সহিংসতা এবং গণতন্ত্র একদম ভিন্ন জিনিস। গণতন্ত্র অর্থ জনগণের দ্বারা জনগণের জন্য জনগণের একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় জনগণ একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচিত করেন। তারা মিলিত হয়ে একটা সরকার গঠনের মাধ্যমে একটা নির্দিষ্ট মেয়াদে দেশের শাসন পরিচালনা করেন। এই ব্যবস্থায় সন্ত্রাস ভায়োলেন্সের সুযোগ নেই। সন্ত্রাস সংঘর্ষ হানাহানি কোনো কিছুকেই প্রশ্রয় দেয় না এই ব্যবস্থায়। কিন্তু সন্ত্রাস সংঘর্ষে অষ্টেপৃষ্টে বাধা পড়েছে আমাদের দেশ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত কয়েক শত লোক নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে হাজার, হাজার। দেশের যে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাপ কেউ করেননি। এর ওপর নতুন করে শুরু হয়েছে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসার সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর অভিযান। গত কয়েক দিনে শুধু সাতক্ষীরা অঞ্চলেই নিহত হয়েছে ডজন খানিক মানুষ। যাদেরকে বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে না তাদের অনেকের বাড়িঘর ধ্বংস ও গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আর একটা গুরুতর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে যে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সামিল হয়েছে সরকারপক্ষীয় রাজনৈতিক কর্মীরা। তারাও এই অভিযানে শরিক হয়ে হত্যা, নির্যাতন, ভাঙচুর করছে বলে জানা যাচ্ছে। ঘটনা যদি সত্য হয় তাহলে বিষয়টা হবে ভয়াবহ এবং সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অগ্রহণযোগ্য।
প্রত্যেক নির্বাচনের সময়ই দেশে রাজনৈতিক উত্তাপের সৃষ্টি হয়। বাগ-বিত-া এবং সংঘাত-সংঘর্ষ কিছু ঘটে। কিন্তু আজ দেশে যা ঘটছে কোনো সময় এমনটা তো ঘটেনি। এর বড় কারণ অতীতে সংবিধানের অধীনেই সব কিছুই ঘটেছে আর এবার খোদ সংবিধানই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দেশের সবগুলো দল একমত হয়ে সংবিধানে নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সন্নিবেশিত করেছিল। বর্তমান সরকারও এই ব্যবস্থার অধীনেই ২০০৮ সালে নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের পর তারা সংবিধান থেকে এই ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটালো। কোর্টের রায় কোনো বৈধ অজুহাত নয়, কারণ কোর্টের রায়ে আরো দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছিলেন। সংবিধান থেকে সরকার তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা সরিয়ে দিয়ে এমন এক ব্যবস্থা সন্নিবেশিত করেছে যার দ্বারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার চাইলে যতদিন ইচ্ছা ক্ষমতায় থাকতে পারে। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই দেশের সকল বিরোধী দল আন্দোলন করে আসছে এবং শুরুতেই তারা বলেছে এই ব্যবস্থায় তারা নির্বাচনে যাবে না। তারা দাবি করছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনা হোক। কিন্তু সরকার এদিকে কর্ণপাত না করে, রাষ্ট্রীয় শক্তির ওপর ভর করে নির্বাচন করে ফেলতে চাচ্ছে। বিরোধী দল এ নির্বাচন বয়কট করেছে এবং প্রতিরোধের ডাক দিয়েছে। এই নিয়েই আজকের সংঘাত। বিরোধী দল সরকারকে নির্বাচন বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে বাধ্য করতে চাচ্ছে অন্যদিকে সরকার বিরোধী দলের এই রাজনৈতিক আন্দোলন ও প্রতিরোধী তৎপরতাকে সন্ত্রাস আখ্যা দিয়ে তাদের প্রতিরোধকে গুঁড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। আজ সাতক্ষীরায় যা ঘটছে, লক্ষীপুরে যা ঘটছে এবং গোটা দেশে হানাহানির যে দৃশ্য আমরা দেখছি তা এই সংঘাতেরই ফল।
এই সংঘাত সকলেরই ক্ষতি করছে, দেশের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। এই অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার। এই বেরিয়ে আসার চাবিকাঠি সরকারের হাতে। জনগণের দ্বারা জনগণের জন্য এবং জনগণের যে গণতন্ত্র তা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা। বিরোধী দল বা জনগণের যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন-উদ্ভূত যে ঘটনা প্রবাহের সৃষ্টি হচ্ছে তাকে এক কথায় সন্ত্রাস বললে ভুল হবে। যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে অব্যাহতভাবে বাধা দিয়েই চলে, গণতন্ত্র এবং সংবিধান তাদের যে অধিকার দিয়েছে তা ভোগ করতে অব্যাহতভাবে বাধা দেয়া হয়, তাহলে প্রতিরোধ উপেক্ষা করে প্রতিবাদী যাত্রা সামনে অগ্রসর হতে চাইতেই পারে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যদি এই গতি রোধ করতে নির্মমভাবে শক্তি প্রয়োগ করে তাহলে এক পর্যায়ে সংঘাত বাধতেই পারে। অতীতে আমরা এটাই দেখেছি। দুঃখজনকভাবে এখনও আমরা সেটাই দেখছি। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সরকারকেই তার অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। হিংসা প্রতিহিংসাই ডেকে আনে। কিন্তু আমরা জনগণ শান্তি চাই ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন