সংবিধান মানে
শাসনতন্ত্র বা কনস্টিটিউশন। এই সংবিধান নিয়ে যারা নাড়াচাড়া করেন বা কথা বলেন, সম্ভবত এরাই সংবিধান সম্বন্ধে সংবিদিত নন।
সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্্েরর দর্শন। যেকোনো রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য
কিছু বিধিবিধান আবশ্যক। এ বিধিবিধানগুলোর সমন্বিত রূপই হলো সংবিধান। কিন্তু কোনো
সংবিধানই স্বয়ম্ভূ নয়, কোনো ধরনের তাৎক্ষণিক
উচ্ছ্বাস বা স্বতঃস্ফূর্ততার মাধ্যমেও এটা আপনাআপনি গড়ে ওঠে না। সংবিধান একটি
ঐতিহাসিক দলিল। এর মাধ্যমে সমকালীন অর্থনৈতিক, সামাজিক
ও রাজনৈতিক আশা-আকাক্সা মূর্ত হয়ে ওঠে। আবার মানুষের প্রয়োজনেই মানুষ সামাজিক
অবস্থানের বৈপরীত্যের ফলে উদ্ভূত ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার আলোড়নে সংবিধানের পরিবর্তন বা
অগ্রগতি ঘটান। পরিবর্তনটা দেশের স্বার্থে, জনগণের
স্বার্থে হতে হবে। সেটি ব্যক্তিস্বার্থের বা কোনো দলের স্বার্থের হলে চলবে না!
সাধারণ
অর্থে সংবিধান বলতে এমন কতগুলো লিখিত ও অলিখিত মৌলিক নিয়ামবলির সমষ্টিকে বুঝায়, যা ওই রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার
নীতিনির্ধারণ করে এবং শাসনব্যবস্থাকে পরিচালনার পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করে। লর্ড
ব্রাইসের মতে, ‘সংবিধান হলো সেসব আইন ও
প্রথার সমষ্টি, যেগুলো রাষ্ট্রের জীবনকে
নিয়ন্ত্রিত করে।’ অস্টিন-রেনীর মতানুসারে, ‘লিখিত বা অলিখিত, বিধিসম্মত বা বিধিবহির্ভূত সব মৌলিক
নিয়মকানুন, যা দেশের শাসনব্যবস্থার
ভিত্তি হিসেবে কাজ করেÑ তাই হলো সংবিধান।’
সংবিধানকে
অভিহিত করা হয়ে থাকে রাষ্ট্রের জীবনপদ্ধতি হিসেবে। এটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনও
বটে।
বাংলাদেশ
একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। এ দেশেরও একটি পবিত্র সংবিধান আছে। বাংলাদেশের
সংবিধান রচনা এ দেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বটে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২
সালের ১০ এপ্রিল ৪৩০ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদের অধিবেশন বসে। অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে
তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি খসড়া সংবিধান
প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সংবিধানের খসড়া তৈরি করে অক্টোবর মাসে তা গণপরিষদে
চূড়ান্তভাবে পেশ করে। ১৫ ডিসেম্বর সংবিধানের পাণ্ডুলিপিতে গণপরিষদের সদস্যদের
দস্তখত শেষ হয়। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের
একজন ছাত্র হিসেবে এতক্ষণ সংবিধান নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করলেও আদতে আমার বক্তব্য
দেশের বর্তমান মহাসঙ্কট উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া। মহাজোটের মহাসঙ্কট নিরসনে
মহাজোটের নেত্রীকেই এগিয়ে আসতে হবে। একগুঁয়েমি করলে সঙ্কট আরো ঘনীভূত হবে।
সংবিধানে তো কতবারই হাত দেয়া হয়েছে। না হয় আবারো হাত দিন। জনগণের সুখশান্তির কথা
বিবেচনা করে সংবিধান আবারো পরিবর্তন করা যায়। আপনারাই তো সংসদে সুপারহিট
সংখ্যাগরিষ্ঠ। কাজেই সত্যিকার অর্থে দেশের জনগণের শান্তি ও সুখ এবং উন্নতি চাইলে
আপনারা সময় থাকতে শুভবুদ্ধির পরিচয় দিন। এখনো সময় আছে, তবে সময় ও স্রোত কারো জন্যই অপেক্ষা করে
না। সময় গেলে সাধন হবে না রে মনা। ইতিহাস বড়ই বিচিত্র। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।
সংবিধানের সর্বশেষ পরিবর্তনের সুপ্রিম কোর্টের রায়েও কিন্তু আগামী দু’টি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
অধীনে করা যেতে পারে বলে উল্লেখ আছে। তত্ত্বাবধায়ক দিলেই যে, আরেকটি এক-এগারো আসবে, এমনতো নয়। এক-এগারো আসতে পারে যেকোনো সময়।
এক-এগারো তত্ত্বাবধায়ক প্রধান ফখরুদ্দীন আনেননি, এক-এগারো তো এনেছিলেন সেনাপ্রধান মইনউদ্দীন।
আপনারা
সবাই সব ব্যাপারেই সংবিধানের দোহাই দিচ্ছেন। সংবিধান? জনগণের কাছে ওটা কিছুই নয়। সংবিধান তো
জনগণের জন্য। জনগণের সুখই বড় সংবিধান। সংবিধানের দোহাই দিয়ে সেনাশাসন ঠেকানো যায়
না। দেশের ক্রান্তিকালে, দেশ রক্ষার্থে
সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসতেই পারে। তাদের সেই আসা কী সংশোধিত সংবিধান ঠেকাতে পারবে?
যুগে
যুগে আল্লাহর কিতাবও পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের সিচুয়েশন বুঝে। বিপথগামী মানুষকে পথে
আনতে আল্লাহ তায়ালা তার কিতাবেও পরিবর্তন, পরিবর্ধন
করেছেন। যখন যেভাবে প্রয়োজন, সেভাবেই করেছেন। যেমন তৌরাত, জবুর, ইঞ্জিল ও কুরআন। অতএব, আমাদের কাগুজে সংবিধান পরিবর্তন করা কী এমন
অসাধ্য ব্যাপার? আর যদি এখন পরিবর্তন করতে
অসুবিধা বা ঝামেলা মনে হয়, তাহলে সাবেক প্রধান
বিচারপতি খায়রুল হকের রায়েই থাকুন। আগামী দু’টি
না হোক অন্তত একটি নির্বাচন হোক তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায়। আমার মনে হয়, তবেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এই
দায়িত্ব আমরা প্রধানমন্ত্রীর ওপরই ছেড়ে দিলাম। তবে কাউকে যদি ক্ষমতার লোভে পেয়ে
বসে, কোনো কিছুতেই কিছু হয় না।
ক্ষমতার লোভ বড়ই অবুঝ। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা অনেকখানি স্পষ্ট হয়ে
যায়। যেমন সপ্তাশ্চর্য তাজমহলের
স্রষ্টা প্রেমিক সম্রাট শাহজাহানকেও ক্ষমতার লোভে তার অতি ধার্মিক ছেলে আরোঙ্গজেব
নজরবন্দী করে রেখেছিলেন এবং দুঃখে-ক্ষোভে ওই অবস্থাতেই তার মৃত্যু হয়। কাজেই
ক্ষমতার লোভ লাগামহীন। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। এটাও
ঠিক। নেলসন ম্যান্ডেলা হোন, গাদ্দাফি, মোবারক নয়।
আমরা
আশা করব, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
গণতন্ত্রের ভাষা বুঝবেন এবং তার ক্যাবিনেটও তা অনুসরণ করবে। কিন্তু বড়ই পরিতাপের
বিষয়, কেউ তা বুঝতে চান না। যেমন গত ৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
বড়লেখা উপজেলার এক সভায় বলেন, ‘বিএনপি গণতন্ত্রের
ভাষা বোঝে না। এরা শুধু হত্যা ও জনগণকে নির্যাতন করতে জানে।’ একটি ভারসাম্য শক্তিশালী বিরোধী দলকে, যারা আগেও দু-তিনবার ক্ষমতায় ছিল, তাদের এমনভাবে বলাটা কী গণতন্ত্রের ভাষা? আমরা আশা করব, প্রধানমন্ত্রীর শুভবুদ্ধির উদয় হবে। দেশের
বর্তমান সঙ্কট নিরসনে যথাযথ পদক্ষেপই নেবেন। আমরা আশাবাদী এই কারণে যেÑ ১. তিনি গত ২৮ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ
বাংলাদেশ মিশনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘দেশ ও জনগণের স্বার্থে আমি যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে
প্রস্তুত।’
২.
গত ১০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী
সম্মেলন কেন্দ্র) খতিব ও শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষিত ইমামদের এক জাতীয় সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়, শান্তি চাই। আমি জনগণের দুর্ভোগ সহ্য করতে
পারি না। আমি জনগণের শান্তি ও উন্নয়ন চাই, প্রধানমন্ত্রিত্ব
নয়।’
উপরোল্লিখিত দু’টি সুমহান বাণী থেকে আমরা ধরে নিতে পারি, তিনি দেশের উন্নতি ও শান্তি চান, সঙ্ঘাত নয়। তবে তিনি তার কিছু সাঙ্গোপাঙ্গের
কুমন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। তাই তাকেই বিবেক দিয়ে বুঝতে হবে এবং সঠিক
সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এর কোনোই বিকল্প নেই। তার চার পাশে যে সব
সাঙ্গোপাঙ্গ আছেন, তারা শুধুই নিজ স্বার্থ চান, তার ভবিষ্যৎ মঙ্গল চান না।
যেহেতু
শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব
চান না, জনগণের শান্তি ও উন্নয়ন চান।
তাহলে তাকে বর্তমান অবৈধ সরকারের (অন্যদের ভাষায়) প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে নির্দলীয়
কাউকে (গ্রহণযোগ্য) দায়িত্ব দিয়ে সরে পড়াই সঙ্কট নিরসনের একমাত্র পথ। স্বেচ্ছায়
ছেড়ে যাওয়াটা তো মহানুভবতার পরিচয়। মহানুভবতার পরিচয় দিলে জনগণই তাকে আবার ফিরিয়ে
আনতে পারেন। তাতে কারো আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। দেশ ও জনগণের প্রতি সদয় হোন।
আল্লাহ আপনাকে সুমতি দিন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন