শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৩

আমরা কোথায় যাচ্ছি?


গত ২৭ ডিসেম্বর রাজধানীতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ে একটি সংলাপ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেছেন, ভোটের অধিকারের চেয়েও মানুষের বাঁচার অধিকার বড়। বর্তমানে দেশ যে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে এর সমাধান কোথায়? এজন্য শুধু রাজনীতিকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই উল্লেখ করে দেশের এই বিশিষ্ট নাগরিক বলেন, সংকট উত্তরণে মুক্তির একটি উপায় আমাদেরই বের করতে হবে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, দেশ এখন যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, তাতে স্পষ্ট করে কোনো সমাধান কিংবা মুক্তির উপায় যেন কেউই বলতে সাহস করছেন না। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের মত ব্যক্তিত্বও এখন বলছেন, সংকট উত্তরণে মুক্তির একটা উপায় আমাদেরই বের করতে হবে। এমন বক্তব্য থেকে প্রশ্ন জাগে, বিরাজমান সংকট উত্তরণে মুক্তির উপায় কি আমাদের জানা নেই? নাকি বিরাজমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বর্তমান সরকারের আমলে নিরাপত্তা শঙ্কার কারণে সত্য উচ্চারণে আমরা কেউই সাহসী হতে পারছি না। সংকটময় এই সময়ে বিচারপতি মহোদয় বলেছেন, ভোটের অধিকারের চেয়েও মানুষের বাঁচার অধিকার বড়। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও আমাদের এমন কথা শুনতে হচ্ছে কেন? এতদিন পরেও আমরা ভোটের ও বাঁচার অধিকার কি একসাথে পেতে পারি না? কাদের কারণে এতদিন পরেও স্বাভাবিক ওই দুটি বিষয় অর্জনে আমরা সমর্থ হলাম না? এমন পরিস্থিতিতে নাগরিকদের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, কেনই বা আমরা সমাজবদ্ধ হলাম, কেনই বা স্বাধীনতা যুদ্ধে এত রক্ত দিলাম? ভোটের ও ভাতের অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার তথা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্যই তো আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিলাম। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে যদি আমরা স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে না পারি তাহলে আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য পূরণ হবে কেমন করে? স্বাধীনতার লক্ষ্য পূরণের জন্যই তো দেশের জনগণ অবাধে নিজেদের মতামত প্রকাশের মাধ্যমে নিজেদের সরকার গঠন করতে চায়। এটাই হলো জনগণের সরকার নির্বাচনের গণতান্ত্রিক উপায়। এ পথে কোনো বাধা-বিপত্তি দেশের জনগণ কখনো মেনে নেয়নি, বর্তমানেও মানবে না। আমরা জানি, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সহিষ্ণুতার অভাবে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, উত্তাপ ও আস্থার সংকট আছে। আস্থার সংকটের কারণেই পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনের সময় দেশ এক সংকটজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। এমন সংকটের মোকাবিলায় দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে বেছে নিয়েছিল। এই পদ্ধতিতে শান্তিপূর্ণভাবে কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, জনগণও অবাধ নির্বাচনের লক্ষ্যে এই পদ্ধতির পক্ষে তুষ্টি প্রকাশ করেছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেই দলমত নির্বিশেষে দেশের সবাই একটি বাস্তব ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ কি যে হয়ে গেল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচিত বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী এ ব্যবস্থাকেই নাকচ করে দিলেন। এই নাকচ যেন আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই নাকচ করে দিল। এই নাকচ প্রসঙ্গে চলে আসে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনের কথা। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ১৫তম সংশোধনী সংসদীয় কমিটির বিশেষ সুপারিশে হয়নি। এটি হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মনগড়া সিদ্ধান্তে। তাই এই সংশোধনী অসাংবিধানিক ও অবৈধ। তিনি ১৫তম সংশোধনীর বিভিন্ন পর্যায় তুলে ধরে এক নাগরিক সংলাপে বলেন, ২০১০ সালের ২১ জুলাই প্রথম ১৫ জন সদস্য নিয়ে সংবিধান সংশোধনী কমিটি গঠন করা হয়। তারা ২৭টি মিটিং করে। মিটিং শেষে ২০১১ সালের ২৯ মার্চ বিদ্যমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অপরিবর্তিত রাখার সুপারিশ করা হয়। প্রসঙ্গত তিনি সংবিধান সংশোধনী কমিটির বিভিন্ন সদস্যের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, এটা সেটেল ইস্যু, এটা পরিবর্তন করার দরকার নেই। আমীর হোসেন আমু বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে আছে সেভাবেই রাখা উচিত। ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছিলেন, সংবিধানে তিন মাস নির্দিষ্ট করে দেয়া যেতে পারে। রাশেদ খান মেনন বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিবর্তনের দরকার নেই। কমিটির কো- চেয়ারম্যান প্রস্তাব করে বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার দরকার নেই। কিন্তু ২০১১ সালের ২৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংবিধান সংশোধনী কমিটি  দেখা করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণ আর অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দেখতে চায় না। ১০ মে কমিটি আবার বলে, শর্তসাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। ২৯ মে সংবিধান সংশোধনী কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে সুপারিশ করেন। ৩০ মে কমিটি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে সব কিছু বদলে যায়। ২০ জুন কমিটি নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সুপারিশ করে। ২০১১ সালের ২৫ জুন তা ক্যাবিনেটে ও ৩০ জুন সংশোধনীতে তোলা হয়। এভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেটেল ইস্যুকে এক ব্যক্তির ইচ্ছায় বাতিল করা হয় এবং এর থেকে যে সংকটের শুরু হয় তা জাতিকে বর্তমান বিপর্যয়ের মুখে পৌঁছে দেয়।
সংকটের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করলে যে কোনো বিবেকবান মানুষ এ কথা স্বীকার করবেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের কারণেই যেহেতু সংকটের সৃস্টি, তাই এই ব্যবস্থা পুনর্বহালের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সংকটের সমাধান। দেশ ও জনগণের স্বার্থে একটি আন্তরিক সংলাপের মাধ্যমে সেই সমাধানে সহজেই পৌঁছা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সংলাপের নামে জাতি প্রহসনের চিত্রই শুধু লক্ষ্য করেছে কিন্তু গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধান পায়নি। জাতির কাছে আজ এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সরকার যে কোনোভাবে আবারও ক্ষমতায় আসতে চায়। নির্বাচন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কিনা কিংবা বিরোধী দল নির্বাচনে আসবে কিনা, এসব বিষয়ে সরকার ভাবতে চায় না। এমন আচরণের কারণে এক সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে দেশে। সরকার দমননীতির মাধ্যমে বিরোধী দলের আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে চাচ্ছে। আর বিরোধী দল দাবি আদায়ে এগিয়ে যাচ্ছে রাজপথের আন্দোলনে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার দায়িত্বপূর্ণ আচরণ প্রদর্শনে ব্যর্থ হলে মানুষের দুঃখই শুধু বাড়বে। সরকারের মধ্যে যেন শুভবুদ্ধির উদয় হয়, সেটাই সময়ের দাবি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads