৩০ নভেম্বর রাত ৩:৪০ মিনিটে
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ডিবি পুলিশের একটি দল কমান্ডো স্টাইলে হামলা চালায়।
গ্রেফতার করা হয় যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমদও আরো একজনকে। আসবাবপত্র
ভাঙচুর ছাড়াও মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ। ভেঙে ফেলা হয় বিরোধীদলীয়
নেত্রী ও দলের মহাসচিবের বসার চেয়ার-টেবিল। রিজভী আহমদকে জামার কলার ধরে নিচে
নামানো হয়। জামাকাপড় পাল্টানোরও সুযোগ দেয়া হয়নি। --- সমস্যা আছে বিধায় হাঁটার
জন্য তার প্রয়োজনীয়, লাঠিটিও সাথে নিতে
পারেননি। পুলিশের অভিযোগ, তিনি শাহবাগ ও মতিঝিলে
গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের আসামি; কিন্তু
গ্রেফতারের নামে কারো বাসাবাড়ি কিংবা অফিস তছনছ করার কোনো অধিকার কি পুলিশের আছে? রিজভী বেশ কিছু দিন ধরে দিনরাত বিএনপির
কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান করছিলেন। পুলিশ চার দিক থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয়
কার্যালয় ঘিরে রেখেছিল, যা দেশবাসী প্রতিনিয়ত
প্রত্যক্ষ করছেন। তিনি তো পলাতক ছিলেন না। তারপরও কেন রাতের আঁধারে পুলিশের ভীতি
উদ্রেককারী ও মারমুখো অভিযান?
রিজভী
আহমদ রাজনীতিতে নতুন মুখ নন। দীর্ঘ সময় ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন।
কথাবার্তা ও আচার-আচরণে তিনি বিনয়ী সজ্জন। আমরা যারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্র ছিলাম, তারা সবাই তাকে জানতাম। একজন
ভালো, সৎ ও যোগ্য নেতা হিসেবে তিনি
সুপরিচিত। রাজনীতিকে তিনি অর্থ, প্রভাব বা খ্যাতি
অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছেনÑ এমন কোনো নজির দেশবাসী
প্রত্যক্ষ করেনি। তিনি সুস্থ ধারার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। বর্তমানে দেশের সব
রাজনৈতিক দলে হাতেগোনা এমন নেতা আছেন বলে ধারণা করা যেতে পারে। ভালো মানুষের
অসম্মান জাতি কখনই ভালো চোখে দেখে না। যাদের নির্দেশেই তা করা হোক, তারা শ্রদ্ধার পাত্র নন। গ্রেফতারের
পাশাপাশি ডিবি পুলিশ বিরোধীদলীয় নেত্রী ও মহাসচিবের কক্ষ তছনছ করেছে। ভেঙে ফেলা
হলো নেত্রীর বসার চেয়ার-টেবিল। এ তাণ্ডব কেন? ৭
মাস আগে পুলিশ বিএনপি কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার করেছিল।
মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারাও তখন রেহাই পাননি। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভেতরে
নারীকর্মীদের অসহায় অবস্থা সে দিন সবাই প্রত্যক্ষ করেছেন। গ্রেফতারের পর শতাধিক
নেতকর্মীকে মধ্যযুগীয় ক্রীতদাসের মতো গাড়িতে তোলা হয়েছিল। রিজভীর ক্ষেত্রেও এর
ব্যত্যয় ঘটেনি। গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশ কোনো দল বা গোষ্ঠীর নয়। তাদের আচার-আচরণ
সভ্য সমাজের উপযোগী হবেÑ এটাই ন্যায্য এবং
এমনটি সবাই প্রত্যাশা করেন। এর ব্যত্যয় পুলিশ বাহিনীকে সবার কাছে নিন্দিত করে
তুলবে।
আওয়ামী
লীগের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল অনেক। নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য জনগণকে
তারা আশান্বিতও করেছিল; কিন্তু দলটি জনগণের
প্রত্যাশা পূরণে অনেকাংশেই ব্যর্থ। ঘরে ঘরে চাকরি, স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্রাপ্তির প্রত্যাশা
পূরণ হয়নি। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ুদ্র বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্ত করা
হয়। জনগণের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, এ সরকার মুষ্ঠিমেয়
কিছু ব্যক্তির, সবার নয়। সরকার এ
কেলেঙ্কারির সাথে যুক্ত নয়, এমন বিশ্বাসযোগ্যতা
সৃষ্টি হয়নি। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনেকটাই বাস্তবায়ন না হওয়ায় পদ্মা সেতু, ডেসটিনি, হলমার্কের মতো বড় বড় দুর্নীতির সাথে সরকারের লোকজন জড়িত বলে
জনগণের বিশ্বাস। হেফাজতে ইসলামকে দমনে রক্তক্ষয়ী প্রক্রিয়া জনগণ মোটেও সমর্থন
করেনি। জনগণের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় বিরোধী দলের প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে।
শাসক দল নির্বাচনে জনসমর্থন না পাওয়ার আশঙ্কা করছে। এর জন্য তারা প্রতিহিংসাপরায়ণ
হয়ে ওঠে বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়ার ওপর।
নির্বাচনকে
সামনে রেখে সরকার বেশ কিছু পরিকল্পনা করে। তার একটি গলো, জামায়াতে ইসলামীকে
বিরোধীদলীয় জোট থেকে বিচ্ছিন্ন করা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নিমিত্তে গঠিত
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিজেদের বিতর্কিত করে ফেলে। ফলে জনগণের মধ্যে এই
ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, এসব রাজনৈতিক
উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। স্কাইপ সংলাপ এবং সুখরঞ্জন বালির ঘটনা জনমনে এই ধারণাকে আরো
শক্তিশালী করে। নিপীড়ন চালিয়েও জামায়াতকে দমন করতে ব্যর্থ হয়। তাদেরকে ১৮ দলীয় জোট
থেকে বিচ্ছিন্ন করতেও সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এই জন্য আক্রোশ গিয়ে পড়ে ১৮ দলীয় জোট
নেত্রীর ওপর।
বিএনপির
নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরপরই তারেক রহমান সক্রিয়ভাবে
রাজনীতিতে আসেন। তিনি বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নেন। শুরু হয়
তার নেতৃত্বে তৃণমূল পর্যায়ে দল গোছানোর কাজ। দেশের একটি শ্রেণী নিজেদের কায়েমী
স্বার্থ বিপর্যয়ের আশঙ্কায় তার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত। ১/১১-এর সময় তার ওপর
অমানবিক নির্যাতন এবং দীর্ঘ দিনেও তার বিরুদ্ধে প্রচারিত দুর্নীতিগুলো প্রমাণিত না
হওয়ায় নিজের ও দেশবাসীর কাছে তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল। সরকার বিএনপিকে
দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে দেখানোর প্রচেষ্টায় সফল হলে জনগণের কাছে থেকে দলটিকে
বিচ্ছিন্ন করা যেত; কিন্তু শহীদ
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিবার ও তার প্রতিষ্ঠিত দল যে দুর্নীতিগ্রস্ত নয়, সেটি বিরোধীদলীয় নেত্রী সফলতার সাথে প্রমাণ
করতে সক্ষম হয়েছে। সরকারের এই পরিকল্পনার ব্যর্থতার জন্যও বিএনপির প্রতি আওয়ামী
লীগ খড়গহস্ত।
শাহবাগে
সমাবেশ তরুণদের কর্মকাণ্ড ও কথাবার্তা ধর্মপ্রাণ মানুষদের বিুব্ধ করে তোলে।
ইসলামবিরোধী অপতৎপরতা বন্ধের জন্য আবির্ভূত হয় হেফাজতে ইসলাম। বিরোধীদলীয় নেত্রী
বেগম জিয়া যেহেতু হেফাজত কর্মীদের সহযোগিতা ও সমর্থন দেন, সেহেতু আওয়ামী লীগের আক্রোশ এসে পড়ে তার
ওপর।
সরকারের
প্রায় পাঁচ বছরের শাসনকালে আন্দোলন করার মতো অনেক বিষয় বিরোধী দলের হাতে এসেছিল।
তাতে দেশ অচল হতো অনেক আগেই। বিরোধী দল সরকারের পাতানো ফাঁদে পা দেয়নি। এতে তাদের
প্রতি জনসমর্থনও বৃদ্ধি পায়। এ কৃতিত্ব এককভাবে বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার।
সে জন্যও সরকার তথা আওয়ামী লীগ তার প্রতি রুষ্ট।
আওয়ামী
লীগের ইতিহাস দৃষ্টে বলা যায়, দলটির নীতিনির্ধারকরা
দু’টি নীতিতে বেশি বিশ্বাসী। ক.
মিথ্যা বা অর্ধসত্য তথ্যকে বড় করে প্রচার করে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ। খ. শক্তিমত্তা
প্রদর্শন করে প্রতিপক্ষের মতামতকে দমন। ওরিয়ানা ফালাচি তার ইন্টারভিউ উইথ হিস্ট্রি
গ্রন্থে লিখেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান জনসভায়
বলেছিলেন, করাচির রাস্তাঘাট সোনা দিয়ে
মোড়ানো। দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। জনগণ তা বিশ্বাস করেছিল।’ কিন্তু আওয়ামী লীগের এই পুরনো অস্ত্রটি আর
কাজ করছে বলে মনে হয় না। অকার্যকর হয়ে গেছে কথিত ‘সর্বদলীয় সরকারে’র
ফাঁদ। সে জন্যও তারা বিরোধীদলীয় নেত্রী ও তার দলের ওপর ুব্ধ।
বিরোধী
দলকে দমন করার জন্য সরকার বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম জিয়াকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেছে।
নিজ বাসভবনে অবরুদ্ধ রাখা তারই প্রতিফলন। তাকে গ্রেফতারের প্রতিক্রিয়া বুঝার জন্য
কৌশলে প্রচারণা চালিয়ে নেতাকর্মীদের মনোভাব বুঝার চেষ্টা করা হয়। এই প্রচারণা
বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের আরো ঐক্যবদ্ধ করেছে। আন্তর্জাতিক মহলও বিষয়টি ভালোভাবে
নেবে না বলে সরকারের কাছে প্রতীয়মান হয়। বিরোধীদলীয় নেত্রীকে গ্রেফতার করা হলে
দেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তা মোকাবেলা করার ক্ষমতাও সরকারের নেই। গণতন্ত্রের
অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিতে বিরোধী দলের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বিরোধী দলের
দায়িত্বশীলতা নির্ভর করে সরকারের দায়িত্বশীল আচরণের ওপর। সরকার বিরোধী দল ও মতকে
দমন করার জন্য রাজনীতির বাইরে যত অপকৌশল অবলম্বন করবে, বিরোধী দল ও মতের লোকজনও তত ভিন্ন পথের
সন্ধান করাই স্বাভাবিক।
বিরোধী
মতকে দমন করার জন্য পুলিশের গুলিবর্ষণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেকটাই নতুন।
ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া পুলিশের গুলিবর্ষণ এ সরকারের নতুন চমক। সমালোচিত
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দিন খান আলমগীর এর প্রবর্তক। বিএনপির মিছিলে
গুলিবর্ষণে সরকারের যুক্তি কী? বিএনপির নেতাকর্মীদের
দ্বারা পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে, এমন কোনো খবর তো
পত্রপত্রিকায় দেখা যায় না। কার নির্দেশে নিরীহ মিছিলকারীদের ওপর পুলিশ গুলি
চালাচ্ছে? স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
স্বরাষ্ট্রের দায়িত্বে। তিনি দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রধানমন্ত্রী। সবার জানমালের
নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তার পবিত্র দায়িত্ব। এর ব্যত্যয়ের দায় তিনি এড়াতে পারবেন না।
জনগণের
ধারণা, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার
পর বিপুল সংখ্যায় দলীয় কর্মীদের পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের দ্বারাই
বিরোধীদলীয় কার্যালয়ে হামলা, বিরোধী দল ও মত দমন
এবং আইন বিরোধী কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করা হচ্ছে। পুলিশ বাহিনী আমাদের গৌরব, জাতীয়সম্পদ। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে শান্তি
মিশনে তাদের ভূমিকা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। গৌরবময় এই বাহিনী কলঙ্কিত ও বিতর্কিত হোকÑ জাতি তা প্রত্যাশা করে না। মানুষ হত্যা ও
নির্যাতন করে নয়, পুলিশ বাহিনী কৌশল ও মেধা
দিয়ে অপরাধ দমন করবে এবং আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখবে, এটাই সবার কাম্য।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন