সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন করার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে কমিশন। এখন পর্যন্ত নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা কী হবে তা নিয়ে দুই জোটের মধ্যে কোনো সমাধান হয়নি। ফলে একতরফা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে দেশ। একদিকে চলছে নির্বাচনের প্রস্তুতি, প্রার্থী হওয়ার দৌড়ঝাঁপ, মনোনয়ন পাওয়ার তদবির। তা নিয়েও চলছে গোলযোগ, বৈরিতা, অশান্তি, অস্থিরতা। ওদিকে দাবি-দাওয়া নিয়ে শুরু হয়েছে আন্দোলন। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন-
রাজা আসে যায় রাজা বদলায়
নীল জামা গায় লাল জামা গায়
এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রঙ বদলায়
দিন বদলায় না!...
রাজা আসে যায় আসে আর যায়
শুধু পোশাকের রঙ বদলায়
শুধু মুখোশের ঢং বদলায়...
(‘রাজা আসে যায়’)।
স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরও শান্তিপূর্ণ উপায় ও ব্যবস্থা হলো না ক্ষমতা হস্তান্তরের? চলমান রাজনৈতিক বৈরী আবহাওয়ার মুখেও তোড়জোড় চলছে দশম সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার। আসন্ন নির্বাচনের সম্ভাব্য তফসিল ঘোষণার আগে ও পরের সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ করে এনেছে নির্বাচন কমিশন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করলেও নির্বাচন কমিশন তাদের জন্য অপেক্ষা করবে না। এ জন্য সর্বস্তরের কর্মকর্তাকে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
নবম সংসদের চেয়ে এবার ১ কোটি ৯ লাখের মতো বেশি ভোটার থাকায় প্রয়োজনীয় সব কিছুই অপেক্ষাকৃত বেশি করে সরবরাহ করে রাখছে নির্বাচন কমিশন। দশম সংসদে ৩০০ আসনে ভোটার তালিকাভুক্ত ৯ কোটি ১৯ লাখ ৪৮ হাজারেরও বেশি ভোটার রয়েছে। এবার ৭০ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা, ৬০০ সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, ৩৮ হাজারের বেশি ভোট কেন্দ্র, ২ লাখের মতো ভোট কক্ষ, ৬ লাখের মতো ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার (প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসার) প্রয়োজন হতে পারে। বিদ্যমান ভোটার সংখ্যা বিবেচনায় স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, মার্কিং সিল, অমোচনীয় কালি, স্ট্যাম্প প্যাডসহ প্রয়োজনীয় নির্বাচনী মালামাল সংগ্রহ, ভোট কেন্দ্র স্থাপন, নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় ম্যানুয়াল, প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র, প্রিসাইডিং-পোলিং অফিসারদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ব্যালট পেপার মুদ্রণ করতে হবে। ভোটের অন্যতম উপকরণ নির্বাচনী আইন সংস্কার, ছবিসহ ভোটার তালিকা ও সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনঃনিধারণ কাজ শেষ হয়েছে। বাজেট বরাদ্দ পর্যাপ্ত রয়েছে এবারও।
কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিশন ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন-মোহাম্মদ আবদুল মোবারক, মোহাম্মদ আবু হাফিজ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) মোঃ জাবেদ আলী, মো. শাহ নেওয়াজ। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব পদে রয়েছেন ডঃ মোহাম্মদ সাদিক।
রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সবার দৃষ্টি যখন নির্বাচন কমিশনের দিকে, ঠিক তখনই সমন্বয়হীনতায় বেহাল অবস্থা চলছে কমিশনে। কমিশন বৈঠক বর্জনের ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। যদিও সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ গণতান্ত্রিক সরকার ও প্রতিষ্ঠানকে সচল রাখার জন্য অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা করা।
৩ নবেম্বর ২০১৩ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় কমিশনের সভা। সভা শেষে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘আদালতের রায়ের কপি হাতে পেলেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তার আগে কোনো মন্তব্য নয়।’
তফসিল ঘোষণার সম্ভাব্য কোনো তারিখ ঘোষণা না করলেও নির্দিষ্ট সময়ে তফসিল ঘোষণা হবে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘সাংবিধানিক সময়ের মধ্যে তফসিল ঘোষণা হবে। আমরা ৪০-৫০ দিন সময় হাতে রেখে তফসিল ঘোষণা করব, তবে সম্ভাব্য কোনো তারিখ বলা যাচ্ছে না।’
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায় নিয়েও নির্বাচন কমিশনাররা এক কথায় থাকতে পারেননি। ১৪ আগস্ট নির্বাচন কমিশনার জাবেদ আলী বলেছিলেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের আপিল করার সুযোগ আছে। আপিল নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত জামায়াতের নিবন্ধন বহাল থাকবে। তারা নির্বাচনও করতে পারবে।
কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর কমিশনার আবু হাফিজ ২ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলোকে বলেছিলেন, রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর জামায়াতের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
৭ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ বলেছেন, হাইকোর্টের রায়ের পর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়ে গেছে। হাইকোর্ট বলেছেন, কমিশন যে প্রক্রিয়ায় জামায়াতকে নিবন্ধন দিয়েছে, তা বৈধ ছিল না। আদালত এখন ভিন্ন কোনো নির্দেশনা না দিলে দলটি আপাতত নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। তাই কমিশন আপাতত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, কোনো বিজ্ঞপ্তিও জারি করবে না।
একতরফা নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ১০ নবেম্বর ২০১৩ বলেছেন, দশম সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার জন্য নির্বাচন কমিশন কারও দিকে তাকিয়ে নেই। তিনি বলেন, যথাসময়ে তফসিল ঘোষণা করা হবে। এর জন্য কমিশন প্রস্তুত আছে। ২৪ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে যথাসময়ে তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে জানান তিনি।
নবেম্বরের মধ্যে এ তফসিল ঘোষণারও ইঙ্গিত দেন সিইসি। আগামী জানুয়ারির শুরুতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হতে পারে। নবেম্বরের শেষ সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি রয়েছে।
তফসিল ঘোষণার পর পরই পরিপত্র জারি করে রিটার্নিং কর্মকর্তা-সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণ, চূড়ান্ত ভোট কেন্দ্রর গেজেট, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার বৈঠক, আইন-শৃঙ্খলা বৈঠক, জনবল নিয়োগ, ব্যালট পেপার ছাপানোসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিকল্পনা মেনে শেষ হবে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সরকারের যে কোনো বিভাগ/সংস্থার প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা চাইবে ইসি।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, আইন-শৃঙ্খলা বৈঠকের পর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগে-পরে অন্তত পাঁচ দিন নির্বাচনী এলাকায় থাকে সেনাবাহিনী। তবে বহুল আলোচিত ১৫ ফেব্রুয়ারি ও বাতিল হওয়া ২২ জানুয়ারির নির্বাচনে বেশি সময় মাঠে ছিল সশস্ত্র বাহিনী। সামরিক শাসন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দীর্ঘ দিন সেনা মাঠে থাকলেও ভোটের জন্য পাঁচ-সাত দিন অবস্থানের রেওয়াজ রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়মিত সদস্যরা সাধারণ নির্বাচনে পাঁচ দিন এবং উপ-নির্বাচন, স্থানীয় নির্বাচনে চার দিন এলাকায় থাকেন।
সর্বশেষ ২০০৮ সালের নবম, ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ ও ২০০১ সালের অষ্টম সংসদে পাঁচ-সাত দিন মাঠে ছিল সেনাবাহিনী। রাজনৈতিক পরিস্থিতির উত্তাপের মধ্যে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে ভোটের প্রচারণা থেকে অন্তত দুই সপ্তাহর বেশি সময় সেনা মোতায়েন ছিল। ২০০৬ সালের বাতিল হওয়া ২২ জানুয়ারির ভোটের আগে ৯ জানুয়ারি থেকে মাঠে নামে সেনাবাহিনী। ইসি পরিস্থিতি বিবেচনায় আইন-শৃঙ্খলা বৈঠকে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ওপর এবারও সেনা মোতায়েনের সময়সীমা ও এলাকা বাছাই করা হতে পারে। (সূত্রঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ১২ নবেম্বর ২০১৩)
নির্বাচন কমিশনের ২০০৮ সালের আচরণবিধির বদলে ১৩ নবেম্বর ২০১৩ তারিখে চূড়ান্ত হওয়া আচরণবিধিতে ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়ের’ পরিমাণ অর্ধেক কমিয়ে আনা হয়েছে। এতে কোনো অজ্ঞাত কারণে নিজের ক্ষমতাই খর্ব করেছে কমিশন।
সংবিধানের ১২৩ (৩)-এর ধারা অনুযায়ী সংসদের মেয়াদের শেষ ৯০ দিন ‘নির্বাচনকালীন সময়’, যা বিদ্যমান আচরণবিধিতে ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়’ বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সংবিধান নির্দেশিত নির্বাচনকালীন সময়ে কমিশনের রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার কথা। সংবিধান কমিশনকে এ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ৯০ দিনের জন্য দিলেও আচরণবিধি সংশোধনের মাধ্যমে কমিশন তা অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে, যার কারণ বোধগম্য নয়। কমিশনের চূড়ান্ত করা এ আচরণবিধি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
২৭ অক্টোবর ২০১৩ থেকে নির্বাচনকালীন সময়ের সূচনা হলেও ক্ষমতাসীন দল বিনা দ্বিধায় নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী সরকারি ব্যয়ে ও অন্যান্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছেন ও বিভিন্ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করছেন এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী জনসভা করে নিজ দলের পক্ষে ভোটও চাইছেন। নিঃসন্দেহে এসব কর্মকা- আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে।
বিদ্যমান আচরণবিধির ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বা তার মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী অথবা তাদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি নির্বাচনের তারিখের আগের ২১ দিন কোনো প্রকার নির্বাচনী প্রচার করতে পারবেন না। তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশন তাদের চূড়ান্ত করা আচরণবিধি থেকে এ ধারাটিই তুলে দিয়েছে।
১৪ নবেম্বর ২০১৩ জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে ‘নির্বাচনী আইন সংস্কারঃ আমরা কোথায়?’ শীর্ষক এক সাংবাদিক সম্মেলনে বর্তমানে নির্বাচন কমিশন যে ধরনের আচরণ করছে, তা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বিরাট বাধা বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেছেন, কমিশনের চূড়ান্ত করা আচরণবিধি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একইসঙ্গে তিনি ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে কোনো প্রয়োজনে ক্ষমতা ব্যবহারে অনিচ্ছা ও অপারগতা প্রকাশ, আচরণবিধি ও আরপিও সংশোধন, সরকারি দলের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ব্যবস্থা না নেয়াসহ বিভিন্ন কর্মকা-ের কারণে কমিশনের সমালোচনা করেন। (সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক ১৩ নবেম্বর ২০১৩)
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই মনোনয়নপত্র বিক্রি ও জমা নেওয়ার কাজ সমাপ্ত করেছে আওয়ামী লীগ। চলেছে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের শক্তি প্রদর্শন। ১৭ নবেম্বর পর্যন্ত হাতি, ঘোড়া ও ট্রাক নিয়ে মিছিল আর মোটরসাইকেল মহড়া দিয়ে রাজপথে মিছিল করেছে ক্ষমতাসীন দল। সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার একের পর এক মিছিল যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। বিকেলে আবার ফেরার সময়ও একই অবস্থা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯০ দিনই ছিল ‘নির্বাচনপূর্ব সময়’। কিন্তু এখন যারা ক্ষমতায়, তারা পূর্ববর্তী ৯০ দিনকে ‘নির্বাচনকালীন সময়’ হিসেবে মানছেন না। কমিশনও বলছে, তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনকালীন সময়। সরকার আইনের ফাঁকফোকর খুঁজে বের করে রাজপথে শক্তি দেখাচ্ছে।
নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র কেনা বা জমা দেওয়ার সময় হাতি-ঘোড়া নিয়ে মিছিল করা বা মোটরসাইকেল মহড়া দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ রকম পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। আচরণবিধি অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া বা কেনার সময় সর্বোচ্চ পাঁচজন যেতে পারেন।
আওয়ামী লীগ বলছে, নির্বাচনী আইনে মনোনয়নপত্র বিতরণে কোনো বাধা নেই; বরং তৃণমূল থেকে প্রার্থী মনোনয়নের মাধ্যমে প্রতিটি আসনে একজন প্রার্থী চূড়ান্ত করার বাধ্যবাধকতা আছে। আওয়ামী লীগ মনোনয়নপত্র বিতরণের মাধ্যমে দলের সব পর্যায়ের নেতাদের নির্বাচনে আসার সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০(বি)(৪)-এ বলা হয়েছে, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলের ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ কেন্দ্র থেকে মনোনয়নপত্র দিচ্ছে। এতে তৃণমূলের মতামত কীভাবে নেওয়া হবে, সে সম্পর্কে দলটি কিছু বলছে না।
আওয়ামী লীগের এমন আচরণের কারণে মানুষ কষ্ট ভোগ করেছে। নির্বাচন কমিশনও ছিল নীরব। নির্বাচন কমিশন বলেছে, তফসিল ঘোষণার আগের সময়টি ‘নির্বাচনকালীন সময়’ নয়। তাই কমিশনের কিছু করার নেই। নির্বাচন কমিশনার মোঃ জাবেদ আলীর মন্তব্য, ‘রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে তাদের দলের মনোনয়নপত্র বিলি করবে, তা তাদের বিষয়। তফসিল ঘোষণার পর কোনো রাজনৈতিক দল যদি আচরণবিধি লঙ্ঘন করে, তখন তা কমিশন দেখবে।’ (সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ১৭ নভেম্বর ২০১৩)
বিদায়ী নির্বাচন কমিশন দশম জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বেশ কিছু আইনি কাঠামো প্রণয়নের প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। কিন্তু মন্ত্রণালয় তাদের সে প্রস্তাবগুলো ফেরত পাঠায়। বর্তমান কমিশন সর্বশেষ প্রস্তাবিত খসড়ায় আরপিওর ৪১টি ধারায় ছোটবড় পরিবর্তনের প্রস্তাব আনে। প্রস্তাবগুলো থেকে আইন মন্ত্রণালয় ২৮টি ধারার ছোটবড় পরিবর্তনের প্রস্তাব করে। এর মধ্যে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেনি।
নির্বাচন কমিশন বা আইন মন্ত্রণালয় কারো প্রস্তাব না থাকলেও পাস হওয়া বিলে নিবন্ধিত দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ৩ বছরের সদস্য পদ থাকার যে বিধান ছিল তা রহিত করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে ভাঙার চক্রান্তে এমন আইন পাস করা হয়েছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্বাচন হয় নাগরিকদের জন্য। আর বাংলাদেশে দুটো দলের মধ্যে লড়াই হচ্ছে। এ লড়াইয়ে রেফারিও থাকছে না। সরকারি দলের প্রচার-প্রচারণায় কমিশন কোনো বাধা দিচ্ছে না।
সারা দেশের কোনো উপজেলা নির্বাচন অফিসে নিরাপত্তা কর্মী নেই। ২৪টি জেলা নির্বাচন অফিসেও নৈশ প্রহরী নেই। বাকি ৪০টি জেলা অফিসে নিরাপত্তা কর্মী থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ২০০৯ সালের আগে বেশির ভাগ উপজেলা নির্বাহী কর্মর্কর্তার কার্যালয়ে উপজেলা নির্বাচন অফিস ছিল। ইউএনওর নিরাপত্তা কর্মীরাই তখন নির্বাচন অফিসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেন। সার্ভার স্টেশন স্থাপনের জন্য আলাদা ভবন নির্মাণ করায় ওই সুযোগ পাচ্ছেন না মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। নতুন ভবনে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার অফিস ও নির্বাচনী মালামাল সংরক্ষণ করা হচ্ছে। অর্থাৎ একই ভবনে ভোটার সার্ভার, কম্পিউটার, স্কানার, প্রিন্টার মেশিন, আসবাবপত্র, ভোটারদের তথ্যসংবলিত ফরম, বিগত নির্বাচনগুলোর রেকর্ড ও আগামী সংসদ নির্বাচনের স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সসহ অন্যান্য মালামাল রয়েছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় সরকার ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধি ও বিরাজমান আইন-শৃংখলা পরিস্থিতিতে আতংকে আছেন নির্বাচন কমিশনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা। নির্বাচনের সময় যতই এগিয়ে আসছে জীবনের নিরাপত্তা ও নির্বাচনী মালামাল সংরক্ষণ নিয়ে জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছে। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাচন অফিসে আগুন দেয়া ও মালামাল পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় নির্বাচন কর্মকর্তাদের মধ্যে নতুন করে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগে আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ঢাকা জেলা নির্বাচন অফিসের সামনে ককটেল হামলা হয়। কর্মকর্তাদের আশংকা, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্বাচন অফিসগুলোতে ধারাবাহিক হামলার ঘটনা ঘটতে পারে। (চলবে)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন