বুধবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৩

এক যাত্রায় দুই রকম পরিণতি হয় না


বিরোধী দলের প্রায় সব নেতা কারাগারে। হুলিয়া মাথায় আত্মগোপনে রয়েছেন অসংখ্য নেতা। মামলার খড়গ ঝুলছে হাজার হাজার নেতাকর্মীর ওপর। তারপরও শক্ত অবরোধে দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। যে নির্বাচন করার জন্য শাসক দল মরিয়া, সে নির্বাচন কতটা প্রহসন ও তামাশার বিষয়, সেটা নির্বাচন কমিশন নিজেই বারকয়েক প্রমাণ করেছে। সর্বশেষ মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার হিড়িকউদোম করে দিলো নির্বাচন কমিশন ও শাসক দলের যৌথ প্রযোজিত নাটকের পর্দা। এরপরও লজ্জাশরমের মাথা না খেলে এই নাটুকেপনার উপসংহার টানা জরুরি। বিশ্বসম্প্রদায় অবাক বিস্ময়ে দেখল অনেক বিরোধী দল তো বটেই ছোটখাটো দলগুলোও নির্বাচনে গরহাজির।
প্রধান বিরোধী জোট শক্ত ও কার্যকর প্রতিরোধ আন্দোলনে। পরপর ও টানা অবরোধ কর্মসূচির কারণে সারা দেশের জনজীবন স্থবির ও অচল। রাজনৈতিক সঙ্ঘাত-সহিংসতা এবং পুলিশের বাড়াবাড়িতে মানুষ মারা যাচ্ছে প্রতিদিনই। গত কদিনে লাশের সংখ্যা পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। বাস-ট্রেনসহ যানবাহনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেই চলছে। সর্বশেষ উত্তরবঙ্গে লাইনচ্যুত ট্রেনের অপঘাতে পাঁচ প্রাণ ঝরে গেল। সব কিছু মিলিয়ে জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। দেশের প্রত্যেক নাগরিক নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। অজানা এক আশঙ্কায় সারা দেশের মানুষ উৎকণ্ঠিত। দেশের ভবিষ্যৎ ভেবে মানুষ অসহায় বোধ করছে।
এ রকম ভীতিকর ও রাজনীতিহীন অগণতান্ত্রিক পরিস্থিতিতে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। এ যেন জেদের দাম কোটি টাকা। প্রধান বিরোধী জোট ও দলবিহীন এই নির্বাচন মনোনয়নপত্র দাখিলের মধ্য দিয়ে প্রহসনের আরেকটি ধাপ অতিক্রম করল। এরশাদ অবস্থান পরিবর্তন করে পরিস্থিতির ঘনত্ব বাড়িয়ে দিলেন। কৌতুকের বিষয় যে, এরই মধ্যে সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ছয়জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে চলেছেন। তাদের বিপরীতে নাকি আর কেউ মনোনয়নপত্র দাখিলই করেননি। বাহ! জনপ্রিয়তার কী শ্রী!
দেশে এর আগে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আমরা ধানের ক্ষেতে ব্যালট বাক্স প্রত্যক্ষ করেছি। ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে এ ধরনের একতরফা নির্বাচন হলেও তার পরিণতি ভালো হয়নি। ৮৮-এর নির্বাচনের দুই বছরের মধ্যে আন্দোলনের মুখে সেই সরকারের পতন ঘটে। আর ৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক বিল পাস করেই শেষ, সেই অপুষ্ট সরকার দেড় মাসও টেকেনি। এবার সে রকম পরিস্থিতি সৃষ্টির চেয়েও ভয়াবহ কিছু হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। কারণ এক যাত্রায় দুই রকম ফলাফল পাওয়া কোনোভাবে সম্ভব হয় না। এবারো সম্ভব হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, কারণও নেই। এ জন্য অনেকেই বলছেন, এবার মেরুকরণ অনেক বেশি ঋজু। তা ছাড়া সম্প্রসারণবাদী গোষ্ঠী জনগণকে ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। তাদের হিংস্র নখর প্রদর্শন করেছে। আগে স্বৈর মানসিকতাচ্ছন্ন সরকার এরশাদের এক চটিতে পা দিয়ে পা পিছলে পড়েছে। বর্তমান সরকারপ্রধান একই সাথে দুই চটিতে পা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তাই জাতির কপালে অপ ও দুঃশাসন চাপিয়ে দিয়েও হাসতে পারছেন। শাসকদের ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে গিয়ে বড়লোকি দেখিয়ে মনোনয়নপত্র দাখিলের ভড়ংও জাতি প্রত্যক্ষ করল।
মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদসহ সরকারি ঘরানার কটি দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলে ৩০০ আসনে এক হাজার ১০৭ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। আওয়ামী লীগ ছাড়া একেবারেই নামসর্বস্ব দুটি দল ও দুজন নেতানির্ভর ুদ্র দুটি দলের বাইরে অবশিষ্টরা নির্বাচনকে নাবলে দিয়েছে। তা ছাড়া সরাকরি পৃষ্ঠপোষকতা ও নির্বাচন কমিশনের স্বউদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিটিম বি-এনএফও মনোনয়নপত্র দাখিল করল। এই বিএনএফের জন্মই আজন্ম পাপের পরিচয় বহন করছে। তাদের জন্মবৃত্তান্ত প্রমাণ করে রাজনৈতিকভাবে সতীত্বহীনদের দৌড়ঝাঁপ ছাড়া তাদের মহৎ কোনো উদ্দেশ্য নেই। এর বাইরে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ধর্মভিত্তিক দলগুলোর বেশির ভাগই একতরফা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। মহাজোটের মিত্র ও অনুগত হিসেবে পরিচিত কথিত ধর্মভিত্তিক সাতটি দলের মধ্যে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে মাত্র দুটি দল। বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ও বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্ট দুটি দলই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হয়।
দেশে ধর্মভিত্তিক কমপক্ষে ২০টি রাজনৈতিক দল সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন আছে ১১টি দলের। নিবন্ধিত আরো দুটি দল ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ ও জাকের পার্টি মতাসীন মহাজোটের মিত্র হিসেবে পরিচিত। কিন্তু দল দুটিও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না।
নিবন্ধিত অপর সাতটি দলের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের শরিক দল। এর মধ্যে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। তবে এ বিতর্কের অবসান ঘটেনি। ১৮ দলীয় জোটের বাইরে থাকা চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ১৮ দলীয় জোটবহির্ভূত অংশটিও নির্বাচনে যায়নি।
অনিবন্ধিত ধর্মভিত্তিক সরকার অনুগত দলগুলোর মধ্যে মিছবাহুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট, বিতর্কিত ও দরবারি আলেমখ্যাত ফরিদ উদ্দিন মাসউদের নেতৃত্বাধীন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের একাংশ ও সম্মিলিত ইসলামী জোট আওয়ামী লীগের মিত্র। এর মধ্যে একটি দল সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, একতরফা নির্বাচনে তারা যাবেন না। বিতর্কিত ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বলেছেন, পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকায় তার দলও নির্বাচনে যেতে পারেনি। সরকার অনুগত অন্য একটি দলের নিবন্ধন না থাকায় অন্য দলের ব্যানারে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়েছিলেন; কিন্তু ততণে জমা দেয়ার সময় পার হয়ে গেছে বলে জমা দিতে পারেননি। অতএব তাদের আর নির্বাচনে যাওয়া হলো না।
এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। তারা ধর্মভিত্তিক দল অপছন্দ করে না। তবে সরকারের অনুগত মতলববাজ ও দরবারি খ্যাতদের কোনো দিন আমলে নেয়নি। ধর্মভিত্তিক দল হিসেবে তারা যাদের বেশি পছন্দ করে সেগুলোর কোনোটি নির্বাচনে যায়নি। কোনো কোনোটি আন্দোলনে সক্রিয় রয়েছে।
আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে রাজনীতি করার চেষ্টা করেছে। জনগণ মুক্তিযুদ্ধকে রাজনীতির উপাত্ত বানাতে নারাজ। তারা ধর্মবিদ্বেষ ছড়িয়ে বাম ও বিদেশী প্রভুত্বের সিমপ্যাথি পেতে চেয়েছেন। তাও ভরসা জোগায়নি। এখন কিছু অগ্রহণযোগ্য ও বিতর্কিত পোষমানা দলকে ইসলামপন্থী সাজিয়ে ইসলামের মূল ধারা ও আলেমদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এত অপকৌশল গ্রহণ করেও আওয়ামী লীগ এবার যে রূপে আবির্ভূত হলো সেটা অপ্রকাশিত থাকাই ছিল তাদের জন্য কল্যাণকর। তাতে দলটি ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার বরাতে জনমনে সব সময় একটা জায়গা পেয়ে যেতে পারত। অথচ এবার আওয়ামী লীগ ইতিহাসের বৃন্তচ্যুত দলের মেজাজে কাজ করেছে। তাদের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি ও ধর্মনীতি তাদের জন্য বুমেরাং হয়ে এসেছে। বিপরীতে প্রতিপক্ষের জন্য হলো শাপে বর। একতরফা নির্বাচনের জেদ তাদের ক্ষমতার দাপটই প্রমাণ করেনি, তাদের হঠকারিতার মুখোশও খুলে দিয়েছে। সঙ্গত কারণেই একটি হঠকারিতা অনেক হঠকারিতা অনিবার্য করে দিয়েছে। সম্ভবত তারই পরিণতি অপেক্ষা করছে। নানা কারণে বিরোধী দলের আন্দোলন হোঁচট খেতে পারে। বাঁক ঘুরতে পারে। কিন্তু মুখথুবড়ে পড়ার কোনো কারণ নেই। অপর দিকে সরকারি দল দাপট দেখানোর শেষ অস্ত্রটাও প্রয়োগ করে ফেলেছে। এবার চোখে অন্ধকার দেখা শুধু সময়ের ব্যাপার। জরুরি অবস্থায়ও কোনো ত্রাণ নেই। অবৈধ সরকারের মেয়াদ বাড়বে মাত্র। সেই সাথে বাড়বে পাপের বোঝা। জনগণ এখন দলনিরপেক্ষ অবস্থানে দাঁড়িয়ে রাজনীতির মুণ্ডুপাত করছে এটা যেমন সত্য, তেমনি একটি পরিবর্তন যে অনিবার্য তা-ও জানান দিচ্ছে। বিরোধী দলের সাফল্য এতটুকু যে, তারা জনমনে পরিবর্তনের হাওয়া বইয়ে দিতে পেরেছেন। এই হাওয়া একটি পরিবর্তনের ঝড় অনিবার্য করে তুলবেÑ শুধু সময়ের অপেক্ষা। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads