নির্দলীয় নিরপে
সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি এখন আর ১৮ দলীয় জোটের দাবি নয়। এ দাবি এখন গোটা
জাতির। নির্দলীয় নিরপে সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয়
জোট আওয়ামী সরকারের সাথে সর্বোচ্চ দেনদরবার করেও ব্যর্থ হয়েছে।
কিন্তু
১৮ দলীয় জোট যতই এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছে, আওয়ামী
সরকার ততই পিছু হটেছে। এরা কোনো মতেই নির্দলীয় নিরপে নির্বাচন দিতে চান না। এরা
বারবার সংবিধানের দোহাই দিচ্ছেন। এটি আওয়ামী লীগের পুরনো রোগ। তাদের অনুকূলে থাকলে
সংবিধানের দোহাই দিতে থাকেন। সংবিধান ছাড়া কিছুই হবে না বলে মূর্ছা যান। আর
নিজেদের অনুকূলে না থাকলে এরা সংবিধানের কথা বেমালুম ভুলে যান। অথচ এই আওয়ামী লীগ
জামায়াতকে সাথে নিয়ে ১৯৯৫-’৯৬ আমলে ১৭৩ দিন হরতাল
করে, গানপাউডার দিয়ে বাসে আগুন
লাগিয়ে মানুষ হত্যা করে, অফিসগামী সরকারি
কর্মকর্তাদের দিগম্বর করে, রেললাইন, রেলস্টেশন, বিমান অফিস, সরকারি কার্যালয়
পুড়িয়ে দিয়ে এবং অসংখ্য মানুষের জীবন সংহার করে তৎকালীন বিএনপি সরকারকে বাধ্য
করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন পাস করতে। সংবিধান, আইন, আদালত, আন্তর্জাতিক সব প্রচেষ্টাকে এরা তখন বুড়ো
আঙুল প্রদর্শন করেছিলেন। ২০০৬ সালেও সংবিধানকে এরা বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন। বিএনপি
সরকার বিচারপতিদের বয়স দুই বছর বাড়াল, যা
এরা কোনোভাবে মানতে চাননি। তাদের যুক্তি ছিল, বিচারপতি
কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করার জন্যই এই কাজ করেছে বিএনপি। ৩০ বছর
আগে বিএনপির সাথে যুক্ত ছিলেন কে এম হাসান, এই
ছুতায় একজন সুপরিচিত বিচারপতিকেও তারা মানতে পারেননি। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর
পল্টনে আওয়ামী লীগ কর্মীরা লগি-বৈঠার তাণ্ডব চালিয়ে পৈশাচিক কায়দায় যে মানবহত্যায়
মেতে উঠেছিল তা দূর ইতিহাসেও খুঁজে পাওয়া যায় না। কথায় কথায় তারা তখন বঙ্গভবনের
অক্সিজেন বন্ধ করে দেয়ার কথা বলতেন। বলতেন আগুন লাগিয়ে দেয়ার কথা। আদালতের রায়
পছন্দ না হওয়ায় আদালতের দরজা লাথি মেরে ভেঙে ফেলে, ব্যাপক ভাঙচুর করে তারা সে দিন প্রমাণ করেছিলেন সংবিধান, আইন, আদালত
তারা কতটুকু শ্রদ্ধা করেন। ইতিহাস স্যা দেয়, দেশ
স্বাধীনের আগে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছিল আওয়ামী লীগ; কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর জনগণ দেখল ভিন্ন
কিছু। কয়েক মিনিটে গণতন্ত্র জবাই করে বাকশাল এলো। চারটি সরকারি পত্রিকা বাদে সব
পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেল। জাসদের হাজার হাজার কর্মী রীবাহিনীর হাতে খুন হয়েছিল।
সংবিধান লঙ্ঘন করে এরশাদের মতা নেয়ায় হাসিনা বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম নট আনহ্যাপি’। ’৮৬-এর
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যাবে না বলেও স্বৈরশাসককে বৈধতা দিতে তারা সে দিন নির্বাচনে
গিয়েছিল। এক-এগারোর অবৈধ সরকারকেও তারা ওয়েলকাম করে বলেছিল, এই সরকার আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল। এরপর
২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে কিভাবে আওয়ামী সরকার মতায় এসেছিল, তার বয়ান আমরা পেয়েছি মার্কিন
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারির কাছ থেকে।
সারা
বাংলাদেশের জনমত, আইনজ্ঞদের সুপারিশ এবং
প্রধান বিরোধী জোটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার না থাকলেও
প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সংবিধান কাটাছেঁড়া করে একদলীয়
সংবিধানে পরিণত করা হয়েছে। যারা একজন বিচারপতির ৩০ বছর আগের সম্পর্কের সূত্র ধরে
তার অধীনে নির্বাচনে যেতে রাজি হয়নি, সেই
আওয়ামী লীগ একজন দলীয় প্রধানের অধীনে নির্বাচনের জন্য বিধান করে এখন সংবিধান
সংবিধান করে চিৎকার করে বেড়াচ্ছে।
সরকারদলীয়
মিডিয়াসহ দেশী-বিদেশী সব ধরনের জরিপে দেখা গেছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পে দেশের ৯০ ভাগ মানুষ।
বিগত চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিরোধীদলীয় জোট প্রার্থীদের বিজয়ী করে জনগণ
জানান দিয়েছে, এরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
অধীনে নির্বাচন চায়। সুশীলসমাজ, নাগরিকসমাজ, আইনজীবী, শিাবিদ সবাই নিরপে সরকারের দাবি করে আসছেন। নিবন্ধিত ৪০ দলের
মাত্র ১৪ দল আওয়ামী লীগের সাথে নির্বাচনে যাচ্ছে, যার মধ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থন ও মার্কা ছাড়া অন্য দলের বিজয়
হওয়া অসম্ভব। জাতীয় পার্টির এরশাদ নিজের ভুল সিদ্ধান্তের কথা বুঝতে পেরে অবশেষে
জনগণের কাতারে শামিল হলেন; কিন্তু তাতে হবে কী, গত এক মাসে ঝরে গেছে প্রায় ৮০টি তরতাজা
প্রাণ। আরো কত মানুষ প্রাণ বিসর্জন করেন তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। এরশাদ যদি আরো
আগেই নিজের অবস্থান জনগণের পে নিয়ে নিরপে তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে অনড় থাকতেন তাহলে
হয়তো পুলিশের গুলিতে এত প্রাণ চলে যেত না। সরকার একগুঁয়েমি করে থাকতে পারত না। ‘সেই তো মল খসালি তবে কেন লোক হাসালি’ এই প্রবাদবাক্যটিই কেবল মনে পড়ছে এখন।
এরশাদের
বিলম্বিত বোধোদয় হলেও আওয়ামী প্রধান শেখ হাসিনার কি বোধোদয় হবে? তিনি কি জনগণের মনের ভাষা পড়ে পদত্যাগ করে
জাতিকে রার কোনো উদ্যোগ নেবেন, নাকি একদলীয় শাসন
পাকাপোক্ত করার জন্য আরো বেশি নিষ্ঠুর হবেন। গত ১০ নভেম্বর ইসলামিক ফাউন্ডেশনের
শ্রেষ্ঠ ইমাম পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে আবেগমথিত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেনÑ ‘বিশ্বাস করেন, যখন দেখি এভাবে মানুষ পোড়ায়, তখন এত কষ্ট লাগে, মনে হয় প্রধানমন্ত্রিত্ব দরকার নেই। আমি
প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। মানুষের শান্তি ও উন্নয়ন চাই। মানুষের এত কষ্ট সহ্য হয়
না।’ শেখ হাসিনার ওই উক্তি শুনে
দেশপ্রেমিকদের বুকে পানি এসেছিল। এরা ভেবেছিলেন, হাসিনা পদত্যাগ করে এবার বুঝি জাতিকে রা করবেন; কিন্তু না সে আশায় গুড়েবালি। জনগণ বরং
উল্টো নাটক ল করছে। ঢাকা-নরসিংদীর বাস পুড়ছে আজিমপুরে আর সব টিভি চ্যানেলের
সাংবাদিকেরাও সেখানে উপস্থিত! ঢাকায় শত শত ককটেল ফুটছে। যারা আগুন লাগাচ্ছে কিংবা
ককটেল মারছে পুলিশ এদের কাউকে ধরতে পারছে না। জনগণ দু-চারজন যাদেরকে ধরছে তারা
আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত। ঠিক বগুড়ায় শহীদ মিনার ভেঙে ধরা খাওয়ার পর যেভাবে দেখা
গিয়েছিল। সাংবাদিক নূরুল কবির টিভি টকশোতে বলেছেন, ‘বিআরটিসি এবং বিহঙ্গ পরিবহনে বারবার কেন আগুন লাগছে? তদন্ত করলেই বের হয়ে আসবে, বিরোধী দলের আন্দোলনকে নসাৎ করার জন্যই
সরকার এসব করছে।’ চুলার আগুনে পুড়ে যাওয়া
অন্তঃসত্ত্বা শিরিন আক্তারকে নিয়ে মিডিয়া কত মর্মস্পর্শী কায়দায় বিরোধী দলের
অবরোধের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেছে; কিন্তু সত্য চাপা থাকে
না। প্রধানমন্ত্রী পুড়ে যাওয়া দু-চারজন ব্যক্তির কাছে গিয়ে সমবেদনা জানাচ্ছেন; কিন্তু বিগত এক বছরে পুলিশের গুলিতে যে শত
শত মানুষ মরেছে, তাদের জন্য তার বিন্দুমাত্র
সমবেদনা ছিল কি?
গত
২৮ নভেম্বর আমার দেশ পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে একটি নিউজ আমাদের দৃষ্টি কেড়েছে।
লাটভিয়ার রাজধানী রিগায় এক বিপণিবিতান ধসে
৫৪ জন মারা যাওয়ার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী ভালদিস দমব্রভস্কিস ২৭ নভেম্বর ঘটনার
রাজনৈতিক দায়দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ করে তার সরকারও ভেঙে দেন। লাটভিয়ার
প্রধানমন্ত্রী যেখানে দুর্ঘটনায় বিল্ডিং ধসের কারণে পদত্যাগ করে সরকার ভেঙে দেন
সেখানে বাংলাদেশে বর্তমান সরকার লাশের ওপর দিয়ে মতাকে দীর্ঘায়িত করার নীলনকশা
আঁকে। জাতি হিসেবে দুর্ভাগ্যই বলতে হবে আমাদের।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন