এম আ ব দু ল্লা হ
১৭৯৩ সালে কর্নওয়ালিস প্রশাসন কর্তৃক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার ও বাংলার জমিদার এবং স্বতন্ত্র তালুকদারদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিটি ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চুক্তি’ হিসেবে পরিচিত। এই চুক্তির আওতায় জমিদার ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভূ-সম্পত্তির নিরঙ্কুশ স্বত্বাধিকারী হন। জমির স্বত্বাধিকারী হওয়া ছাড়াও জমিদারগণ স্বত্বাধিকারের সুবিধার সঙ্গে চিরস্থায়ীভাবে অপরিবর্তনীয় জমিদারিত্ব লাভ করেন।
২২০ বছর আগের সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনটি এখন সংশোধন করার গুরুত্ব দেখা দিয়েছে। হালের বাংলাদেশে যে সংঘাত সহিংসতা রক্তপাত চলছে তার চিরস্থায়ী অবসানের জন্য ওই আইনটির একটি সংশোধনী বর্তমান সরকার জরুরি ভিত্তিতে পাস করে নিলেই আমার ধারণা ল্যাটা চুকে যাবে। আমার প্রস্তাবিত সংশোধনীতে স্থান পাবে বর্তমান ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশটি আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক দলটির কাছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দেয়া। আইনে এই বাংলাদেশকে প্রতিবেশী কারও কাছে লিজ, বন্ধক রেখে বার্ষিক নির্ধারিত খাজনা বা ফি আদায়ের সুযোগ অবশ্যই থাকতে হবে। আবার এ ক্ষমতাও দিতে হবে যে প্রয়োজনে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত গ্রহীতা আওয়ামী লীগ চাইলে প্রতিবেশীর কাছে দেয়া লিজের ফি বা টোলও মওকুফ করতে পারবেন।
আমার প্রস্তাবটিকে কেউ যদি গুরুত্বহীনভাবে দেখেন বা ঠাট্টা-তামাশা হিসেবে জ্ঞান করেন তাতেও আমার কিছু যায় আসে না। কারণ ঠাট্টা, তামাশা, প্রহসন, মশকরা, হাস্যকর—এ জাতীয় শব্দগুলো এখন আর যুত্সই নয়। বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বাংলা অভিধানের এসব শব্দ ইতিমধ্যেই সম্ভ্রম হারিয়েছে। এরই মধ্যে দুই কান কাটা যাওয়া ‘রকীব কমিশন’ উল্লেখিত বিশেষণগুলোকে তাদের জন্য ভূষণ হিসেবেই গ্রহণ করেছে। জানিয়ে দিয়েছে—জাতির উদ্দেশ্যে এক মহান ভাষণে নির্বাচনের তফসিল দেয়ার পর টানা সহিংসতায় এ যাবত যে শ’দেড়েক মানুষের প্রাণ গেছে, প্রাথমিক হিসেবে যে ৭০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ, অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, তার সঙ্গে নির্বাচনের কোনোই সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক থাকবেই বা কীভাবে? প্রাণ গেছে মানুষের, ক্ষতি হয়েছে জনসম্পদের। রকীব কমিশন দশম জাতীয় সংসদের নামে যে নির্বাচনী হাইড্রামা মঞ্চস্থ করছে তার সঙ্গে তা ওই মানুষ ও জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই।
শুধু শুধু কিছু নির্বোধ (!) রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নির্বাচনের সমালোচনা করে বলছেন যে, ‘এ নির্বাচনে একজন মানুষও ভোট দেয়নি। নির্বাচনের দিন পর্যন্ত আসেনি। তবু আওয়ামী লীগ ও তার মহাজোটের মিত্ররা আগামী পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে গেছে’! মিছেমিছি কটাক্ষ করে বলছে—‘ভোটহীন, প্রার্থীহীন ও নির্বাচনহীন নির্বাচনে জেতার এই অনন্য রেকর্ড এই ভূবিশ্বে একটি দলই করতে পেরেছে। সেটি আমাদের প্রিয় আওয়ামী লীগ’।
১৫৪টি আসনের প্রার্থীরা এরই মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যে ভুবন ধস বিজয় লাভ করেছে তা নিয়ে দুর্মুখরা বলছেন—‘প্রার্থী সঙ্কটে জিতে যাওয়া আসনের ভোটারদের সংখ্যা এবং মোট ভোটারের শতাংশের হিসাবের দিকে তাকালে যে চিত্রটি উঠে আসে, তা এই নির্বাচনকে এর মধ্যেই বৈধতার সংকটে ফেলে দিয়েছে। ২০০৮ সালের ভোটার সংখ্যাকে ভিত্তি ধরলে চটজলদি হিসাবে দেখা যায় যে সারা দেশের প্রায় ৫২ শতাংশ ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে যেতে হবে না। বাকী ৪৮ শতাংশ ভোটারের ভোট দেয়ার প্রয়োজন এখনো রয়েছে। কোনো কোনো বিভাগে এই হার এতটাই বেশি যে, সেটা যে কোনো বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য। অবশ্য এরই মধ্যে আভাস মিলছে জুয়েল আইচ মার্কা ম্যাজিকে আরও জনা তিরিশেক প্রার্থীকে জিতিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া চলমান। কারণ ওইসব এলাকায় ভোট গ্রহণ তো দূরের কথা ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপারসহ নির্বাচনী সামগ্রী নেয়াই ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ’।
অংক কষে উদাহরণ টানা হচ্ছে যে, ‘রাজশাহী বিভাগে ৭০ শতাংশ ভোটারের ভোট দেয়ার প্রয়োজন হবে না; ঢাকা বিভাগের ক্ষেত্রে তা ৫৯ শতাংশের বেশি। চট্টগ্রাম বিভাগের ৫৫ শতাংশ ভোটারের পছন্দের বিষয়টি এখন ধর্তব্যের বিষয় নয়। তবে যাদের ভোটের এখনো প্রয়োজন আছে, তাও সীমিত। কেননা, তারা সরকার গঠনের ক্ষেত্রে কোনো রকম বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারবেন না’। এসব অপ্রিয় হিসাব-নিকাশ যারা করছেন তারা আস্ত বেকুব। এ হিসাবের ধার ধারার সময় কোথায় মহাপ্রতাপশালী বাঙালি কওমের অহঙ্কার জগাখিচুড়ি সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার? ধরাটা যার কাছে সরা তার বোধ-বুদ্ধি অতটা অংক আর পরিসংখ্যাননির্ভর নয়।
বোকামির জন্য হয়তো সারাজীবন পস্তাতে হবে বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে। আজব কিছিমের যে নির্বাচনকালীন সরকার এখন ছড়ি ঘুরাচ্ছে তাতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর প্রস্তাব মতো মন্ত্রিত্ব নিলে টেন্ডার ভাগাভাগির মতো ৩০০ আসনের একটি ভাগ তিনিও পেয়ে যেতেন। গত সংসদের ৩২ আসন থেকে আরও ১০-২০টি বাড়িয়ে গোটা পঞ্চাশেক আসন দেয়ার মতো উদার মন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর যে আছে তা কে না জানে। পার্সেন্টেজ হিসাব করে বুঝিয়ে দিতেন ৩২ থেকে বাড়িয়ে ৫০ আসন দিলে কত পার্সেন্ট বেশি দেয়া হলো। আর নির্বাচনী সরকারে যোগ দিয়ে পরে তেড়িবেড়ি করলে বেগম খালেদা জিয়াকে প্রয়োজনীয় চিকিত্সা সেবা দেয়ার জন্য তো তারই প্রতিষ্ঠিত র্যাব বাহিনী একপায়ে খাড়া ছিল। খালেদা জিয়া অসুস্থতাজনিত কারণে মনোনয়নপত্র দাখিলের কাজটি করতে না পারলে তাও সরকারের খাস কামলা রিটার্নিং কর্মকর্তারা অত্যন্ত যত্নসহকারে সম্পন্ন করে দিতে পারতেন। আসন নিয়ে গোস্সা করে শপথ নিতে না চাইলে প্রয়োজনে হাসপাতালে স্পিকারকে পাঠিয়ে শপথের ব্যবস্থাও করে দিতেন। আর আগামী সরকারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়তো দেয়া হতোই। এর মধ্যে মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়টি বেগম খালেদা জিয়ার জন্য বরাদ্দ করার মতো বড় মনও গণতন্ত্রের মানসকন্যার আছে। নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিরোধী দলীয় নেত্রীর পদ হারিয়ে বেগম খালেদা জিয়া যে ভুল করলেন তার জন্য অচিরেই হয়তো সহানুভূতি সভা ডাকবেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
যারা জননেত্রীর কথাবার্তা শুনে তাকে রোমান সম্রাটদের মতো সর্বশক্তিমান এবং চেঙ্গিস খান মতো বেপরোয়া অভিহিত করে ইয়ার্কি মারেন, তাদের প্রতি করুণার দৃষ্টিপাত করতে পারেন তিনি। এসব মূল্যায়নে যে তিনি আরও উজ্জীবিত হচ্ছেন তা বোঝার মতো বুদ্ধিও কলামিস্ট, টিভি ভাষ্যকার ও বুদ্ধিজীবীদের নেই বলে মনে করেন তিনি। এমন ক্ষমতাবান হওয়ার স্বীকৃতি ক’জনার ভাগ্যে জোটে! হিটলার, চেঙ্গিস খান, হালাকু খানদের আর কতকাল বিশ্ববাসী উদাহরণ হিসেবে টানবে। তাদের স্থান দখল করতে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর যোগ্যতার ঘাটতি কোথায়? সমালোচকরা কে কী বলল, তা থোড়াই কেয়ার করেন মহাশক্তিধর আমাদের এই নেত্রী। বিশ্ব সংস্থাকে যিনি ধমক মারেন, তার কাছে এসব কটাক্ষ-ইয়ার্কি নস্যি।
অহেতুক আহাজারি করা হচ্ছে যে, ‘দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। ধ্বংসের মুখে মানুষের জীবিকা। অচল হয়ে পড়েছে অর্থনীতি। গত দুই দশকের অর্থনীতির অর্জনগুলো ভেস্তে যেতে বসেছে। সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কমে গেছে উত্পাদন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে। জীবন হাতে নিয়ে প্রতিদিন কাজে নামছেন স্বল্প আয়ের অসংখ্য মানুষ’।
সব কুচ ঠিক হ্যায়। গণমাধ্যম খামাখা প্রতিবেদন ছাপছে যে, ‘স্বাধীনতার পর দেশে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলন হলেও এখনকার মতো অচলাবস্থা আর কখনো দেখা যায়নি। অর্থনীতির প্রতিটি খাতই বিপদে আছে। রফতানি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে, কমছে আমদানি, বিনিয়োগ নেই, ব্যাংক অলস অর্থের পাহাড় নিয়ে বসে আছে, প্রবাসী-আয়ে কমছে, বাড়ছে খেলাপি ঋণ। বড় ধরনের সংকটে পড়েছে পর্যটনশিল্প। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব প্রথমবারের মতো শীতকালীন মেলা স্থগিত করে দিয়েছে’।
অর্থনীতি গোল্লায় যাক। লাশের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হোক। তাতে কী? দিল্লিপতির শুভাশিষে গদি যতদিন টেকে, তাতেই লাভ, তাতেই সুখ। এদেশের জনগণের প্রতি যে কোনো দায়বদ্ধতা বা দরদ নেই তাতো অনেক আগেই লন্ডন সাক্ষাত্কারে পরিষ্কার করেছেন তিনি। তার রাজনীতি যে কেবলই পিতৃহত্যার প্রতিশোধের জন্য তা খোলাসা করতে তো তিনি কখনো দ্বিধা করেননি। মসনদ ছেড়ে শাপলা কিলিং, বিডিআর কিলিং, পদ্মা সেতু দুর্নীতি, হলমার্ক লুট, কুইক রেন্টাল হরিলুট, শেয়ারবাজার লোপাটসহ নানাবিধ মহান (!) কর্মের দায়ে কাঠগড়ায় দাড়ানোর ঝুঁকি নেয়ার মতো আহাম্মক নন তিনি। ডু অর ডাই। তার আর ‘চাওয়া পাওয়ার কিছুই নাই’। অতএব ধর, মার, জেলে ভর, গুম কর, ঘরে-বাইরে গুলি করে খুন কর, যথেচ্ছভাবে শাসন কর, গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধর, সংবিধান ছুড়ে ফেলে নিজের স্বেচ্ছাচারী বিধান কায়েম কর—এই নীতিতেই চলবে। জয় হোক এই নীতির। আর এ জয়টা সুনিশ্চিত করতেই অবিলম্বে নবম সংসদের অধিবেশন ডেকে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ আইন সংশোধন করার জন্য আবারও জোর প্রস্তাব করছি। আসুন আমরা ২২০ বছর আগের ঐতিহ্যে ফিরে যাই। অবশ্য আইন পাস করার কথাটা একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেল। দরকার কী? তিনি যা বলেন, যা করেন সেটাইতো আইন।
২২০ বছর আগের সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনটি এখন সংশোধন করার গুরুত্ব দেখা দিয়েছে। হালের বাংলাদেশে যে সংঘাত সহিংসতা রক্তপাত চলছে তার চিরস্থায়ী অবসানের জন্য ওই আইনটির একটি সংশোধনী বর্তমান সরকার জরুরি ভিত্তিতে পাস করে নিলেই আমার ধারণা ল্যাটা চুকে যাবে। আমার প্রস্তাবিত সংশোধনীতে স্থান পাবে বর্তমান ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশটি আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক দলটির কাছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দেয়া। আইনে এই বাংলাদেশকে প্রতিবেশী কারও কাছে লিজ, বন্ধক রেখে বার্ষিক নির্ধারিত খাজনা বা ফি আদায়ের সুযোগ অবশ্যই থাকতে হবে। আবার এ ক্ষমতাও দিতে হবে যে প্রয়োজনে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত গ্রহীতা আওয়ামী লীগ চাইলে প্রতিবেশীর কাছে দেয়া লিজের ফি বা টোলও মওকুফ করতে পারবেন।
আমার প্রস্তাবটিকে কেউ যদি গুরুত্বহীনভাবে দেখেন বা ঠাট্টা-তামাশা হিসেবে জ্ঞান করেন তাতেও আমার কিছু যায় আসে না। কারণ ঠাট্টা, তামাশা, প্রহসন, মশকরা, হাস্যকর—এ জাতীয় শব্দগুলো এখন আর যুত্সই নয়। বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বাংলা অভিধানের এসব শব্দ ইতিমধ্যেই সম্ভ্রম হারিয়েছে। এরই মধ্যে দুই কান কাটা যাওয়া ‘রকীব কমিশন’ উল্লেখিত বিশেষণগুলোকে তাদের জন্য ভূষণ হিসেবেই গ্রহণ করেছে। জানিয়ে দিয়েছে—জাতির উদ্দেশ্যে এক মহান ভাষণে নির্বাচনের তফসিল দেয়ার পর টানা সহিংসতায় এ যাবত যে শ’দেড়েক মানুষের প্রাণ গেছে, প্রাথমিক হিসেবে যে ৭০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ, অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, তার সঙ্গে নির্বাচনের কোনোই সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক থাকবেই বা কীভাবে? প্রাণ গেছে মানুষের, ক্ষতি হয়েছে জনসম্পদের। রকীব কমিশন দশম জাতীয় সংসদের নামে যে নির্বাচনী হাইড্রামা মঞ্চস্থ করছে তার সঙ্গে তা ওই মানুষ ও জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই।
শুধু শুধু কিছু নির্বোধ (!) রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নির্বাচনের সমালোচনা করে বলছেন যে, ‘এ নির্বাচনে একজন মানুষও ভোট দেয়নি। নির্বাচনের দিন পর্যন্ত আসেনি। তবু আওয়ামী লীগ ও তার মহাজোটের মিত্ররা আগামী পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে গেছে’! মিছেমিছি কটাক্ষ করে বলছে—‘ভোটহীন, প্রার্থীহীন ও নির্বাচনহীন নির্বাচনে জেতার এই অনন্য রেকর্ড এই ভূবিশ্বে একটি দলই করতে পেরেছে। সেটি আমাদের প্রিয় আওয়ামী লীগ’।
১৫৪টি আসনের প্রার্থীরা এরই মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যে ভুবন ধস বিজয় লাভ করেছে তা নিয়ে দুর্মুখরা বলছেন—‘প্রার্থী সঙ্কটে জিতে যাওয়া আসনের ভোটারদের সংখ্যা এবং মোট ভোটারের শতাংশের হিসাবের দিকে তাকালে যে চিত্রটি উঠে আসে, তা এই নির্বাচনকে এর মধ্যেই বৈধতার সংকটে ফেলে দিয়েছে। ২০০৮ সালের ভোটার সংখ্যাকে ভিত্তি ধরলে চটজলদি হিসাবে দেখা যায় যে সারা দেশের প্রায় ৫২ শতাংশ ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে যেতে হবে না। বাকী ৪৮ শতাংশ ভোটারের ভোট দেয়ার প্রয়োজন এখনো রয়েছে। কোনো কোনো বিভাগে এই হার এতটাই বেশি যে, সেটা যে কোনো বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য। অবশ্য এরই মধ্যে আভাস মিলছে জুয়েল আইচ মার্কা ম্যাজিকে আরও জনা তিরিশেক প্রার্থীকে জিতিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া চলমান। কারণ ওইসব এলাকায় ভোট গ্রহণ তো দূরের কথা ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপারসহ নির্বাচনী সামগ্রী নেয়াই ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ’।
অংক কষে উদাহরণ টানা হচ্ছে যে, ‘রাজশাহী বিভাগে ৭০ শতাংশ ভোটারের ভোট দেয়ার প্রয়োজন হবে না; ঢাকা বিভাগের ক্ষেত্রে তা ৫৯ শতাংশের বেশি। চট্টগ্রাম বিভাগের ৫৫ শতাংশ ভোটারের পছন্দের বিষয়টি এখন ধর্তব্যের বিষয় নয়। তবে যাদের ভোটের এখনো প্রয়োজন আছে, তাও সীমিত। কেননা, তারা সরকার গঠনের ক্ষেত্রে কোনো রকম বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারবেন না’। এসব অপ্রিয় হিসাব-নিকাশ যারা করছেন তারা আস্ত বেকুব। এ হিসাবের ধার ধারার সময় কোথায় মহাপ্রতাপশালী বাঙালি কওমের অহঙ্কার জগাখিচুড়ি সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার? ধরাটা যার কাছে সরা তার বোধ-বুদ্ধি অতটা অংক আর পরিসংখ্যাননির্ভর নয়।
বোকামির জন্য হয়তো সারাজীবন পস্তাতে হবে বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে। আজব কিছিমের যে নির্বাচনকালীন সরকার এখন ছড়ি ঘুরাচ্ছে তাতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর প্রস্তাব মতো মন্ত্রিত্ব নিলে টেন্ডার ভাগাভাগির মতো ৩০০ আসনের একটি ভাগ তিনিও পেয়ে যেতেন। গত সংসদের ৩২ আসন থেকে আরও ১০-২০টি বাড়িয়ে গোটা পঞ্চাশেক আসন দেয়ার মতো উদার মন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর যে আছে তা কে না জানে। পার্সেন্টেজ হিসাব করে বুঝিয়ে দিতেন ৩২ থেকে বাড়িয়ে ৫০ আসন দিলে কত পার্সেন্ট বেশি দেয়া হলো। আর নির্বাচনী সরকারে যোগ দিয়ে পরে তেড়িবেড়ি করলে বেগম খালেদা জিয়াকে প্রয়োজনীয় চিকিত্সা সেবা দেয়ার জন্য তো তারই প্রতিষ্ঠিত র্যাব বাহিনী একপায়ে খাড়া ছিল। খালেদা জিয়া অসুস্থতাজনিত কারণে মনোনয়নপত্র দাখিলের কাজটি করতে না পারলে তাও সরকারের খাস কামলা রিটার্নিং কর্মকর্তারা অত্যন্ত যত্নসহকারে সম্পন্ন করে দিতে পারতেন। আসন নিয়ে গোস্সা করে শপথ নিতে না চাইলে প্রয়োজনে হাসপাতালে স্পিকারকে পাঠিয়ে শপথের ব্যবস্থাও করে দিতেন। আর আগামী সরকারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়তো দেয়া হতোই। এর মধ্যে মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়টি বেগম খালেদা জিয়ার জন্য বরাদ্দ করার মতো বড় মনও গণতন্ত্রের মানসকন্যার আছে। নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিরোধী দলীয় নেত্রীর পদ হারিয়ে বেগম খালেদা জিয়া যে ভুল করলেন তার জন্য অচিরেই হয়তো সহানুভূতি সভা ডাকবেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
যারা জননেত্রীর কথাবার্তা শুনে তাকে রোমান সম্রাটদের মতো সর্বশক্তিমান এবং চেঙ্গিস খান মতো বেপরোয়া অভিহিত করে ইয়ার্কি মারেন, তাদের প্রতি করুণার দৃষ্টিপাত করতে পারেন তিনি। এসব মূল্যায়নে যে তিনি আরও উজ্জীবিত হচ্ছেন তা বোঝার মতো বুদ্ধিও কলামিস্ট, টিভি ভাষ্যকার ও বুদ্ধিজীবীদের নেই বলে মনে করেন তিনি। এমন ক্ষমতাবান হওয়ার স্বীকৃতি ক’জনার ভাগ্যে জোটে! হিটলার, চেঙ্গিস খান, হালাকু খানদের আর কতকাল বিশ্ববাসী উদাহরণ হিসেবে টানবে। তাদের স্থান দখল করতে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর যোগ্যতার ঘাটতি কোথায়? সমালোচকরা কে কী বলল, তা থোড়াই কেয়ার করেন মহাশক্তিধর আমাদের এই নেত্রী। বিশ্ব সংস্থাকে যিনি ধমক মারেন, তার কাছে এসব কটাক্ষ-ইয়ার্কি নস্যি।
অহেতুক আহাজারি করা হচ্ছে যে, ‘দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। ধ্বংসের মুখে মানুষের জীবিকা। অচল হয়ে পড়েছে অর্থনীতি। গত দুই দশকের অর্থনীতির অর্জনগুলো ভেস্তে যেতে বসেছে। সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কমে গেছে উত্পাদন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে। জীবন হাতে নিয়ে প্রতিদিন কাজে নামছেন স্বল্প আয়ের অসংখ্য মানুষ’।
সব কুচ ঠিক হ্যায়। গণমাধ্যম খামাখা প্রতিবেদন ছাপছে যে, ‘স্বাধীনতার পর দেশে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলন হলেও এখনকার মতো অচলাবস্থা আর কখনো দেখা যায়নি। অর্থনীতির প্রতিটি খাতই বিপদে আছে। রফতানি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে, কমছে আমদানি, বিনিয়োগ নেই, ব্যাংক অলস অর্থের পাহাড় নিয়ে বসে আছে, প্রবাসী-আয়ে কমছে, বাড়ছে খেলাপি ঋণ। বড় ধরনের সংকটে পড়েছে পর্যটনশিল্প। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব প্রথমবারের মতো শীতকালীন মেলা স্থগিত করে দিয়েছে’।
অর্থনীতি গোল্লায় যাক। লাশের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হোক। তাতে কী? দিল্লিপতির শুভাশিষে গদি যতদিন টেকে, তাতেই লাভ, তাতেই সুখ। এদেশের জনগণের প্রতি যে কোনো দায়বদ্ধতা বা দরদ নেই তাতো অনেক আগেই লন্ডন সাক্ষাত্কারে পরিষ্কার করেছেন তিনি। তার রাজনীতি যে কেবলই পিতৃহত্যার প্রতিশোধের জন্য তা খোলাসা করতে তো তিনি কখনো দ্বিধা করেননি। মসনদ ছেড়ে শাপলা কিলিং, বিডিআর কিলিং, পদ্মা সেতু দুর্নীতি, হলমার্ক লুট, কুইক রেন্টাল হরিলুট, শেয়ারবাজার লোপাটসহ নানাবিধ মহান (!) কর্মের দায়ে কাঠগড়ায় দাড়ানোর ঝুঁকি নেয়ার মতো আহাম্মক নন তিনি। ডু অর ডাই। তার আর ‘চাওয়া পাওয়ার কিছুই নাই’। অতএব ধর, মার, জেলে ভর, গুম কর, ঘরে-বাইরে গুলি করে খুন কর, যথেচ্ছভাবে শাসন কর, গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধর, সংবিধান ছুড়ে ফেলে নিজের স্বেচ্ছাচারী বিধান কায়েম কর—এই নীতিতেই চলবে। জয় হোক এই নীতির। আর এ জয়টা সুনিশ্চিত করতেই অবিলম্বে নবম সংসদের অধিবেশন ডেকে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ আইন সংশোধন করার জন্য আবারও জোর প্রস্তাব করছি। আসুন আমরা ২২০ বছর আগের ঐতিহ্যে ফিরে যাই। অবশ্য আইন পাস করার কথাটা একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেল। দরকার কী? তিনি যা বলেন, যা করেন সেটাইতো আইন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন