ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
শেখ হাসিনা এবার
চাইলেন, ভারতের প্রত্যক্ষ মদদে তিনি
আর কমপক্ষে একদফা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবেন। তা নিয়ে অনেক কিছু ঘটছে। আরো
কয়েক দিন ধরে ঘটবেও। শেখ হাসিনা প্রথমে চাইলেন, যেভাবেই
হোক বিএনপিকে এই নির্বাচনের বাইরে রাখতে হবে। তার জন্য প্রথম থেকেই বিএনপি ও জামায়াতের
ওপর তিনি খড়গহস্ত হয়ে উঠলেন। কারণে-অকারণে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আটক
করলেন। উচ্চতর আদালতের নির্দেশে জামিন পেলেও জেলগেটে তাদের আবার আটক করা হয়। এ
খেলা চলেই আসছে। এই মুহূর্ত পর্যন্ত জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতারা কারাবন্দী
আছেন। বেশির ভাগই আবার যুদ্ধাপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত। এর পরের স্তরের
নেতা যারা আছেন তাদের দশা একই। অকারণ মামলায় তারাও কারাবন্দী।
সারা
বিশ্বের নিষেধ উপেক্ষা করে সরকার এক বিতর্কিত রায়ে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার
ফাঁসি দিয়েই ছেড়েছে। এই প্রক্রিয়া বিশ্ববাসীর কাছে ছিল এক বিস্ময়। আন্তর্জাতিক
যুদ্ধাপরাধ আদালতকে আদালত পদবাচ্যই মনে করেনি অনেক মানবাধিকার সংস্থা। সে
প্রতিবাদও তারা জানিয়েছেন। পেপার কাটিং থেকে শুরু করে সাক্ষীকে হাজির না করে পুলিশ
দিয়ে তার নামে লিখিত জবানবন্দীকেই সাক্ষ্য বলে মেনে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এত কিছু
সত্ত্বেও ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতীয়
প্ররোচনায় সরকার শাহবাগে এক মঞ্চ খুলে বসে। এরা দাবি তোলে, যাবজ্জীবন মানি না। কাদের মোল্লাকে অবশ্যই
মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। সরকারের উচিত ছিল আদালতের বিরুদ্ধে এ ধরনের উক্তি করায়
পিটিয়ে এদের পিঠের চামড়া তুলে দেয়া। কিন্তু না, সরকার
এ দারুণ কাজ করে বসল। ট্রাইব্যুনাল আইনের শত সংশোধনী সত্ত্বেও তাতে এমন কোনো ধারা
ছিল না যে, সরকার ট্রাইব্যুনালের রায়ের
বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। আপিল করতে পারবে শুধু বিবাদী।
তাহলে
ভারতীয় সেবাদাস এই সরকারের সামনে উপায় কী? এরা
আইন সংশোধন করল। সংশোধন করে এমন বিধান করল যে, শুধু
বিবাদীই নয়, বাদী পক্ষ অর্থাৎ সরকারও
আপিল করতে পারবে। দুই পক্ষই আপিল করল। ভারত আর সরকারের মদদে শাহবাগে ফাঁসিপন্থীদের
জজবা চলতে থাকল। সেখানে অবস্থিত তিনটি হাসপাতাল অকেজো হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল
শাহবাগ দিয়ে চলাচলকারী দক্ষিণাঞ্চলের সব যানবাহন। কেউ কোনো পরোয়াও করল না। রোগী
এবং চলাচলকারী সাধারণ মানুষ কতটা যে অসহায় হয়ে পড়েছিল, সেটা অনুধাবন করার শক্তি সরকারের ছিল না।
মনে হচ্ছিল, ওই এজেন্টদের প্রধান ইমরান
সরকারই সুপার সরকার। তারা গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থায় হাসিনা সরকারের অস্তিত্ব বিলুপ্ত
করে ফেলল। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার তাদের কাছে এতটাই অসহায় ছিল যে, কোনো প্রতিকারই করতে পারল না। আপিল হলো।
আপিলে বিবাদীপক্ষের আবেদন বিবেচনায় নেয়া হলো না। সরকারপক্ষের আবেদন বিবেচনায় নিয়ে
কাদের মোল্লার শাস্তি বাড়িয়ে দেয়া হলো। অভিযোগ, শাহবাগিদের
দাবির কাছে নতি স্বীকার করে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। এ খবরও সারা
বিশ্বে আলোড়ন তোলে।
যা
হোক, কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়
কার্যকর হয়ে গেছে। যে অপরাধ তিনি করেননি বলে বারবার দাবি করেছেন। আসামিপক্ষের
অভিযোগ, ‘বিতর্কিত’ বিচার প্রক্রিয়ায় সেই ‘অপরাধে’ই
তাকে মৃত্যুবরণ করতে হলো। তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা করেননি এবং তিনি
বারবার বলেছেন, তিনি কিছুতেই রাষ্ট্রপতির
কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন না। আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতিরা গত কয়েক বছরে দুই ডজনের
অধিক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তারাও হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট অতিক্রম করে মৃত্যুর প্রহর
গুনছিল। কাদের মোল্লা বলেছিলেন, তিনি শহীদের মর্যাদা
নিয়ে মরতে চান। ক্ষমা তিনি চাইবেন না। শহীদি মৃত্যুই বরণ করবেন। শেষমুহূর্ত
পর্যন্ত তিনি স্থির ছিলেন। এমনকি একেবারে ফাঁসির মঞ্চে ওঠার সময় পর্যন্ত তিনি
ছিলেন স্মিত হাস্যময়। মহান আল্লাহ তায়ালা তার গুনাহ ক্ষমা করে তাকে বেহেশত নসিব
করুন।
কিন্তু
আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ কিছুই অর্জন করতে পারেনি। এক সময়
এরা বলতে পারত যে, আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
করেছি। অতএব আমাদের ভোট দিন। তাদের সে মুখও গেছে। ভোটের পরিস্থিতি বড় বেশি বেহাল।
বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায়, তাহলে জামায়াতও যাবে
না। শতকরা পাঁচ ভাগ ভোট আছে জামায়াতের। সেটাও কম নয়। তার ওপর প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, যুগান্তর যতগুলো জনমত জরিপ করেছে, তার কোনোটাতেই আওয়ামী লীগের জয়ের পূর্বাভাস
দেয়া হয়নি; বরং সবটাতেই আওয়ামী লীগের
ভয়াবহ ভরাডুবির ছবি ফুটে উঠেছে। কেন আওয়ামী লীগের বাস্তব চিত্র তারা তুলে ধরল, তা নিয়ে ক্ষোভের শেষ ছিল না আওয়ামী
নেতৃবৃন্দের। শেষ ভরসা ছিল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি।
কিন্তু
এরশাদ হিসাবে খুব একটা ভুল করেননি। তিনি সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন, আওয়ামী লীগ তাকে যে আশ্বাসই দিক না কেন, পাঁচ-দশটা ছাড়া কোনো আসনেই এরশাদের জাতীয়
পার্টিকে ছাড় দেবে না। বড়জোর দশটি আসনে ওই নির্বাচনে তার দল জয় লাভ করতে পারবে। এ
দিকে হঠাৎ করেই তিনি বলে বসলেন, তিনি নির্বাচনে যাবেন
না, এটাই ফাইনাল। বিকেলে বা তার
এক দিন পরই হঠাৎ করে তিনি বলে বসলেন, দেশ
ও গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচনে যাওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই।
কে
এই শৃঙ্খল এরশাদের হাতে-পায়ে পরিয়েছে, সেটা
আমাদের জানা নেই। কিন্তু শৃঙ্খল তার পায়ে আছেই। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং
ঢাকায় এসেছিলেন ভারতীয় দালাল হিসেবে পরিচিত শেখ হাসিনা ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের
সাথে কথা বলতে। উভয় নেত্রী নেতার সাথে তিনি কিছুক্ষণ কথা বলেছেন। তারপর হাসিনা ও
এরশাদের সাথে ঘণ্টাখানেক একান্ত বৈঠক করেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার সাথেও তিনি বৈঠক
করেছেন। কিন্তু বেগম জিয়া একান্ত বৈঠক করেননি। কিন্তু এই প্রথম এরশাদ একান্ত
বৈঠকের খবর মিডিয়ায় প্রকাশ করে দেন। তিনি বলে দেন, সুজাতা সিং তাকে কী বলতে এসেছিলেন। সুজাতা সিং বলতে এসেছিলেন
যে, এলোমেলো না করে শেখ হাসিনার
যেকোনো শর্ত মেনে নিয়ে তিনি যেন আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তার কারণ হিসেবে
সুজাতা সিং বলেছিলেন, এরশাদ যদি নির্বাচনে
অংশ না নেয়, তাহলে বাংলাদেশে মৌলবাদের
উত্থান ঘটবে; এটা কাম্য নয়। জবাবে এরশাদ
তাকে বলেন, যদি এই দেশে মৌলবাদের উত্থান
ঘটে তার জন্য দায়ী হবে শেখ হাসিনা সরকার, জাতীয়
পার্টি নয়। অতএব শেখ হাসিনাকে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হবে।
এখানে
হয়তো সুজাতা সিংয়ের আর কোনো জবাব ছিল না। কারণ সুজাতা সিং জেনেই এসেছেন, শেখ হাসিনা যেকোনো মূল্যে বিএনপি ও
জামায়াতকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেবে না। কিন্তু মিস সিং অনুধাবন করতে পারেননি, যে সরকারের পক্ষ হয়ে তিনি এই দালালি করতে
এসেছেন, সেই সরকারের পায়ের নিচের
মাটি একেবারেই ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। প্রাদেশিক পরিষদগুলোর নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে, পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে হিন্দু মৌলবাদী দল
বিজেপি চারটিতে জয় লাভ করেছে। আর মাত্র একটিতে জয় লাভ করেছে কংগ্রেস। আর শেষ
পর্যন্ত এরশাদ ভারতীয় বলয়ে থাকতে চাননি। তিনি ঘোষণা করেন, আগামী নির্বাচনে কোনো অবস্থাতেই তিনি
অংশগ্রহণ করবেন না। এটাই তার ফাইনাল কথা। এই কথার ওপর জোর দিয়ে তিনি বললেনÑ ‘নির্বাচনে অংশ নেব না, নেব না, নেব
না। এটাই ফাইনাল।’
এরপর
থেকেই সরকারের নতুন খেলা শুরু হলো। এরশাদের বাসার সামনে প্লাটুন প্লাটুন র্যাব-পুলিশ
মোতায়েন করা হলো। তাতেও এরশাদ বিচলিত হননি। তিনি এখন পর্যন্ত নির্বাচনে না যাওয়ার
সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন। কিন্তু জাতীয় পার্টিতে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছে সরকার।
কাজী জাফর আহমেদের নেতৃত্বে একদল তো আগেই গেছে। কিন্তু এবার রওশন এরশাদকে দিয়ে
আবারো ভাঙন সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে সরকার। রওশন এরশাদের মাধ্যমে কয়েকজন নেতাকে
জাতীয় পার্টি সাজিয়ে এখন এক ভানুমতির খেল চলছে। যারা রওশন এরশাদকে ঘিরে নির্বাচনে
জাতীয় পার্টিকে বহাল রাখতে চাইছেন, তারাও
মুখ খুলছেন না। অর্থাৎ পুরোপুরি এরশাদের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না।
তাহলে
সরকার কী করবে? সরকার ভালো কাজ করেছে। এরশাদ
যাতে মিডিয়ায় তার অনড় অবস্থানের কথা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে যেতে না পারেন, সে জন্য এরশাদের বারিধারার বাসভবন
প্রেসিডেন্ট পার্কের পেছনের দরজা দিয়ে উঠে সরকারের নির্দেশে র্যাব গাড়িতে তুলে
সিএমএইচ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে দিয়েছে। সরকারের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, তিনি অসুস্থ। তাকে নিরাপদে সিএমএইচে ভর্তি
করতেই র্যাব তাকে নিয়ে গেছে। আর সিএমএইচ থেকে এক বিবৃতিতে এরশাদ বলেছেন, ‘আমি অসুস্থ নই। আমাকে গ্রেফতারের জন্য
সিএমএইচে নিয়ে আসা হয়েছে।’
যা
হোক, জাতীয় পার্টির ফ্যাক্টর
এরশাদই, রওশন এরশাদ নন। জাতীয়
পার্টির সদস্যরা এরশাদের নির্দেশেই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে দলে দলে
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন যেটা খুশি মানছে, যেটা খুশি মানছে না। তাতে আর কী-ই বা হবে।
এরশাদ ইসিকে বলেছেন, জাতীয় পার্টি ইলেকশন
করছে না। অতএব লাঙ্গল মার্কা যেন কাউকে না দেয়া হয়। ইসি হয়তো বলবেন, এই মার্কা রওশন এরশাদের নামে। তিনি চাইলে
লাঙ্গল প্রতীক তাকে বরাদ্দ দিতে হবে। কী আশায় যে রওশন দু-চার, পাঁচজনকে নিয়ে নির্বাচনের দিকে যাচ্ছেন, আল্লাহই মালুম। কারণ যে ৪৬টি আসন রওশনের
নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে দেয়ার কথা, তার
মধ্যে এ পর্যন্ত একজন মাত্র আওয়ামী লীগার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন। রওশন
এরশাদের আসনসহ বাকি ৪৫ আসনেই আওয়ামী লীগ লড়ছে।
শেষ
পর্যন্ত লাঙ্গল মার্কা ব্যালট পেপারে থাকবে কি না, বলা এখনো দুষ্কর। মেনন, দিলীপ, ইনু নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করবেন।
তাহলে এক নির্বাচন এক পার্টি। এক মার্কা এক ভোট। আরো একবার জয় বাংলা। এর মধ্যে
বিএনপির সাথে সংলাপ-নাটক চলছে। হারজিত জানি না। বিএনপি চাইলেও এখন আর নির্বাচনে
যেতে পারবে না। দায়দায়িত্বহীন সিইসি বলেই যাচ্ছেন যে, সমঝোতা হলে কী-ই না সম্ভব! কাকে ছি ছি বলব? এখন সরকার, নির্বাচন কমিশন আর রওশনকে ছি ছি বলার সময় এসেছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন