রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৩

নির্বাচনে পর্যবেক্ষক আসছে না


আগামী ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে অনুষ্ঠেয় প্রহসনে পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কারণ জানাতে গিয়ে গত শুক্রবার ইইউ’র এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ মহাসচিবের পাঠানো দূতের প্রচেষ্টাসহ নানাভাবে বহু উদ্যোগ নেয়ার পরও বাংলাদেশে একটি স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ  তৈরি হয়নি। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের মতো পরিবেশও তৈরি করতে পারেনি সরকার। এসব কারণেই নির্বাচনের সময় পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে ইইউ। বিবৃতিটি দিয়েছেন ইইউ’র পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ক্যাথেরিন অ্যাশটন। সহিংসতা বন্ধ করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও সরকার ও রাজনৈতিক দরগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, পরিবেশ এমন হওয়া উচিত যাতে ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থী ও দলকে বেছে নিতে ও ভোট দিতে পারে। পরদিন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ’র প্রতিনিধি উইলিয়াম হানাও এক সংবাদ সম্মেলনে একই বক্তব্য তুলে ধরেছেন। উল্লেখ্য, এই বিবৃতি ও সংবাদ সম্মেলনেরও অনেক আগে থেকে ইইউ সব দলের অংশগ্রহণে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে একই তাগিদ দিয়ে এসেছে। গত নবেম্বরে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ইইউ প্রতিনিধিরা বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে নিয়ে আসার লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দিয়েছিলেন। তারা এ কথাও জানিয়েছিলেন, সব দল অংশ না নিলে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত করতে পারে। এরই সূত্র ধরে শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্তই নিয়েছে ইইউ।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিরোধী দলগুলোর বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখেও দেশে যখন নির্বাচনের নামে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হওয়ার হাস্যকর তৎপরতা চলছে তেমন এক সময়ে ইইউ’র এই সিদ্ধান্ত ক্ষমতাসীনদের জন্য নতুন একটি চপেটাঘাত হিসেবেই এসেছে। এর মধ্যদিয়ে একই সঙ্গে এ সত্যও প্রকাশিত হয়েছে যে, সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। এমন মন্তব্য কেবল ইইউ’র না-এর কারণে করা হচ্ছে না। ইইউ’রও আগে কমনওয়েলথের প্রতিনিধিরাও প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে জানিয়ে দিয়েছেন, সব দল অংশ না নিলে সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবেন না। শুধু ইইউ এবং কমনওয়েলথ নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও গণচীনসহ বিশ্বের প্রভাবশালী সব রাষ্ট্রই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একই ধরনের অবস্থান নিয়েছে। এদের মধ্যে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল তো স্পষ্টভাষায় জানিয়েই দিয়েছেন, প্রধান বিরোধী দল অংশ না নিলে সে নির্বাচনের ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। একই বার্তা নিয়ে ৬ ডিসেম্বর ঢাকা সফরে এসেছিলেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। তিনি আসার আগে স্বয়ং মহাসচিব বান কি মুন চিঠি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তিনিও বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার এবং সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করার তাগিদ দিয়েছেন। কয়েকদিন আগে একই তাগিদ দিয়ে গেছেন ব্রিটেনের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ওয়ারসিও।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, বিভিন্ন রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বারবার তাগিদ দেয়া হয়েছে, যাতে সরকার বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করে এবং সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদক্ষেপ নেয়। একতরফা বা একদলীয় নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্য হবে না সে কথাটও সুনির্দিষ্টভাবেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্য নিয়েই সবশেষে এসেছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। মূলত তার তাগিদ ও চেষ্টাতেই বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের চারজন করে শীর্ষ নেতা তিনবার বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মহাসচিবের বিশেষ দূতকে খালি হাতেই ফিরিয়ে দিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমনকি পূর্বনির্ধারিত বৈঠক পর্যন্ত বাতিল করেছেন। এর কারণ, মিস্টার তারানকো রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের এবং সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন করতে হলে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হবে বলেই মিস্টার তারানকোকে ফুটবল খেলার মতো ‘লাল কার্ড’ দেখিয়ে বিদায় করা হয়েছে। একই কারণে ১১ ডিসেম্বর মহাসচিব বান কি মুন এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি টেলিফোনে যে অনুরোধ জানিয়েছেন তাকেও নাকচ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এভাবে সব মিলিয়েই ক্ষমতাসীনরা এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন যখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সবাই চলে গেছে সরকারের বিপক্ষে। এরই ধারাবাহিকতায় পর্যবেক্ষক পাঠানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে ইইউ।
বিষয়টিকে অবশ্যই হাল্কাভাবে নেয়া যায় না। কারণ প্রথমত, ইইউ কোনো সাধারণ সংস্থা নয়Ñ এটা ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ ইউরোপের সব রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সংস্থা। বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা এই দেশগুলো। পাশাপাশি রয়েছে ঋণ, সাহায্য ও বিনিয়োগসহ নানা ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক, যেগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশই বেশি লাভবান ও উপকৃত হয়ে থাকে। সুতরাং ইইউকে ক্ষুব্ধ ও অসম্মানিত করার পািরণতি শুভ হওয়ার কথা নয়। এর প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতির ওপর। পাশাপাশি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও গণচীনের মতো দেশগুলো, রয়েছে জাতিসংঘও। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সুযোগ পাওয়া-না পাওয়ার মতো অনেক বিষয়ও রয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচনের প্রশ্নে সবার পরামর্শ ও আহবানকে নাকচ করার মধ্য দিয়ে সরকার সেসব  রাষ্ট্র ও সংস্থাকেই ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট করে তুলেছে। এর পরিণতি ক্ষমতাসীনদের জন্য তো বটেই, দেশ ও জাতির জন্যও মারাত্মক হয়ে উঠবে। এজন্যই সরকারের উচিত ইইউ, কমনওয়েলথ ও জাতিসংঘের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও গণচীনসহ প্রভাবশালী সব সংস্থা ও রাষ্ট্রের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া এবং সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করার মাধ্যমে বিপদ কাটিয়ে ওঠার জন্য তৎপর হয়ে ওঠা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads