রবিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৩

জনমুখী হওয়াই দূরদর্শী রাজনীতি


বর্তমান সরকার বরাবর বলে আসছে, এরা জনগণের ভোটের অধিকারে বিশ্বাসী। তাই এ সরকার একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়। জনগণ যাকে ভোট দেবে তারাই সরকার গঠন করবে। কিন্তু এ সরকার নির্বাচন নিয়ে গোটা শাসনামলেই যেসব ছলচাতুরী চালিয়েছে, তাতে দেশের মানুষ সরকারের এ ধরনের বক্তব্যে আস্থা রাখতে পারছেন না। যদি সরকার জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিশ্বাসী হতো, তবে কখনোই বিরোধী দলকে চরম নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে অস্তিত্বহীন করার কথা ভাবতে পারত না। বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের ওপর বায়বীয় নানা মামলাদিয়ে জেলে পাঠিয়ে ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালাত না। নির্বাচনের মওসুমে প্রধান বিরোধী দলের নেতাদের সাজানো নানা অভিযোগ তুলে আটক করে একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার অপচেষ্টায় লিপ্ত হতো না। বিরোধী দলের রাজনৈতিক অফিসে তালা ঝুলিয়ে দিত না। প্রশাসনের সর্বত্র চরম দলীয়করণের পথ অবলম্বন করত না। সর্বোপরি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে পরাজয় নিশ্চিত ভেবে আদালতের দোহাই দিয়ে সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের বিধান বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে মরিয়া হয়ে উঠত না। সরকার যদি জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে আন্তরিক হতো, তবে জনগণের চাওয়া-পাওয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতো। দেশের ৭০-৯০ শতাংশ মানুষের প্রত্যাশার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিরোধিতা করত না। সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে নির্বাচনের যাবতীয় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ধ্বংস করে যেনতেন পর্যায়ে একটা নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার কোনো পরিকল্পনা মাথায় আসত না।
সরকার নির্বাচন নিয়ে নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয়ায় আজ নির্বাচন নিয়ে সারা দেশে এক অনিশ্চয়তা-অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে চরম রাজনৈতিক অচলাবস্থা। এই রাজনৈতিক সঙ্কটকালে দেশে প্রতিদিনই সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছেন। এদের কেউ মারা যাচ্ছেন রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে, কেউ মারা যাচ্ছেন মিছিল-সমাবেশে পুলিশের গুলিতে। বলা যায়, রাজনৈতিক উত্তাপ-সঙ্কটে সারা দেশ আজ পুড়ছে। কিন্তু সরকারের কোনো তোয়াক্কা নেই এ ব্যাপারে। সরকার মহাব্যস্ত একতরফা নির্বাচনে। সব মহলের মতামত উপেক্ষা করে সরকার যখন বিরোধী দলবিহীন একতরফা নির্বাচন প্রায় শেষপর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে, তখন সব দলের অংশগ্রহণে একটি অর্থপূর্ণ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে সরকারকে ফিরিয়ে আনার সর্বশেষ উদ্যোগ নিয়ে মাঠে নেমেছেন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত সংস্থাটির রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। তিনি চার দিনের সফরে এসে যখন সে চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশবাসী চেয়ে আছেন তার উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
তার এ উদ্যোগের ফলে শেষ পর্যন্ত যদি সব দলের অংশগ্রহণে দেশে একটি নির্বাচন হয়, তবে ভালো কথা। দেশের সাধারণ মানুষসহ দেশী-বিদেশী সব মহলের চাওয়া তাই। কিন্তু সব দল অংশ নিলেও নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কতটা নিশ্চিত করা যাবে, তা নিয়ে বড় মাপের সংশয় থেকেই যাবে। কারণ এরই মধ্যে তারানকোকেও প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, সংবিধানের বাইরে গিয়ে সরকার বিরোধী দলের সাথে কোনো সমঝোতা করবে না। অতএব বিরোধী দলকে নির্বাচনে এলেও দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে হবে। আর ব্যাপক দলীয়কৃত প্রশাসন ও বশংবদ নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে নির্বাচনী বিজয় নিশ্চিত করার একটা পথ থেকে যাবে সরকারের হাতেই।
শুধু দলীয়কৃত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বশংবদ নির্বাচন কমিশনই সরকারের হাতের নাগালে থাকবে না, থাকবে সরকারের নির্বাচনী ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী। সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ, সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় বিপুলসংখ্যক দলীয় লোকদের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দিয়েছে। বর্তমান সরকার এ পর্যন্ত এ ধরনের ১০ হাজার আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ইস্যু করেছে বলে জানা যায়। এসব আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের বেশির ভাগ পেয়েছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা। এখন বাংলাদেশে একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক লবিং ছাড়া কেউ আর আগ্নেয়াস্ত্রের কোনো লাইসেন্স পান না। গত ২২ অক্টোবর দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন এক রিপোর্টে জানিয়েছেÑ এর ফলে যাদের আগ্নেয়াস্ত্র দরকার, তারা এর লাইসেন্স পান না। এর বদলে লাইসেন্স ইস্যু হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপিদের প্রভাবে কর্তৃপক্ষ আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ইস্যু করে।
আরেকটি খবরে প্রকাশ, আজ অবাধে সীমান্ত জেলাগুলো দিয়ে আসছে বিপুল পিস্তল ও রিভলবার। পেশাজীবী অপরাধীরা সস্তায় চোরাচালানে আসা এসব আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি করছে। গত ২১ সেপ্টেম্বর ডেইলি সান এক খবরে জানিয়েছেÑ বর্তমান বছরের প্রথম ছয় মাসে ঢাকায় ৫৯টি বিদেশী পিস্তল ও ১৯টি রিভলবার উদ্ধার করেছে পুলিশ। রিপোর্ট মতে, ভারতের বিহার ও কলকাতায় তৈরী ুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র আসছে আমাদের দেশে চোরাচালানের মাধ্যমে।
পাটনা স্পেশাল টাস্কফোর্স ও নালন্দা পুলিশ গত সেপ্টেম্বর বিহারশরিফে একটি অবৈধ মিনি অস্ত্র কারখানার সন্ধান পায়। এবং এপ্রিলে ভারতীয় পুলিশ বিহারের নালন্দায় আরেকটি অবৈধ অস্ত্র কারখানার সন্ধান পায়। ধারণা করা হচ্ছে, এসব অবৈধ অস্ত্র কারখানা থেকে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র বাংলাদেশে এসেছে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এসব অবৈধ পিস্তল ও রিভলবার গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অনেকের আশঙ্কা, এসব অবৈধ অস্ত্র আগামী নির্বাচনে ব্যবহার হতে পারে। ফলে নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের তাগিদ এসেছে কোনো কোনো মহল থেকে।
প্রশাসনের দলীয়করণ দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে একটি বড় বাধা। সরকারবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে বিপুলসংখ্যক সরকারি কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রাখা দলীয়করণের আরেক অন্ধকার পর্ব। দলীয়করণের প্রভাব যাতে নির্বাচনের ওপর না পড়ে সে জন্য নির্বাচনের সময়ে দলীয় সরকারের অধীনে রেখে যাওয়া প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল আনা হয়। আগে এ কাজ করত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এখন এই দায়িত্ব এসে পড়েছে নির্বাচন কমিশনের ওপর। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে একদম নিষ্ক্রিয়। সম্ভবত বিভাগীয় কমিশনার পদে একটি মাত্র রদবদল এনে নির্বাচন কমিশন এ কাজ একদম বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করার জন্য এই দলীয়করণের বৃত্ত ভাঙা খুবই দরকার ছিল। পুলিশ প্রশাসনে যে উলঙ্গ দলীয়করণ চলেছে, তা বহুল আলোচিত এক ব্যাপার। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশন পুলিশ প্রশাসনে কোনো ধরনের রদবদলের কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায়নি। তা ছাড়া নির্বাচন কমিশন বলেছিল তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রতীক বরাদ্দের আগ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলকে কোনো ধরনের নির্বাচনী প্রচার করতে দেয়া হবে না। গত ২৯ নভেম্বরের আগে সব রাজনৈতিক দলের দলীয় প্রচারমূলক বিলবোর্ড সরিয়ে নেয়ার কথা বলা হয়। না নিলে কমিশন নিজ উদ্যোগে তা সরিয়ে নেবে বলে জানায়েছিলেন। কিন্তু এখনো নগরীতে সরকারি দলের অনেক বিলবোর্ড বহাল-তবিয়তেই টানানো রয়েছে। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন নিশ্চুপ। সে জন্যই প্রশ্ন উঠেছে, বর্তমান সরকারের বশংবদ এ নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের ধারণা, বর্তমান নির্বাচন কমিশন তাই করে, যা সরকার সিদ্ধান্ত দেয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার আগের দিন বললেন, রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য তফসিল ঘোষণায় একটু সময় নিচ্ছি। তিনি নিজেই বললেন, এ সময় নেয়া কি অন্যায়? আবার পরদিন তিনি তফসিল ঘোষণা করে দিলেন এবং বললেন, আমাদের হাতে আর একদম সময় নেই। আবার এ-ও বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতা হলে তফসিল পেছানোয় কোনো অসুবিধা নেই। এই হচ্ছে আমাদের নির্বাচন কমিশন। পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত, এ নির্বাচন কমিশন যদি তফসিল ঘোষণায় একটু ধৈর্য ধরত, তা হলে আজকের বিরোধী দল এ ধরনের অবরোধ কর্মসূচি নিয়ে এখনই মাঠে নামত না। এত লোকও এভাবে মারা যেতেন না। আসলে বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনও যেন মরিয়া বর্তমান সরকারকে আবারো ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার জন্য।
সরকার দাবি করছে, বিরোধী দল নির্বাচনে হেরে যাবে বলেই নির্বাচন বয়কট করে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করছে। এসব কথা বলা যায়, কিন্তু সাধারণ মানুষকে এ ধরনের অযৌক্তিক বক্তব্য বিশ্বাস করানো যায় না। বরং জনগণ বিশ্বাস করছে উল্টোটি। তাদের বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী তার দলের নিশ্চিত পরাজয় জেনেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে যেতে ভয় পাচ্ছেন। তাই এখন পাকাপোক্ত করতে চাইছেন বিরোধী দলবিহীন একতরফা নির্বাচন। এভাবে বর্তমান সরকার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে মরিয়া। নইলে যেখানে বিভিন্ন জরিপ বলছে, দেশের ৭০-৯০ শতাংশ মানুষ চান আগামী নির্বাচন হোক, দেশ-বিদেশে বিভিন্ন মহল, দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা চাইছে সব দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। সেখানে সরকার কেন যে সে পথে যেতে চাইছে না। সমালোচকেরা বলছেন, আসলে এ নির্বাচনের পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে দেশের বাইরে, ভারত থেকে। ভারত মনে করে আওয়ামী লীগ তাদের সর্বোত্তম বন্ধু। অতএব আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে যা কিছু দরকার করতে হবে। কারণ শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ভারত সরকারকে যা দিয়েছে, তা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে দিতে পারেনি।
সাধারণ মানুষের প্রশ্নÑ বর্তমান সরকারের বড় গলায় দাবি, এরা দেশে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে; যদি তা-ই হয়ে থাকে জনগণ অবশ্যই আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে। অতএব নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে সরকার কেন ভয় পায়? বলা হচ্ছে, নির্দলীয় সরকার ক্ষমতায় এসে ক্ষমতা দখল করে নেবে। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজেই তো বলেছেন, সংবিধান সংশোধন করে তিনি চিরদিনের জন্য অসংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় আসার পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। তা হলে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে তার ভয় থাকার তো কথা না।
আজ সমালোচনা আসছে সরকার একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে কার্যত একদলীয় বাকশালী শাসনেই ফিরে যেতে চায়। দমনপীড়নের মাধ্যমে বিরোধী দলগুলোকে অস্তিত্বহীন করতে চায়। সে লক্ষ্যেই সরকার এর যাবতীয় কৌশল অবলম্বন করে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন মহল হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছে, জনবিচ্ছিন্ন কোনো উদ্যোগ আয়োজনই চূড়ান্তপর্যায়ে বিজয়ী হয় না। জন-আকাক্সাই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়। তাই জন-আকাক্সার প্রতি সম্মান প্রদর্শনই প্রতিটি দূরদর্শী রাজনৈতিক দলের কাজ। ভিন্ন কিছু শুধু বিড়ম্বনা বাড়ায়। ভুললে চলবে না, জনমুখী হওয়াই দূরদর্শী রাজনীতি।


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads