ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী :
হরতালে অবরোধকালে বাসে বোমা হামলায় যারা দগ্ধ হয়েছেন, আমরা তাদের প্রতি গভীর সহমর্মিতা জানাই। এ ধরনের সহিংসতা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই সহিংসতা কিংবা মানবতাবিরোধী কাজ কারা করেছে? আজকাল প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও নেতাদের মধ্যে ‘হুকুমের আসামী’ নামে এক ধরনের প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই হুকুমের আসামী হিসেবে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপি’র শীর্ষস্থানীয় ৩২ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। হ্যাঁ, হুকুমের আসামী কেউ থাকতে পারে। এবং অবশ্যই সেটা খুঁজে বের করা সরকারের পবিত্র কর্তব্য।
তবে ইতিপূর্বে বাংলাদেশে আরো এমন নির্মম, নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলে থাকার সময় চট্টগ্রামে তার দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আপনারা কি চুড়ি পরে থাকেন? একটি লাশ পড়লে দশটি লাশ ফেলে দেবেন। তারপর চট্টগ্রামে অনেক লাশ পড়েছে। হুকুমের আসামী হিসেবে শেখ হাসিনাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। বিডিআর বিদ্রোহে পিলখানায় ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তা খুন হন। সেক্ষেত্রে হুকুমের আসামী কারা ছিলো, তা নির্ধারণ করা হয়নি। তার আগে লগি-বৈঠা নিয়ে ঢাকায় এসে তার নেতা-কর্মীদের তা-ব সৃষ্টি থেকে নরহত্যার উস্কানি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। হুকুমের আসামী হিসেবে তখনও তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। সুতরাং হুকুমের আসামী বলে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতাদের দশবার চিন্তা করা উচিত ছিলো।
অবরোধের সময় মৎস্য ভবনের কাছাকাছি কড়া নিরাপত্তাবেষ্টিত এলাকায় বাসে কারা বোমা মেরেছে, তা এখনও সম্ভবত তদন্তাধীন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তার পারিষদ দল এবং অনুগত মিডিয়া অবিরাম প্রচার করে যাচ্ছে যে, ঐ বোমা হামলা অবরোধকারীরাই করেছে। কেউ গ্রেফতার হয়নি, কেউ আটক হয়নি তাহলে কোন বস্তুনিষ্ঠতায় ১৮ দলীয় জোটকে ঐ হামলার জন্য দায়ী করা হচ্ছে? ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি, বাসে বোমা হামলা চালায় সাধারণত আওয়ামী লীগাররাই। এ ব্যাপারে তাদের ক্ষমতাও সর্বজনবিদিত। বিরোধী দলে থাকাকালে হোটেল শেরাটনের সামনে যাত্রীবাহী দোতলা বাসে আগুন দিয়ে ১১ জন মানুষকে মৃত্যুর মুখোমুখি ঠেলে দিয়েছিলো আওয়ামী লীগাররাই। সেখানে ‘হুকুমের আসামী’ও শনাক্ত হয়েছিলো। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি।
আসলে দেশব্যাপী জনগণ এই সরকারের বিরুদ্ধে যে ঘৃণার আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে, যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, তার থেকে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার জন্যই, বিরোধী দলের প্রতি জনগণের ঘৃণার উদ্রেক করার জন্যই সরকার ও সরকারের অনুগত মিডিয়া অবিরাম প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা বলছেন, এই যে মানুষের আহাজারি আর্তনাদ, দুইজন মানুষের মৃত্যু এ সব কিছুর জন্য বিরোধীদল দায়ী। বিরোধীদলের তরফ থেকে শক্তভাবে এর প্রতিবাদ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ তাদের অধিকাংশ নেতা-কর্মী এখন কারাগারে অথবা আত্মগোপনে। এমনকি বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যিনি বিএনপি’র কার্যালয় থেকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কর্থাবার্তা বলছিলেন, গত ৩০শে নবেম্বর পুলিশ মই বেয়ে উঠে, দরজা ভেঙে, টেনে-হিঁচড়ে রিজভীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আর ভেঙে তছনছ করে দেয় বিএনপি অফিসের প্রতিটি কক্ষ। এখন আর এক যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন আহমেদ অজ্ঞাত স্থানে থেকে মাঝে মধ্যে ভিডিও বিবৃতি দিচ্ছেন। অন্য নেতারা আত্মগোপনে।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের জন্য বিরোধী দলের প্রতি বিষোদ্গার অনেক বেশি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। দোষী চিহ্নিত হয়নি, অথচ দায় চাপানো হচ্ছে বিরোধী দলের ওপর। শুধু তাই নয়, হাসপাতালে গিয়ে শেখ হাসিনা বলে বসলেন, এই বোমা হামলার জন্য বিরোধী দলীয় নেত্রী দায়ী এবং তিনি গণহত্যায় উস্কানি দিচ্ছেন। ৫ মে শাপলা চত্বরে যখন হাসিনা সরকারের পুলিশী হামলায় শতসহস্র ধর্মপ্রাণ মুসল্লি প্রাণ হারালেন, তখন বিরোধী দলীয় নেত্রী তাকে গণহত্যা বলে অভিহিত করেছিলেন। সে সময় শেখ হাসিনা ও তার স্তাবকেরা একেবারে রা রা করে উঠেছিলেন। তারা বলছিলেন, গণহত্যা শব্দটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অতএব, ঐ ঘটনাকে গণহত্যা বলে বেগম খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি চরম অসম্মান প্রদর্শন করেছেন। ভালো কথা। সেই সব স্তাবক এখন সাহস থাকলে বলুক দেখি যে, শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি চরম অসম্মান প্রদর্শন করলেন। শেখ হাসিনা যদি বলেন, তবে সব ঠিক। আর অন্য কেউ বললেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একেবারে ধুলিসাৎ হয়ে যায়। এটা বাংলাদেশের রীতিতে পরিণত হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকারি দলের লোকেরাই মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্যই বাসে বোমা হামলা চালিয়েছে। এই বোমা হামলার জন্য অশ্রুপাত করলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু গত কয়েকটি দিনে তার পেটোয়া পুলিশ বাহিনী আর আওয়ামী সন্ত্রাসীরা যে সারাদেশে ৩০ জনেরও অধিক আদম সন্তানকে হত্যা করলো, তার জন্য শেখ হাসিনার অশ্রুপাত কোথায়?
শেখ হাসিনা ও তার পারিষদেরা এখন বলছেন, অবরোধ ডেকে ঘরে বসে থাকেন কেনো, রাস্তায় নামুন, দেখা যাক কার কতো শক্তি। দারুণ আহ্বান। এই আহ্বান শুনে ছেলেবেলায় দেখা ‘রূপভান যাত্রা’র কথা মনে পড়ে গেলো। রূপভান ১২ দিনের শিশু রহিম বাদশাহকে স্বামী হিসেবে বরণ করে ১২ বছরের জন্য বনবাসে যায়। সেখানে অনেক কাহিনী। রহিম বাদশাহকে বাঘে খেতে আসে। রূপভান বাঘের কাছে গান গেয়ে কান্নাকাটি করে। আস্তে আস্তে রহিম বাদশাহ’র ১২ বছর বয়স হয়। তখন সে মন্ত্রীকন্যা তাজেলের প্রেমে পড়ে। এ নিয়েও অনেক কথা। তাজেলের বাবা এটা মানতেই চান না। তারপর একদিন শেষ পর্যন্ত তিনি রহিম বাদশাহকে ‘ধরো অস্ত্র করো রণ’ বলে যুদ্ধে আহ্বান জানায়। তারপর শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। সে যুদ্ধে রহিম বাদশাহ জয়ী হন। রূপভান তো তার স্ত্রী আছেই। তারপরও তিনি তাজেলকেই বিয়ে করেন। আর শেষে সুখে শান্তিতে জীবন কাটাতে শুরু করেন।
আওয়ামী নেতাদের বিএনপি নেতৃবৃন্দকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানিয়ে তেমনি এক যাত্রাভিনয় শুরু করেছেন। যদি তাই হয়, তাহলে আপনারাও নামুন দেখি রাস্তায় পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সশস্ত্র মাস্তান ছাড়া। জনগণ আপনাদের একেবারে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে। তার প্রমাণ কি এই অবরোধের মাধ্যমে পাচ্ছেন না? বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৭ শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে গত ২৯ নবেম্বর যখন গাড়ী পোড়ানোর মামলা দিলো সরকার। তখন ১৮ দল ৩০ নবেম্বর সকাল থেকেই ৩ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ৭২ ঘণ্টা অবরোধের ডাক দেয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ কি লক্ষ্য করেছেন যে, দেশের জনগণ আর পরদিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি। তৎক্ষণাৎ রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলো? কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অচল করে দিয়েছিলো সারাদেশ। এখনও অবরোধ কর্মসূচি চলছে। দেশ অচল হয়ে আছে। রাজধানী ঢাকা কার্যত বিচ্ছিন্ন। কই, আপনারা রাস্তায় নামুন। এই জনতাকে প্রতিরোধ করুন। সে শক্তি কি আপনাদের আছে? কোনো মন্ত্রী, এমপি, নেতা এখন কি ঢাকার বাইরে যাবার ক্ষমতা রাখেন? এই জাগ্রত জনতাই ১৮ দলীয় জোটের ক্ষমতা। এই শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে, এমন সাধ্য কারও নাই।
আওয়ামী লীগে যারা এখনও ফটর ফটর করেন, তারাও তা করেন বিবি এভিনিউ বা ধানম-ি কার্যালয়ে এসি রুমে বসেন। ঘর থেকে বের হন পুলিশ পাহারায়। দৌড় এখন আপনাদের এই পর্যন্তই। সুতরাং, অত বেশি ফটর ফটর ভালো নয়। সরকার কিংবা তার পেটোয়া বাহিনীর নির্যাতনের প্রতিবাদে এখন প্রতিদিন এই অবরোধের মধ্যেও ছয়-সাত জেলায় হরতাল হচ্ছে। সেসব হরতাল কেন্দ্রীয়ভাবে ডাকা হচ্ছে না। অত্যাচার, নির্যাতনে অতিষ্ঠ মানুষ যার যার মতো প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। যেখানেই নির্যাতন সেখানেই প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, হরতাল। আবার কোথায়ও কোথায়ও আওয়ামী লীগের নিজ দলের লোকেরাও হরতাল ডাকছে। সড়ক অবরোধ করছে। শেখ হাসিনার অতি পেয়ারের সাবেক মন্ত্রী ‘দেশসেরা দেশপ্রেমিক’ সৈয়দ আবুল হোসেন মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে মাদারীপুরে সড়ক অবরোধ করেছেন। কোন পথে পালাবেন? পালাবার পথ নেই। জনগণ তাদের প্রতিরোধের অস্ত্র উঁচিয়ে ধরেছে। আপনারা ধারালো তরবারি নিয়ে এগিয়ে দেখুন, একেবারে ছত্রখান হয়ে যাবেন।
এর মধ্যেও একদলীয় নির্বাচন করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার অনৈতিক লিপ্সায় সরকার মদমত্ত। সে নির্বাচন হবে কিনা এখনও বলা যায় না। জনগণ দেখিয়ে দিয়েছে, তারা দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ প্রতিরোধ টিকিয়ে রাখতে সক্ষম। এই প্রতিরোধ অব্যাহত থাকলে সরকারের সেবাদাস বা ক্রীতদাস নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নির্বাচন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তখন তারা কাজ একটাই করতে পারবে। তা হলো শেখ হাসিনা তার হাতে যে তালিকা ধরিয়ে দেবেন সেই তালিকাভুক্তদের বিজয়ী ঘোষণা করে তিনি তার আনুগত্য পুনরায় প্রমাণ করতে পারবেন। সকল শক্তি শেখ হাসিনার হাতে। সকল ক্ষমতা শেখ হাসিনার হাতে। যেনো বাংলাদেশে এখন রাজতন্ত্র কায়েম হয়েছে। রাজতন্ত্র কায়েম করলেও অন্যান্য রাজতান্ত্রিক দেশের মতো তাকে স্বাধীন পার্লামেন্ট দিতে হবে। তখন আর তার রাজতন্ত্রের কোনো মূল্য থাকবে না। তাছাড়া এদেশের মানুষ সে রাজতন্ত্র কোনদিন মেনেও নেবে না। এখানকার মানুষের জীবনধারা গড়ে উঠেছে লড়াইয়ের মাধ্যমে। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে এরা হাজার হাজার বছর টিকে আছে। এরা জলের ঐশ্বর্য কেড়ে জীবনের উপাদান আনে। গহীন সমুদ্রে নৌকা ভাসায় সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ অতিক্রম করে আরব্ধ অর্জন করে। এদের বশীভূত করা সহজ কাজ নয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন