মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৩
যে মানসিকতা কাম্য নয়
Posted on ৫:৩১ PM by Abul Bashar Manik
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ
রাজনীতির বিষয়ে ভারতের মাথাব্যথায় এখানকার জনমনে ব্যাপক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ
দেশকে চাপে ফেলে একতরফা পাওনাই আদায় করে চলেছে ভারত। কিন্তু এ দেশের পাওনাগুলো
যেমন পূরণ হচ্ছে না, তেমনি ভারত তার
ওয়াদাগুলোও বাস্তবায়ন করছে না। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন
আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে ভারতের
জন্য আওয়ামী লীগ করেছে অনেক কিছুই। কিন্তু ভারত বাংলাদেশের জন্য কী করেছে এর বিবরণ
থাকছে না তাদেরই বক্তব্যে।
অতি সম্প্রতি নয়া
দিল্লিতে ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র দৃঢ় করা’ বিষয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
বৈঠকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে অত্যন্ত নগ্ন ভাষায় নানা মন্তব্য করা
হয়েছে। আলোচনায় ভারতীয় বক্তারা নিকট-অতীতে ভারতের উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা
ছিলেন এবং এরা সে সময় নীতিনির্ধারণী বিষয়েও ভূমিকা রেখেছেন। ফলে তাদের বক্তব্য-মন্তব্যের
রাজনৈতিক-কূটনৈতিক গুরুত্ব অনুধাবন করা হয়। বৈঠকে মতামত তুলে ধরে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে দশম জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র
করে সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। বিরোধী দল বিএনপি এবং শরিক
জামায়াতে ইসলামী হরতাল ও সহিংস কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও পাকিস্তান বিএনপি-জামায়াত জোটকে
সমর্থন দিচ্ছে।’ এই বৈঠকের বিষয়টি বাংলাদেশের
বেশ কিছু গণমাধ্যমে গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করা হয়। ভারতের অন্যতম থিঙ্ক ট্যাঙ্ক
প্রতিষ্ঠান ‘দ্য সোসাইটি ফর পলিসি
স্টাডিজ’ আয়োজিত দিনব্যাপী এ গোলটেবিল
আলোচনায় ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শ্যাম শরণ এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত দুই সাবেক
হাইকমিশনার বীনা সিক্রি ও পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর মতো কূটনীতিকেরা অংশ নেন। এ ছাড়া
বাংলাদেশ থেকেও কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি সেমিনারে যোগ দেন। যারা ‘ভারতপন্থী’ বলে পরিচিত। উভয়ের সুর ছিল প্রায় একই। তারা বলেন, ‘ভারতের অবস্থানকে ‘সুবিধাজনক’ দৃষ্টিতে দেখার পাশাপাশি বাংলাদেশকে ধর্মীয় মৌলবাদের মোকাবেলাও
শক্ত হাতে করতে হবে। মৌলবাদের মোকাবেলা দেশটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এর মোকাবেলা
করতে না পারলে কয়েক বছর ধরে উন্নয়নের যে ধারা অব্যাহত রয়েছে, তা ব্যাহত হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার এ
অঞ্চলও অশান্ত হয়ে উঠতে পারে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব পিনাক
রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
দাবিতে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশ বিষয়ে
ভারত কিছু না করলেও দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে তারা সব সময়ই একটি বড় ফ্যাক্টর বলে
বিবেচিত। ভারত এ ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন দেখিয়েছে।’ কিন্তু এই কথিত ‘পরিবর্তন’ কী? এ বিষয়ে আরেক সাবেক
পররাষ্ট্র সচিব শ্যাম শরন বলেন, ‘বাংলাদেশকে বুঝতে হবে, ভারতের বিশালতœ তার কাছে দুশ্চিন্তার চেয়ে অনেক বেশি
সম্ভাবনার। নির্বাচন ঘিরে অচলাবস্থা এবং মৌলবাদের মাথাচাড়া দেয়ার বিষয়টি আশঙ্কা
তৈরি করেছে।’ বাংলাদেশে ভারতের সাবেক
হাইকমিশনার বীনা সিক্রি বলেন, ‘জামায়াত ও হেফাজত
বাংলাদেশে অস্থিরতা আনতে চাইছে। বিএনপির মেয়াদেও জামায়াত এ কাজই করেছে। কিন্তু
বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে।’ সেমিনারে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান আবুল বারকাত, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ
হোসেন ও তথ্য কমিশনার সাদেকা হালিম বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিপন্ন হলেও
মৌলবাদ এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন তারা। লক্ষণীয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিশ্ববাসী দু’টি দল বিএনপি ও জামায়াতকে ‘মৌলবাদী’ ও ‘জঙ্গি’ সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস
চালিয়ে তাদের সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলে ভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে।
দিল্লির এই বৈঠকের
বক্তব্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে সরাসরি উসকানি। এরা নিরপেক্ষ
বক্তব্য দেয়ার পরিবর্তে প্রত্যক্ষভাবে আওয়ামী সরকারের পক্ষে এবং বিরোধী জোটের
বিপক্ষে বিষোদগার করেছেন। এরা একতরফা মন্তব্য করেও কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ার
সুবাদে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ নিয়েছেন। এটা এক ধরনের ব্ল্যাকমেইল এবং অনধিকার
হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। এ বৈঠকে আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের
পক্ষে দাঁড়াতে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা হলেও বাংলাদেশের সাথে ভারতের অব্যাহত অন্যায়
আচরণের ব্যাপারে জোরালো আলোচনা-সমালোচনা হয়নি। একটি বড় পড়শি দেশের রাজধানীতে বসে
প্রতিবেশী একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ এবং বিশেষ রাজনৈতিক
দলকে আবার ক্ষমতায় বসানোর জন্য প্রকাশ্যে সলাপরামর্শ দেয়া বড় রকম অনৈতিক কাজ বলে
মনে করে পর্যবেক্ষক মহল। বাংলাদেশের বিরোধী জোটের শরিকদের সম্পর্কে আওয়ামী লীগ ও
তার বামপন্থী শরিকেরা যে বানোয়াট অভিযোগ প্রচার করছে- একই প্রচার দিল্লির মাটিতে
বসে করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে প্রতিবেশীদের নিয়ে ভারতের আধিপত্যকামী মনোবৃত্তির দিকটি
পুনরায় উন্মোচিত হলো বলেও মনে করা হচ্ছে।
শুধু দিল্লির কথিত
থিঙ্ক ট্যাঙ্কের বৈঠকেই নয়, বিভিন্নভাবেই
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে ভারতের অনুকূলে রাখার জন্য উসকানি দেয়া অব্যাহত
রয়েছে। সম্প্রতি টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে ‘ভারতের বন্ধু’ আওয়ামী লীগকে ফের ক্ষমতায় আনতে ‘অবশ্যই সবকিছু করার’ সুপারিশ করেছেন আওয়ামীপন্থী বলে পরিচিত
অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজের সিনিয়র এডিটর সুবীর ভৌমিক। বাংলাদেশ আবার ১৯৭১ সাল
পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারে আশঙ্কা করে তিনি প্রয়োজনে ভারতীয় ‘সামরিক হস্তক্ষেপের’ সুপারিশ করেন। এটা ঔদ্ধত্য ছাড়া কিছু নয়।
ভারতীয় নাগরিক সুবীর ভৌমিক খোলাখুলিই বলেন, ‘বিএনপির
ব্যাপারে ভারতের বিতৃষ্ণা রয়েছে। দিল্লির আসল মাথাব্যথা জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামকে
নিয়ে।’ এর আগে গত বছর এপ্রিলে
ভারতের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমসে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে জয়নাথ
জ্যাকব ও প্রমিত পাল চৌধুরী এক যৌথ রচনায় ‘গত
৪০ বছরের ইতিহাসে বর্তমানে দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক সবচেয়ে বন্ধুত্বমূলক’ বলে সন্তোষ প্রকাশ করে এর পুরো কৃতিত্ব শেখ
হাসিনাকে দেয়া হয়। এতে আরো বলা হয়, ‘শেখ
হাসিনা বিশ্বাস করেন বাংলাদেশ থেকে ভারতবিদ্বেষী রাজনৈতিক চর্চা মুছে ফেলার
দায়িত্ব তার ওপর বর্তায়। এ লক্ষ্যে ভারতকে দোষারোপ করার যে সংস্কৃতি বাংলাদেশীদের
মধ্যে গড়ে উঠেছে, তার পরিবর্তন করতে হবে।’ সম্প্রতি ভারতের ইকোনমিক টাইমসের এক
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘হাসিনা সরকারকে রক্ষায়
ভারতকে সব কিছু করতে হবে।’ এতে বলা হয়, ‘ঢাকায় আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে নিরাপত্তা ও
কানেকটিভিটির যে সুবিধা দিয়েছে, তা ঢাকার কোনো সরকার
আগে কখনো দেয়নি। হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে ভারতের যৌক্তিক কারণ রয়েছে, যদিও তিনি যে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েছেন, সে সম্পর্কে কূটনীতিকেরা অসচেতন নন।’ স্পষ্টভাবে বলা হয়, ‘দিল্লির কাছে প্রকৃত উদ্বেগের কারণ হলো
জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম।’ দ্য
হিন্দু পত্রিকায় ভারতের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা বিভাগের প্রথম প্রধান এবং সমন্বিত
প্রতিরক্ষা স্টাফের উপপ্রধান লে. জে. কমল দাভার লেখেন, ‘বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির বিজয়ের
মধ্যে ভারতের স্বার্থ নিহিত। পাঁচ বছর আগে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের প্রতি চমৎকার সদিচ্ছা প্রদর্শন করা হচ্ছে।’ গত ৬ নভেম্বর বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে
এক অনুষ্ঠানে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার সিন্দে প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভারতের আপনজন’ বলে উল্লেখ করেন। সিন্দে বলেন, ‘দু’দেশের
বন্ধুত্বের কথা বলতে গেলে শেখ হাসিনাজির কথা বলতেই হয়। আমার তো মনে হয়, উনি যেন এই বাংলারই (পশ্চিমবঙ্গের) মেয়ে।
আমাদের অত্যন্ত আপনজন।’
ভারতের বিভিন্ন মহলের
এসব বক্তব্যে বাংলাদেশের জনমনে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। কারণ এটা অনস্বীকার্য- ভারত
তার প্রয়োজনসমূহ বাংলাদেশের কাছ থেকে আদায় করে নিচ্ছে ঠিকই; কিন্তু বাংলাদেশ তার পাওনা থেকে বঞ্চিতই
থেকে যাচ্ছে। আর এসব পাওনা ভারতেরই সৃষ্ট সংকট থেকে উদ্ভূত। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তাসহ প্রায় সব অভিন্ন নদীতে অসংখ্য বাঁধ দিয়ে ভারতই
বাংলাদেশকে সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে; কিন্তু
প্রয়োজনের সময় বাংলাদেশ পানি থেকে থাকছে বঞ্চিত। তিস্তার পানি নিয়ে মুখে খৈ ফুটলেও
বাস্তবে কিছুই হলো না। এর সমাধানও করছে না ভারত। সীমান্তে বিএসএফ গুলি করে বাংলাদেশীদের
অব্যাহতভাবে হত্যা করে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতন চলছেই। ভারত ঠিকই
বেরুবাড়ি আদায় করে নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ আজো তিনবিঘা করিডোর বুঝে পায়নি।
স্থলসীমান্ত চুক্তি গত প্রায় চার দশকেও ভারতীয় পার্লামেন্টে উত্থাপিতই হতে পারল
না। ১০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তির টাকাও ফেরত নিয়ে গেছে ভারত। নানা মারপ্যাঁচে ফেলে
বাণিজ্য ঘাটতি আজো অব্যাহত রাখা হয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশে চোরাইপথে মাদক-অস্ত্রের
চালান আসা অব্যাহত রয়েছে।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন