তারা সমতাভিত্তিক নির্বাচনে সরকারকে বাধ্য করার জন্য আন্দোলন করছেন। সরকার তা দমনের পথ বেছে নিয়েছে, যা কাম্য ছিল না। ফলে মানুষ হত্যা ও সহিংসতা বেড়েই চলেছে। এর শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। যাত্রীবাহী চলন্ত বাসে অগ্নিসংযোগ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এর জন্য সরকার ও বিরোধী দল একে অন্যকে দায়ী করেছে। অপরাধী যেই হোক আমরা তার শাস্তি চাই। কিন্তু বাসে অগ্নিসংযোগ একটা কার্যকারণ সম্পর্কহীন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যেমন নয় আন্দোলনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত স্কুলপরীক্ষা। এগুলো একটা বড় কারণের প্রতিক্রিয়া বা ফলাফল। কারণটার সমাধান হলে তার আর কোনো প্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।
হরতাল, অবরোধের মারাত্মক আরো অনেক সামাজিক প্রতিক্রিয়া থাকে। মানুষের মধ্যে সমঝোতার পরিবর্তে সংঘর্ষের মনোভাব তৈরি হয়। যারা রাজনীতি করেন তাদের বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না এ ধরনের সর্বশেষ রাজনৈতিক অস্ত্র প্রয়োগ করা কত কঠিন। কয়েক সপ্তাহ ধরে বিরোধী দল ও জোটের সফল হরতাল-অবরোধ তাদের দাবির প্রতি জনসমর্থনেরও ইঙ্গিত বহন করে। পত্রপত্রিকার মাধ্যমে পর্যবেক্ষকেরা ধারণা পোষণ করেছেন বিরোধী দল শেষ পর্যন্ত আন্দোলন করে যাবে। কারণ নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে তাদের মাটিতে পা রাখার জায়গা থাকবে না। আন্দোলন ও তা দমনের কর্মসূচি বর্তমান পরিস্থিতিকে আরো মারাত্মক করে তুলবে। সাধারণ মানুষের আশা সরকার ও বিরোধী দল যেন সমঝোতার পথে পা বাড়ায়। নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণভিত্তিক নির্বাচনে যেন মানুষ তাদের পছন্দের প্রতিনিধিদের বেছে নিতে পারে। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads