বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৩

দেশজুড়ে বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে দমন-নির্যাতন


কয়েকদিন পর্যন্ত সংলাপ মঞ্চায়ন এবং বিএনপি নেতাদের সঙ্গে এখানে-ওখানে বৈঠক করার পর হঠাৎ করেই সরে দাঁড়িয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। তিন মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, ওবায়দুল কাদের এবং হাসানুল হক ইনু গতকাল জানিয়ে দিয়েছেন, দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে তারা আর কোনো আলোচনা করবেন না। আলোচনা চলতে পারে বরং একাদশ সংসদের নির্বাচন নিয়ে। কথা শুধু এটুকুই নয়। এতদিন বলা হচ্ছিল, কথিত সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যই দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। অনুষ্ঠিত হওয়ার পর কিছুদিনের মধ্যে ওই সংসদের বিলুপ্তি ঘটিয়ে একাদশ সংসদের নির্বাচন করা হবে। অন্যদিকে সর্বশেষ উপলক্ষে তিন মন্ত্রীই জানিয়েছেন, দশম সংসদও মেয়াদ শেষ করবে। অর্থাৎ পাঁচ বছরের জন্যই সংসদ গঠিত হতে যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ দেশী-বিদেশী সব মহলের দাবি ও আহবান উপেক্ষা করে ক্ষমতাসীনরা ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন না করে ছাড়বেন না। সে লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছেন তারা। এখনও ক্ষমতায় রয়েছেন সুতরাং যা খুশি করতে তারা চাইতেই পারেন। কিন্তু আপত্তি ও প্রতিবাদ উঠেছে কিছু বিশেষ কারণে। নিজেদের অশুভ ইচ্ছা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচন নিয়ে তারা শুধু তামাশাই করছেন না, একই সঙ্গে বিরোধী দলকে নির্মূলের ভয়ংকর কর্মকা-ও চালাচ্ছেন। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে পুরো দেশকেই ল-ভ- করে ফেলছেন। গণমাধ্যমের খবরে জানার পাশাপাশি প্রত্যক্ষভাবেও জনগণকে সরকারের নিষ্ঠুরতা দেখতে হচ্ছে। অনেকে নিজেরাও শিকার হচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে, যৌথ অভিযানের নামে সরকার আসলে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কোনো অভিযোগ ছাড়াই শত শত নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে, সাতক্ষীরা, নীলফামারী ও লক্ষ্মীপুরের মতো অনেক এলাকায় প্রতিদিন অসংখ্য নেতা-কর্মীকে মেরেও ফেলা হচ্ছে। অনেককে গুমও করছে যৌথবাহিনী। এই অভিযানে পুলিশ ও র‌্যাবের সঙ্গে দেশের সীমান্ত প্রহরার জন্য গঠিত বাহিনী বিজিবিকেই শুধু নামানো হয়নি, তাদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গু-া-সন্ত্রাসী ও ক্যাডাররাও যোগ দিয়েছে। অভিযানে অনেক অচেনা মানুষকেও দেখা যাচ্ছে।
এভাবে সব মিলিয়েই দেশে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন ক্ষমতাসীনরা। বিষয়টি কিন্তু মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। কারণ, দেশের সাধারণ মানুষ তো বটেই, বিদেশীরাও এ ব্যাপারে আগে থেকে জানান দিয়েছে। যেমন ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান সম্প্রতি ‘দ্য প্রিজন দ্যাট ইজ বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত এক রিপোর্টে মন্তব্য করেছে, পুরো বাংলাদেশই এখন কারাগারে পরিণত হয়েছে। সরকারের গ্রেফতার ও প্রচ- দমন-নির্যাতনসহ রাজনৈতিক সংকটের বর্ণনা দিতে গিয়ে দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, সরকার এতটাই ভয়ংকর কৌশল অবলম্বন করেছে যে, বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগই পায়নি। দ্য গার্ডিয়ান-এর মতে বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাইরে ঠেলে দেয়ার কৌশল হিসেবেই সরকার দমন-নির্যাতন চালাচ্ছে এবং পুরো দেশকে কারাগার বানিয়ে ছেড়েছে। ওদিকে কাছাকাছি ধরনের বর্ণনা রয়েছে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আল-জাজিরার ওয়েবসাইটের এক রিপোর্টেও। রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখন ‘খুরের ফলার ওপর’ রয়েছে এবং দেশটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। শুধু তা-ই নয়, বিশ্লেষকরা আশংকা প্রকাশ করেছেন, আফগানিস্তান ও ইসরাইলের মতো  বাংলাদেশেও ‘সিলেক্টেড কিলিং’ শুরু হতে পারে, যার শিকার হবেন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা। এই বিশ্লেষকদের মতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেছে বেছে হত্যার অভিযান এরই মধ্যে শুরুও হয়ে গেছে। আল-জাজিরার রিপোর্টটিতে বিশেষ জোর দিয়ে বলা হয়েছে, বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখার ফলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে হত্যার অভিযান ক্রমাগত মারাত্মকই হতে থাকবে। বাস্তবেও কথাটার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত কথিত জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। বুধবারও তিনি বলেছেন, তাদের নির্মূল করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সিনিয়র নেতারা। কেউ কথিত জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের ‘দেখা মাত্র’ গুলী করার নির্দেশ দিয়েছেন, কেউ আবার এই বলে হুংকার দিয়েছেন যে, এখন আর প্রতিরোধ বা প্রতিহত করা হবে না বরং নেয়া হবে ‘প্রতিশোধ’। তারা এই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রতি হুকুমও জারি করেছেন।
এভাবে সব মিলিয়েই ক্ষমতাসীনরা একদিকে সংসদ নির্বাচনকে তামাশার বিষয়ে পরিণত করেছেন, অন্যদিকে সন্ত্রাস-সহিংসতা দমনের নামে শুরু করেছেন অঘোষিত হত্যা, নির্যাতন, ধ্বংসের অভিযান। এই মুহূর্তে তাদের প্রধান লক্ষ্য যে কোনো পন্থায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পাড়ি দেয়া। এটা পাড়ি দেয়ার পর ‘সাংবিধানিকভাবেই’ তারা আবারও ক্ষমতায় আসবেন। বলা দরকার, সরকারের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনও লেগে আছে ‘আদা-জল’ খেয়ে। একান্ত আনুগত্যের ভূমিকা পালন করার জন্য কমিশন এমনকি নিজের আইনও দিব্যি অমান্য করে চলেছে। এ ধরনের কার্যক্রমের কারণেই বলা হচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়া যথার্থই নির্বাচন কমিশনকে ‘অথর্ব’, ‘মেরুদ-হীন’ এবং ‘সেবাদাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কমিশন আসলেও দশম সংসদ নির্বাচনকে তামাশার বিষয়ে পরিণত করে ছেড়েছে। অন্যদিকে আমরা কিন্তু মনে করি, সরকার বা নির্বাচন কমিশনের ইচ্ছা বা চাওয়াটাই শেষ কথা হতে পারে না। কারণ, একদিকে বিরোধী দলের সঙ্গে ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে, অন্যদিকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও সরকারকে প্রায় পরিত্যাগ করেছে। সুতরাং চাইলেই ক্ষমতাসীনরা বেশিদিন হত্যা ও নিষ্ঠুরতা চালাতে পারবেন না। হত্যা ও দমন-নির্যাতনের পথে ‘নির্বাচন’ করে আবারও ক্ষমতায় আসতে চাইলে সংকট বরং অনেক বেশি মারাত্মক হয়ে উঠবে। তাদেরকেও হতে হবে অশুভ পরিণতির মুখোমুখি। সেজন্যই ক্ষমতাসীনদের উচিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার আগেই নির্বাচনের তফসিল বাতিল করে সবকিছু এমনভাবে পুনরায় নির্ধারণ করা, যাতে সব রাজনৈতিক দল অংশ নিতে পারে। সে নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে এবং নির্বাচনকালীন সে সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদে শেখ হাসিনা থাকতে পারবেন না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads