কৃষ্ণসুন্দর
ম্যান্ডেলার জন্য শোককাতর হওয়ার সুযোগ আছে; কিন্তু
সময়জ্ঞান আমাদের তার শিক্ষাগুলো সামনে রেখে জাতির দিকে তাকাতে বলে। যে মানুষটি
সাদা-কালোর তফাত দূর করে প্রতিহিংসার ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্য গড়লেন, সেই মহান ব্যক্তিত্বের আত্মা শান্তি পেত, যদি প্রেসিডেন্ট বিভক্ত ও সঙ্কটে ক্ষত-বিক্ষত
জাতিকে এক করার উদ্যোগ নিতেন। তা হলে জাতিসঙ্ঘ দূত আসতে হতো না। সেটা হতো
মর্যাদার। আমরা ওম শান্তি বলতে দক্ষিণ আফ্রিকা যাবো, আর জাতিসঙ্ঘ দূত থাকবেন ঢাকায়।
জাতিসঙ্ঘ
মহাসচিবের বিশেষ দূত এখন ঢাকায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তিনি জাতিসঙ্ঘের
রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিবও। অন্যরা যা পারেননি কিংবা পারবেন না, তা তারানকোকে পারতেই হবে। অন্যরা পারেননি
কেন সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। ভারতের সুজাতা সিং সমঝোতা করতে আসেননি। তিনি ঢাকা
মিশনে এসেছিলেন শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে বল-ভরসা জোগাতে। সঙ্কটের আগুনে হাওয়া
দিতে। অনেকটা দিদিগিরি ফলাতে। স্বাভাবিকভাবেই তার দূতিয়ালি গ্রহণযোগ্য হওয়ার
প্রশ্নই ওঠে না। ড্যান মজিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। বাংলাদেশের মানুষ
বড় রাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে সমীহ করা পর্যন্ত থাকতে চায়Ñ তাদের মধ্যস্থতায় রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান
হয়ে যাবে তা মনে করে না। এর আগে নিশা দেশাইয়ের সফরও এ দেশের মানুষকে শতভাগ আশাবাদী
করেনি। চীনের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যকে জনগণ তাৎপর্যপূর্ণ ভেবেছে। তাদের পক্ষ থেকে
দেয়া পরামর্শগুলো প্রেসক্রিপশন ছিল না, তাই
কেউ অস্বস্তিবোধ করেনি। যুক্তরাজ্যের এখনকার দূত এখনো মূল্যায়িত নন, তিনি একসময়ের দাপুটে দূত আনোয়ার চৌধুরীর
মতোও নন। আনোয়ার চৌধুরী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত হওয়ায় বাড়তি সেনসেশন তৈরি করে এক-এগারোর
প্রেক্ষাপটে আলোচিত হয়ে উঠেছিলেন। কানাডিয়ান দূতের ক্ষীণকণ্ঠ শূন্যে মিলিয়ে যায়।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিনিধির অবস্থান ভালো; কিন্তু
তৎপরতা আলোচিত নয়। এর বাইরের দেশগুলো প্রত্যাশার জায়গায় অবস্থান নেয়নি। মুসলিম
রাষ্ট্রগুলো ও এর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ভালো
পর্যবেক্ষক; কিন্তু কোনো ব্যাপারেই
উদ্যোগী নয়।
এই
বাস্তবতার কারণেই জাতিসঙ্ঘ প্রতিনিধির অবস্থান দৃঢ় এবং প্রত্যাশিত। তাছাড়া
জাতিসঙ্ঘ কোনো দেশ নয়, রাষ্ট্রগুলোর সঙ্ঘ।
রাষ্ট্রগুলোর সমস্যা সঙ্কট দেখভাল করার একটা নৈতিক দায় সবার কাছে স্বীকৃত। যেকোনো
শক্তিমান দেশের রাষ্ট্রদূতদের ভূমিকা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের
স্পর্শকাতরতা সৃষ্টি করে, সাধারণ নাগরিকদের মনেও
সন্দেহ জাগায়। তা ছাড়া সব রাষ্ট্রের কূটনীতিক ও কূটনীতির নিজস্ব এজেন্ডা থাকা
সম্ভব। আছেও। বিশেষত ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতিসহ অনেক
ব্যাপারেই সম্পৃক্ত। জাতিসঙ্ঘ যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভাববলয়াধীন একটি ফোরাম তা
লুকোবার কোনো বিষয় নয়। মৌলিক কাজে জাতিসঙ্ঘ সফল কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম নয়Ñ তার পরও জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতা গ্রহণযোগ্য।
নির্দোষও বটে। বাংলাদেশের সৃষ্ট চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদেরই
সৃষ্টি করা। এর সাথে ভারতীয় কূটনীতির কূটচাল ও চাণক্যনীতির সংযোগ সরাসরি। ভারত যদি
প্রকাশ্যে ও নেপথ্যে ছড়ি না ঘুরাত তাহলে সঙ্কট সৃষ্টিই হতো না। ভারতের নিজস্ব
এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য প্রতিবেশী দেশটির সরকার তাদের জনমত উপেক্ষা করে মহাজোট
সরকারের কাঁধে ভর করেছে। মহাজোট সরকার সিন্দবাদের দৈত্য কাঁধে নেয়ার মতো ভারতকে
কাঁধে নিয়ে মহাবিপাকে পড়েছে। এক দিকে দালালির অভিযোগ, অন্য দিকে ভারতীয় আধিপত্যবাদী নীতির
নিন্দাবাদ, দুটোই এখন মহাজোট সরকারের
ললাটের লিখন। কোনো প্রকার রাখঢাক না করেই ভারত আমাদের দূষণযুক্ত গণতন্ত্র ও নষ্ট
রাজনীতির মুখ্য ফেরিওয়ালা। এটা এখন এ দেশের সব মানুষ বিশ্বাস করে এবং জানে। এ
কারণেই জাতিসঙ্ঘ প্রতিনিধিকে মানুষ কার্যকর সমঝোতার নামে দূতিয়ালি করার জন্য যথাযথ
মনে করে। প্রত্যাশার সূচকও অনেক ঊর্ধ্বে।
রাজনৈতিক
ইগো কিংবা জেদ সেইসাথে ক্ষমতা হারাবার ভীতি সরকারকে যৌক্তিক হলেও ন্যায়সঙ্গত ছাড়
দিতে দিচ্ছে না। নিজেদের মর্জিমতো সাজানো সংবিধানের দোহাই যে অর্থহীন তা খোদ
প্রধানমন্ত্রীও জানেন। প্রধানমন্ত্রী সরে না দাঁড়ালে কিংবা তার সব নির্বাহী ক্ষমতা
কেড়ে নেয়ার মতো একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে বিরোধী জোট মাঠ ছেড়ে ঘরে যাবে কেন! তাদের
একমাত্র দাবি তত্ত্বাবধায়ক বা দলনিরপেক্ষ সরকার গণছোঁয়া-বিধৌত বাংলাদেশের আজকের
প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত যৌক্তিক দাবি। তারা জানে এ দাবি ছেড়ে সরে দাঁড়ালে তাদের
রাজনৈতিক আত্মহত্যা অনিবার্য। অপর দিকে সমঝোতা কিংবা কোনো প্রকার রাজনৈতিক চুক্তি
ছাড়া শেখ হাসিনার ক্ষমতা ত্যাগ তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে মহাবিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে।
এমন একটা প্রেক্ষাপটে উভয়পক্ষের জন্য কিছু স্বস্তিদায়ক জায়গা বা স্পেস খুঁজে পাওয়া
জরুরি। এ ধরনের একটা জায়গা করে দেয়া সহজ নয়, কিন্তু
সম্ভব। এই সহজ নয়, কিন্তু সম্ভব কাজটি করতে হবে
জাতিসঙ্ঘ প্রতিনিধিকেই। জাতিসঙ্ঘ প্রতিনিধির ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে এ দায় পূরণের
আর কোনো ভরসাকেন্দ্র আপাতত নেই। আমাদের সেনাবাহিনীকে নিয়ে যারা বিভিন্ন ভাবনায়
আছেনÑ তাদের জানা উচিত দেশের আশা ও
ভরসার এই জায়গা রাজনৈতিক আম্পায়ারিং করার জন্য নয়। তারা সঙ্কটকে আপাতত মোকাবেলা
করে স্থিতির দিকে নিয়ে যেতে পারেন। রাজনৈতিক সঙ্কট রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করতে
হবে। রাজনৈতিক শূন্যতা রাজনীতিবিদ ছাড়া অন্যরা পূরণ করতে পারেন না।
নিষ্ঠুর
সত্য হচ্ছে, আমাদের ব্যবসায়ীসমাজ সামাজিক
শক্তি নয়। তারা সেই জায়গায় নেই। তাদের প্রেসার গ্রুপ থাকার এখতিয়ারও সীমিত করে
নিয়েছেন তারাই। ব্যতিক্রম, জাত এবং বনেদি
ব্যবসায়ী ছাড়া রাজনীতির বেশির ভাগ ক্রিম তারা খান। তারা রাজনীতিবিদদের চেয়ে বেশি
রাজনীতি করেন। গাছেরটাও খান তলারটাও কুড়ান। তারা এমপি হন, মন্ত্রী হন, মিডিয়ার মালিক সাজেন, আবার
দেশের তাবৎ ব্যবসায়-বাণিজ্যের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রাখতে রাজনীতিকেই ব্যবহার
করেন। আগেই বলেছি, এর ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।
তারা অবশ্যই বলবেনÑ ব্যবসায়ীর ঊর্ধ্বে
তারা দেশের নাগরিক, রাজনীতি তাদেরও
এখতিয়ার। এটা অস্বীকার করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে তাদের শ্রেণীচরিত্র তারা ভুলে
থাকলেও মানুষ ভোলে না। ব্যবসায়ীরা আজকের এই স্তরে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছেন
দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন, ব্যাংকব্যবস্থার
ত্রুটি, নষ্ট রাজনীতি ও দূষণকবলিত
গণতন্ত্রের জন্যই। রাজনৈতিক খবিসদের কারণেই তারা দোষের ঊর্ধ্বে নন। তাই রাজনীতির
সততা-নিষ্ঠা-দেশপ্রেম বণিকের পণ্যের মতোই টাকায় বিকানো যায়।
রাজনীতিবিদেরা
জাতিসঙ্ঘকে মধ্যস্থতার জায়গায় না রাখলে ঠকবেন। রাজনীতি তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে।
জাতিসঙ্ঘ মিশন ব্যর্থ হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে শান্তিমিশনের ক্ষেত্রেও। অতএব
সাবধান! সংবিধানের দোহাই, তফসিল পুনর্বিন্যাসে
আইনি ফেরকা দেখানো জনগণকে অবুঝ ভেবে বালকের হাতে ললিপপ তুলে দেয়ার মতো বিষয়।
মাগুরা ও ঢাকা-১০ আসন যেমন বিএনপির কলঙ্ক, তেমনি
ভোলা, কিশোরগঞ্জ ও বঙ্গবীরের আসন
আওয়ামী লীগের কলঙ্ক। এখন কলঙ্কের দাগ মহাজোটের সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সারা গায়ের
এত দাগ চিকিৎসায় যাবে না। চামড়া পাল্টে ফেলা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ জন্যই বলছি
জাতিসঙ্ঘ দূতকে আমলে নিন, মধ্যস্থতা মেনে নিজেরা
গা বাঁচান, জাতিকে বাঁচতে দিন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন