রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

বিয়াল্লিশতম এই বিজয় দিবসের ভাবনা

আজ জাতি পালন করছে ৪২তম বিজয় দিবস। একটি জাতিকে অগ্রগতির শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে পৌঁছানো, জাতিকে বিশ্ববাসীর কাছে একটি গর্বিত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা, দেশের প্রত্যেক মানুষের মৌল চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠা করা, গণতন্ত্রের ভিত রচনার জন্য অপরিহার্য জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করানো, সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা, গণতান্ত্রিক ধারায় সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করার মতো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য এই চার দশকেরও বেশি সময়কে কম বলার সুযোগ নেই। কারণ আমাদের চোখের সামনেই আমরা দেখেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া দেশ জাপানকে মাত্র এক-দেড় দশক সময়ে জাপানিরা বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আমরা তা পারিনি চার দশকেরও বেশি সময়ে ও আরো কয়েক দশকে পারব কি না, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।
কেন আমাদের এই ব্যর্থতা? এক কথায় এ প্রশ্নের জবাব দেয়া মুশকিল। কারণ এই ব্যর্থতার কারণ বহুমাত্রিক, কোনো মতেই একমাত্রিক নয়। প্রথমেই উল্লেখ প্রয়োজন, এ ব্যর্থতা কাটানোর জন্য একটি সরল স্বীকারোক্তি প্রয়োজন : আমাদের স্বীকার করতে হবে এ ব্যর্থতা আমাদের সবার। কিন্তু সমস্যাটা হলো আমাদের অনেকেই এ সত্যটুকু স্বীকার করতে চাই না। সব দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানোর জন্য অন্যের দিকে আঙুল তুলি। আর নিজেদেরকে ধোয়া তুলসীপাতা হিসেবে জাহির করতে পছন্দ করি। ফলে আমাদের ব্যর্থতার কারণ চিহ্নিত করার বদলে পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়িই চলে সবচেয়ে বেশি। কাদা ছোড়াছুড়ি থেকেই জন্ম নেয় অসহিষ্ণু আচার-আচরণ। হতে পারে কারো এই ব্যর্থতার দায় বেশি, আবার কারো দায় তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম। এই দোষদর্শিতার প্রবল প্রবণতা থেকেই আসে জাতীয় বিভাজন। যে কারণে স্বাধীনতার ৪২ বছর পেরিয়েই আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি পাইনি।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, জাতীয় অগ্রগমন নিশ্চিত করার একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্যসূত্রেই কিন্তু আসে একটি ঐকমত্য ভিত্তিক জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মসূচি বা পরিকল্পনা। ঐকমত্যভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মসূচি সর্বোচ্চ সাফল্য পায়, কারণ এ কর্মসূচিতে গোটা জাতির অংশগ্রহণ ও অনুসমর্থন থাকে অন্য যেকোনো কর্মসূচির তুলনায় বেশি। দুর্ভাগ্য স্বাধীনতার ৪২তম এই বিজয় দিবসে এসে যখন নির্মোহ আত্মসমালোচনায় নামি, তখন জাতীয় বিভাজনচিত্রই আমাদের সামনে প্রবলভাবে ভেসে ওঠে। আমাদের এই দুর্ভাগ্যজনক বিভাজন আজ হানাহানিতে রূপ নিয়েছে। মনে হচ্ছে, বিভাজিত দুই পক্ষ পরস্পরকে নির্মূল করার আত্মঘাতী পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। এই পরিস্থিতি সৃষ্টিতে কে কতটুকু দায়ী, এর উত্তর আমাদের সবার জানা। কিন্তু বিষয়টি যদি আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব নির্মোহভাবে স্বীকার না করেন, তবে এর সমাধান আশা করা বোকামিরই নামান্তর। কার্যত এখন ঘটছে তাই। বিভাজনের দেয়াল উপড়ে ফেলার পরিবর্তে সে দেয়ালকে আরো মজবুত করা হচ্ছে। এই বিভাজন আমাদের জাতিকে যেকোনো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে দাঁড় করাচ্ছে, সাধারণ মানুষ টের পেলেও মনে হচ্ছে টের পাননি আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব। মনে হচ্ছে, বিষয়টি তারা বুঝেও বুঝতে চাইছেন না, যার ফলে জাতীয় ঐক্যসূত্র আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই জাতীয় অস্তিত্ব হুমকির মুখোমুখি হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
সত্যিই অবাক হতে হয়, স্বাধীনতার চার দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে আমরা একটা সর্বসম্মত নির্বাচন প্রক্রিয়া বা সূত্র খুঁজে বের করতে পারলাম না। যদিও ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের একটি সর্বসম্মত নির্বাচনী সরকারব্যবস্থা পেয়েছিলাম, তাও জনমতের বাইরে গিয়ে সরকার ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার জন্য নিছক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর ভর করে সেই ঐকমত্যভিত্তিক নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে আজকে দেশে ভয়াবহ এক রাজনৈতিক সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে। এই রাজনৈতিক সঙ্কট দেশে এমন এক রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার জন্ম দিয়েছে, যার ফলে মানুষ আজ পথেঘাটে মরছে। সারা দেশের মানুষ নিজেদের আজ বিন্দুমাত্র নিরাপদ ভাবতে পারছে না। এই রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার জন্য বর্তমান সরকারের বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক দমনপীড়নও কম দায়ী নয়। বিষয়টি দেশের বিবেকবান সব মানুষকে উদ্বিগ্ন করছে বৈকি। গত শনিবার দৈনিক মানবজমিনে এক খবরে দেখলাম, দেশে দীর্ঘ দিন ধরে আলোকিত মানুষ গড়ার আন্দোলনে নিয়োজিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ আগের দিন সিরডাপ মিলনায়তনে এক নাগরিক আলোচনায় মন্তব্য করেনÑ ‘দেশ এখন গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের কবলে পড়েছে। এটি সামরিক স্বৈরতন্ত্রের চেয়েও আরো বেশি খারাপ। সত্যিকার অর্থে দেশে কোনো গণতন্ত্র নেই।
কিন্তু সরকারি দলের নেতাকর্মীদের যা বক্তব্য-বিবৃতি তাতে মনে হয়, আওয়ামী লীগই এদেশের একমাত্র আর্দশিক দল, বাকি কোনো দলের কোনো আদর্শ বলতে নেই। এসব দলের রাজনীতি করার কোনো অধিকারও নেই। ফলে এদের দমনপীড়ন চালিয়ে অস্তিত্বহীন করাই যেন তাদের লক্ষ্য। তাই রাজনৈতিক দলের অফিস ঘিরে রাখতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে। সেখানে ঢুকতে দেয়া হবে না নেতাকর্মীদের। প্রয়োজনে তালাবদ্ধ রাখা হবে রাজনৈতিক দলের অফিস। সেই সাথে চলবে বিরোধী দল ভাঙনের নানা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কূটকৌশল। সারা দেশের মানুষ যখন চায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন, তখন সরকার মহাব্যস্ত একটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার মরিয়া প্রচেষ্টায়। এরই মধ্যে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সরকারি জোটের প্রার্থীরা। এর ফলে সারা দেশে আজ রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন কয়েকজন করে মানুষ। কেউ মরছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে, কেউ মরছেন বিুব্ধ জনতার সহিংস বিক্ষোভের শিকার হয়ে। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে, এমনকি বিভিন্ন দেশ ও জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে একতরফা নির্বাচন বন্ধ করে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর বারবার অনুরোধ-উপরোধ জানালেও সরকার তা আমলে না নিয়ে নিজ এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথেই হাঁটছে। সরকারের একগুঁয়েমি জাতিকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা আমরা কেউ আন্দাজ-অনুমান করতে পারছি না।
আমাদের জাতীয় জীবনে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, আমরা জনগণের ওপর আস্থা রাখতে পারি না। জনগণের চাওয়া-পাওয়া কী তা আমরা জানতে চাই না। জনচাহিদার মূল্য দিতে চাই না। ফলে প্রতিটি নির্বাচনে জনগণের হাতে অবাধে নেতৃত্ব নির্বাচনের সুযোগ দিতে চাই না। তা করতে গিয়ে নিজেদের পছন্দমতো সংবিধান কাটাছেঁড়া করি। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে এই কাটাছেঁড়া চলে অবাধে। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে পার্লামেন্টারি ক্যুর মাধ্যমে দেশকে একদলীয় শাসনের দিকে ঠেলে দিই। অবস্থা বেগতিক দেখলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান থেকে তাড়িয়ে দিই। সংবিধান থেকে গণভোটের ব্যবস্থাকেও বাতিল করি। এই গণভোটের ব্যবস্থা থাকলে আজকের বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট আমরা সহজেই শক্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে পারতাম। আজ সরকারি দল চাইছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। বিরোধী দল বলছেÑ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। সরকারি দল ও বিরোধী দল পরস্পর বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়ে অনড়। সেই সূত্রে আজকের এই রাজনৈতিক সঙ্কট। আজ যদি গণভোট প্রথা আমাদের সংবিধানে বহাল থাকত, তবে এ বিষয়টি গণভোট দিয়ে এর সহজ সমাধান আমরা পেয়ে যেতাম। এতগুলো প্রাণ আমাদের দিতে হতো না। কিন্তু এ সরকার সে সুযোগ থেকে দেশবাসীকে বঞ্চিত করে সংবিধান থেকে গণভোট প্রথা বাদ দিয়ে।
সবশেষে বলতে চাই, জনগণের চাওয়া-পাওয়ার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমাদের জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে হবে জনগণের ইস্পাত-কঠিন ঐক্য গড়ে। জনগণের মধ্যে বিভাজন জিইয়ে রেখে, এই বিভাজন আরো বাড়তে দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় না। এ উপলব্ধি আমাদের মধ্যে যত বেশি করে আসবে ততই মঙ্গল। মঙ্গলের সড়ক ধরে হোক আমাদের সবার পথচলা। স্বাধীনতার ৪২তম বিজয় দিবসে এই হোক আমাদের প্রতিশ্রুতি।


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads