ড.রেজোয়ান সিদ্দিকী
দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত শেখ হাসিনার সরকার ভয়ে আতঙ্কে একেবারে বিবর্ণ হয়ে গেছে। আর দুর্নীতি যেমন তেমন নয়। এই পাঁচ বছরে কিংবা বছর দেড়েকের মধ্যে তারা এক একজন দুর্নীতির বিশ্বরেকর্ড গড়ে তুলেছেন। পৃথিবীর কোনো দেশের মানুষও বোধ করি দুর্নীতির এই বিশাল মাত্রা কল্পনাও করতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীসহ প্রত্যেক মন্ত্রী, এমপি, দলীয় কর্মী, মনোনয়ন প্রত্যাশী এই সময়ে তাদের সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়েছেন ৪০ থেকে সাড়ে চার হাজার গুণ পর্যন্ত। নির্বাচন কমিশনে তারা তাদের সম্পত্তির হিসাব জমা দিয়েছেন। সে হিসাবও বলিহারি। কী করে একেকজন এই বিপুল সম্পত্তির মালিক হলেন সেটি কেউ প্রকাশ করেনি। এখানে আছে শেয়ার বাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে লুণ্ঠন করা ৪০ হাজার কোটি টাকা। আছে কুইক রেন্টালে জনগণের পকেট কেটে নেয়া ২৫/৩০ হাজার কোটি টাকা। আছে হলমার্ক, ডেসটিনির আরও ১৫/২০ হাজার কোটি টাকা। তার ওপর টেন্ডারবাজির আছে কোটি কোটি টাকা। শেখ মুজিবের শাসনকালে যে বিপুল দুর্নীতি হয়েছিলো তাকে প্রবীণ রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান বলেছিলেন, ‘এরা আঙুল ফুলে কলাগাছ নয়, বটগাছ হয়ে গেছে।” এবার বোধ হয় আর কোনো উদাহরণ দেয়া চলে না। শুধু বলা চলে, এদের আঙুল ফুলে হিমালয় পর্বতমালা হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশনে তারা নিজেরাই এ হিসাব জমা দিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশন যথারীতি তাদের ওয়েবসাইটে এ তথ্য সংযোজিত করেছিলো। কিন্তু এতে প্রধানমন্ত্রীসহ তার দলের লোকেরা বড়বেশি শরমিন্দা হয়ে পড়েন। তারা নির্বাচন কমিশনে একটি প্রতিনিধিদল পাঠায়। যারা গিয়ে দাবি করে, এটি ওয়েবসাইট থেকে মুছে দেন। আর পৃথিবীর ইতিহাসে নিকৃষ্টতম প্রধান নির্বাচন কমিশনার সঙ্গে সঙ্গে তা মুছে দেবার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু যা হবার তাতো হয়েই গেছে। সকলেরই হাতে হাতে মুখে মুখে এ হিসাব চলে গেছে।
প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসা একসময় টিভি টকশোতে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ নেতাদের দেখলে যেনো সবাই ‘চোর চোর’ বলে ধ্বনি দেয়। কিন্তু শুধু চোর বললে কি যথেষ্ট বলা হবে? আর কী বললে যথেষ্ট বলা হয় সেটি আমাদের জানা নেই। তবে প্রমাণিত হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের সকল নেতা, মন্ত্রী, এমপি ‘চোর’। এর আগে বিএনপি নেতা তারেক রহমানকে লক্ষ্য করে ‘দুর্নীতিবাজ দুর্নীতিবাজ’ বলে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মী মুখে ফেনা তুলে ফেলেছিলেন। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলাও দায়ের করা হয়। কিন্তু বিগত সাত বছরে কোনো একটি মামলায় প্রমাণিত হয়নি যে, তারেক রহমান ন্যূনতম কোনো দুর্নীতি করেছেন। বরং মানি ল-ারিং মামলা থেকে আদালতে তিনি বেকসুর খালাস পেয়েছেন। সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি দুর্নীতির মামলা হয়েছিলো। ‘আঁতাতের’ নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, মোকাবিলা করেননি। এতে ধরে নেয়া যায় যে, ঘুষ-দুর্নীতির কীর্তি তিনি করেছিলেন। এছাড়া বিগত পাঁচ বছরে আওয়ামী দুঃশাসন, হত্যা, লুণ্ঠন, গুম, খুন, অত্যাচার-নির্যাতন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, জনগণ একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। এরকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের বহু মন্ত্রী, এমপি ভোটারদের ভয়ে নির্বাচনী এলাকা পর্যন্ত যেতে সাহস পায়নি। অনেকেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুলিশ প্রটেকশনের জন্য আবেদন করেছেন। গফরগাঁওয়ের এমপি নিজে পিস্তল বের করে তার এলাকার ভোটারদের ওপর গুলী চালিয়েছে। ডাকাতের হাতেও বন্দুক থাকে। কিন্তু সে ডাকাতকেও জনগণ ঘেরাও করে পিটিয়ে মারে। জনগণের সংঘশক্তি এমনই প্রবল তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন শেখ হাসিনা।
বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে বিগত আড়াই বছর ধরে আন্দোলন করে আসছেন। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ হাসিনা ১৭৩ দিন হরতাল করেছিলেন সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় তিনি অনুদানখোর বিচারপতি খায়রুল হকের এক বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে বাতিল করে দেন। এটাও অবাক করার বিষয় ছিলো। ১৯৯১ সালে অনানুষ্ঠানিকভাবে এবং ১৯৯৬ সালে সংবিধান সংশোধন করে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে তিনটি নির্বাচন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে তা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য বলে দেশের মানুষ ও সারা বিশ্ব রায় দিয়েছিলো। সে ব্যবস্থা বাতিল করে শেখ হাসিনা কিম্ভূত নির্বাচন ব্যবস্থার আয়োজন করেছিলেন। তাতে সংসদ বহাল থাকবে, প্রধানমন্ত্রী নিজেও স্বপদে বহাল থাকবেন, তার মধ্যেই নির্বাচন হবে। তার পরেও যাতে কোনো ফাঁকফোঁকর না বের হয়, আর বের হলেও তা যেনো মেটানো যায় সে জন্য তিনি বিচার বিভাগ দলীয়করণ করেছেন। আর পদলেহী একদল নতজানু লোককে দিয়ে নির্বাচন কমিশন সাজিয়েছেন। তাদের আচার-আচরণ কখনও কখনও একেবারে দাসানুদাসের মতো।
১৮ দল যতোই বলে এই নির্বাচনে তারা যোগ দেবেন না ততোই যেনো শেখ হাসিনা খুশিতে ডগোমগো হয়ে ওঠেন। কিন্তু শুধুমাত্র ১৮ দল নয় বি. চৌধুরীর বিকল্পধারা, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, আ স ম আব্দুর রবের জেএসডি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও এ নির্বাচনে অংশ নেবে না। তাতেও খুশি শেখ হাসিনা। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে একেবারেই বিপর্যয়কর পরাজয় বরণ করবে যুগান্তর, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার-এশিয়া ফাউন্ডেশন প্রভৃতি সংস্থার জরিপে সেটি উঠে এসেছে। ফলে নির্বাচনে বিরোধী দল যাতে না আসে সে আয়োজনই করতে থাকে শেখ হাসিনা। এমনকি তার প্রধান শরীক জাতীয় পার্টির এরশাদও ঘোষণা দেন যে, সবাই অংশ না নিলে তার দলও নির্বাচনে অংশ নেবে না। তারপর এরশাদকে সরকার র্যাব দিয়ে তুলে নিয়ে সিএমএইচ-এ আটক করে রেখেছে। নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ব্যাপারে তিনি অনড়, এমন কথাই এখন পর্যন্ত বলে যাচ্ছেন। যদিও জাতীয় পার্টির কিছু নেতা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। চেয়ারম্যান এরশাদ নির্বাচন কমিশনকে লিখিতভাবে জানান যে, তার দলের প্রতীক লাঙল যেনো কাউকে বরাদ্দ দেয়া না হয়। কিন্তু জাতীয় পার্টির ভোটপ্রার্থীদের নামে নির্বাচন কমিশন সে প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছে। এরশাদ তিনটি আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন। তিনটি আসন থেকেই তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। তা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন একটি আসনে তাকে প্রার্থী রাখে এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করে। ভাবটা যেনো এমন যে, নির্বাচন করবি না, তোর ঘাড়ে করবে।
এসব কিছুই করা হচ্ছে ভয়, আতঙ্ক ও ভারতীয় তাঁবেদারির জন্য। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসেছিলেন। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ই ইউ, যুক্তরাজ্যসহ সারা পৃথিবী বলছে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য এবং সকল দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় তারা। সেখানে সুজাতা সিং এসে বলে গেলেন, সব দলের অংশগ্রহণ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়। এই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কথাটাকে ভিত্তি ধরেই এরশাদকে জোর-জবরদস্তিমূলকভাবে নির্বাচনে রাখাই সরকারের উদ্দেশ্য। এরশাদ না থাকলে একেবারে কিছুই থাকে না। এই প্রহসনের নির্বাচনে বিরোধী দল নেই বলে ১৫৪টি আসন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে গেছে। ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে প্রায় ৫৩ শতাংশ ভোটার। আর যে ১৪৬টি আসনে নির্বাচন বাকি সেগুলোতে বস্তুতপক্ষে ভোট হবে এমন মনে করার কারণ নেই। সরকার আর নির্বাচন কমিশন মিলে এমন একটা পরিবেশের সৃষ্টি হবে যাতে শুধু নাম ঘোষণা করে দিলেই হয়। অর্থাৎ এই নির্বাচন ভোটারবিহীন। ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়ার নির্বাচন। সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ১৮ দলীয় জোট যখন হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিতে শুরু করলো তখন সরকার একেবারেই বেহাল দশায় পড়ে যায়। এই অবরোধ কর্মসূচিতে সারা দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে। এবং রাজধানীকে গোটা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সরকার র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও ছাত্রলীগ দিয়ে কয়েকশ’ মানুষ হত্যা করে। তাতেও সে আন্দোলন, সে অবরোধ বিন্দুমাত্রও শিথিল হয়নি। বরং তা আরও প্রবল রূপ ধারণ করে।
প্রায় মাসখানেক ধরে অবরোধ কর্মসূচি পালিত হওয়ার পর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ নামক যে কর্মসূচি ঘোষণা করে তাতে যোগদানের জন্য ২৯ ডিসেম্বর সকল নেতা কর্মীকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানান বেগম খালেদা জিয়া। এতে একেবারেই বেসামাল হয়ে পড়ে সরকার। তখন অবরোধের ডাক দেয় সরকার নিজেই। তারা ঢাকামুখী বাস, ট্রেন, লঞ্চসহ সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। ঢাকার ভেতরেও যান চলাচল ছিলো অতি সামান্য। সরকার পথে পথে চেকপোস্ট বসিয়ে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি আর তাদের সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, যুব মহিলা লীগ, আওয়ামী লীগ, প্রজন্মলীগ দিয়ে মানুষকে বেপরোয়াভাবে নাজেহাল করতে শুরু করে। এম্বুলেন্সে মারা যায় রোগী। শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড় আর গ্রেফতার বাণিজ্য। এমনকি কর্মজীবী মানুষকে ঢাকায় আসতে বাধা দেয়া হয়। ১৮ দলের ডাকা অবরোধের সময় তবু রাজধানীতে কিছু যানবাহন চলতো কিন্তু সরকারের অবরোধে রাস্তাঘাট জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে। সরকার সৃষ্টি করে একটি ত্রাসের রাজত্ব। আর বেগম খালেদা জিয়ার ঐ ঘোষণার পর থেকেই তাকে তার নিজ বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। এই লেখা হওয়া পর্যন্ত তিনি গৃহবন্দী আছেন। যতদূর ধারণা করা যায়, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন পর্যন্ত তিনি গৃহবন্দী থাকবেন।
সাদা চোখে একে আতঙ্ক ছাড়া আর কি বলা যায়? সরকারের জনগণকে ভয়। নির্বাচনকে ভয়। খালেদা জিয়াকে ভয়। এতো ভীতির মধ্যে এই সরকার কীভাবে আশা করে যে, তবু তারা নির্বাচনের নামে প্রহসন করে অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকবে। সে আশা যে ইতোমধ্যেই দুরাশাই পরিণত হয়েছে সেটি সাধারণ মানুষের বুঝতে আর বাকি নেই। এরকম একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে শেষ পর্যন্ত যে ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে না এটি বোঝার ক্ষমতা সরকার হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্রেফতার থাকলেও জিতেছেন বেগম খালেদা জিয়া ও এদেশের জনগণ। আর হেরেছেন শেখ হাসিনা ও তার পেটোয়া বাহিনী। বিরোধীদলীয় নেতাকে বন্দী রেখে জনগণের ওপর এই নির্যাতনের প্রতিবাদ মানুষ করবেই। সে প্রতিবাদের কিছু নমুনা অবরোধকালে আওয়ামী লীগ দেখেছে। সামনে তাদের আরও দেখার খানিকটা বাকি অছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন