ইদানীং হারিয়ে যাওয়া গ্রামোফোন সম্পর্কে যারা জানেন তাদের নিশ্চয়ই কলের গানের ভাঙা রেকর্ড বাজানো সম্পর্কেও জানা রয়েছে। সাধারণ মানুষ গ্রামোফোনকে কলের গান বলতো। এতে রেকর্ড বাজানো হতো ছোট্ট একটা পিন দিয়ে। রেকর্ডের কোথাও কোনো কারণে ফাটল বা ক্ষতের সৃষ্টি হলে পিন এসে সেখানেই আটকে যেতো। ফলে সংগীতের একই কলি বা নাটকের একই সংলাপ শুনতে হতো শ্রোতাদের। এর ভিত্তিতেই কলের গানের ভাঙা রেকর্ড বাজানোর কথাটা প্রচলিত হয়েছে। রাজনীতিতে কথাটা তখনই বলা হয় যখন কোনো একজন বা কয়েকজন নেতা-নেত্রী একই কথা বারবার শোনাতে থাকেন। শ্রোতারা বিরক্ত হলেও তারা ওই রেকর্ড বন্ধ করার নাম করেন না। বর্তমান পর্যায়ে কথা উঠেছে ক্ষমতাসীনদের সংবিধানপ্রেমের পরিপ্রেক্ষিতে। ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ রক্ষাকেই তারা ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের প্রধান অজুহাত বানিয়েছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নেতৃত্বে এই সংবিধানকে তারা যে নিজেদের ইচ্ছামতো কাটাছেঁড়া করেছেন এবং বেগম খালেদা জিয়ার ভাষায় আওয়ামী লীগের ‘ইশতেহার’ বানিয়ে ছেড়েছেন সে সত্যের ধারেকাছেও কখনো যাচ্ছেন না তারা। এমনভাবেই বরং প্রচারণা চালাচ্ছেন যেন ৫ জানুয়ারি নির্বাচন না করা গেলে তাদের ‘মহাভারত’ অশুদ্ধ হয়ে যাবে! বহুবার বলা হয়েছে বলে বিষয়টি নিয়ে অবশ্য কথা বাড়ানোর দরকার পড়ে না। তাছাড়া পাঠকদের আবার মনে হতে পারে, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করতে গিয়ে এ নিবন্ধেও কলের গানের ভাঙা রেকর্ডই বাজানো হচ্ছে! এখানে বরং সর্বশেষ কিছু তথ্যের উল্লেখ সেরে নেয়া যাক।
প্রথম তথ্যটি হলো, অনেকটা হঠাৎ করেই বিএনপির সঙ্গে চলমান সংলাপের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেছেন ক্ষমতাসীনরা। কূটিল ও নোংরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করার মধ্য দিয়ে সংলাপের নামে যে নাটক মঞ্চায়নের পালা শুরু হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতায় এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর তাগিদে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে খান তিন-চারেক বৈঠক করেছেন তারা। জনগণকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে নিজেদের আন্তরিকতার ব্যাপারেও তারা যথেষ্টই শুনিয়েছেন। কিন্তু দৃশ্যমান কোনো কারণ ছাড়াই ১৯ ডিসেম্বর তিনটি পৃথক উপলক্ষে শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ঘোষণা করেছেন, দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে তারা আর কোনো আলোচনা করবেন না। বিএনপি নাকি নির্বাচনের ট্রেন মিস করেছে! সে কারণে এখন আলোচনা হতে পারে একাদশ সংসদের নির্বাচন নিয়ে। আওয়ামী লীগের চরিত্র সম্পর্কে যারা জানেন তাদের জন্য অত্যন্ত স্বাভাবিক হলেও তিন মন্ত্রীর এই ঘোষণায় বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে বিশেষ করে বিদেশীদের মধ্যে। কারণ, খালি হাতে ফিরে যাওয়া মিস্টার তারানকোকে তো বটেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বাংলাদেশের সংকটে উদ্বিগ্ন সব বিদেশীকেও এতদিন একথাই বুঝিয়ে আসা হচ্ছিল যে, ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ রক্ষার প্রয়োজনে আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি ও অন্য বিরোধী দলগুলোকে বাইরে রাখা হলেও দশম সংসদের মেয়াদ বেশিদিন হবে না। গঠিত হওয়ার স্বল্প দিনের ব্যবধানে ওই সংসদের বিলুপ্তি ঘটিয়ে একাদশ সংসদের নির্বাচন করা হবে। এর মধ্য দিয়ে সংকট কাটিয়ে ওঠার পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও আশ্বস্ত করেছিলেন ক্ষমতাসীনরা। অন্যদিকে সে অঙ্গীকার থেকে রাতারাতি সরে এসেছেন তারা। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য কিছুটা আশার আলো জ্বালিয়ে রাখার অভিনয় করেছেন। একইদিন অর্থাৎ ১৯ ডিসেম্বরই আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভায় তিনি বলেছেন, বিরোধী দল যদি হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার করে এবং মানুষ খুন ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা- বন্ধ করে তাহলে দশম সংসদ নির্বাচনের পর তাদের সঙ্গে আবার আলোচনা শুরু হতে পারে। সে আলোচনায় সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হলে প্রয়োজনে মেয়াদ পূর্তির আগেই সংসদ ভেঙে দিয়ে একাদশ সংসদের নির্বাচন করবেন তারা। চাইলে বিরোধী দল সে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় যে দশম সংসদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সংকটের সৃষ্টি সে নির্বাচন স্থগিত করার এবং বিরোধী দলের জন্য অংশ নেয়ার সুযোগ তৈরি করার কোনো চিন্তা বা ইচ্ছারই কিন্তু প্রকাশ ঘটাননি প্রধানমন্ত্রী। ওদিকে তিন মন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, দশম সংসদ পাঁচ বছরের নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ করবে। এরই পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতারা শেখ হাসিনাকেন্দ্রিক বিরোধী দলের প্রধান দাবিকেও সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন। প্রথমবারের মতো সমঝোতা বৈঠকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানাতে গিয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান থাকতে পারবেন না বলে যে দাবি বিএনপি জানিয়েছে সেটা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ যতো বিষয়েই সমঝোতা হোক না কেন শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদে রাখতেই হবে। বলা বাহুল্য, শেখ হাসিনাকে নিয়েই যেহেতু বিরোধী দলের প্রধান আপত্তি সেহেতু আওয়ামী লীগ যদি তার ব্যাপারে অনমনীয় থাকে তাহলে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার কোনো চেষ্টাই সফল হতে পারবে না। বিষয়টিকে ক্ষমতাসীনদের ‘চালাকি’ এবং ‘প্রতারণাপূর্ণ কৌশল’ হিসেবেও দেখা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সংলাপের টোপ ফেলে ও প্রলোভন দেখিয়ে বিরোধী দলকে কোনোভাবে আন্দোলন থেকে দূরে রেখে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পাড়ি দেয়াটাই ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য। আর একবার যদি নির্বাচনটি করে ফেলা যায় তাহলে আবারও বুঝিয়ে দেয়া হবে, আওয়ামী লীগ কাকে বলে! উল্লেখ্য, সম্প্রতি একাধিক উপলক্ষে শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থে প্রয়োজন হলে তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেবেন। কিন্তু এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে যাওয়ার মতো নেত্রী তিনি নন। বিশেষ করে প্রায় পাঁচ বছর ধরে যথেচ্ছভাবে ক্ষমতা ভোগ করার এবং ফ্যাসিস্ট স্বৈরশাসকের স্টাইলে দমন-নির্যাতন ও গুম-খুনের অপারেশন চালানোর মধ্য দিয়ে এমন এক অবস্থানে তিনি পৌঁছে গেছেন, যখন তার পক্ষে সহজে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেয়া সম্ভব হওয়ার কথা নয়। এজন্যই বলা হচ্ছে, নাটকীয়ভাবে মুখে বললেও প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেয়ার কথাটা তিনি আসলে কথার কথা হিসেবেই বলেছিলেন। এটা মোটেও তার মনের কথা ছিল না। তেমন ইচ্ছাও তার নেই। এ ব্যাপারে প্রমাণও তিনি যথেষ্টই দিয়ে চলেছেন। তিনি এমনকি সংবিধানের ব্যাখ্যা দিতেও হাজির হয়েছেন দৃশ্যপটে। সাধারণ মানুষকে তো বটেই, সংবিধান এবং আইন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে চুল পাকিয়ে ফেলা বিশেষজ্ঞদেরও সংবিধানের ব্যাখ্যা শিখিয়ে ছেড়েছেন তিনি।
বিরোধী দলকে বাইরে ঠেলে দিয়ে আয়োজিত একটি নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্ছা ও পরিকল্পনা কোনো সরকার এবং সে সরকার গঠনকারী রাজনৈতিক দলের থাকতেই পারে, কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে প্রশ্ন উঠেছে বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে। দেখা যাচ্ছে, ‘স্বাধীন’ প্রতিষ্ঠান হলেও বর্তমান কমিশন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রথম থেকেই ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সর্বাত্মকভাবে তাল মিলিয়ে চলেছে। বিভিন্ন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশনাররা বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো বাধা নেই। তারা এমনভাবে নির্বাচনী বিধিমালা সংশোধন করার কথাও শুনিয়ে এসেছেন যার ফলে সব দলের প্রার্থীরাই মন্ত্রী-এমপিদের মতো সমান সুযোগ পাবেন। অর্থাৎ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কথা বলেছে কমিশন। মুখে বললেও নির্বাচন কমিশনারদের কথাগুলো কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য হতে পারেনি। এর কারণ, কিছুদিন পর্যন্ত নিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণ নিলেও নির্বাচন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা খোলস ঝেড়ে ফেলতে শুরু করেছেন। বোঝাই যাচ্ছে, তারা আসলে আওয়ামী ঘরানার লোক। এজন্যই কথাও বলছেন তারা ক্ষমতাসীনদের সুরে ও ভাষাতেই। একই কারণে বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া না বলে পারেননি যে, এই কমিশন ‘অথর্ব’ ও ‘মেরুদন্ডহীন’ এবং সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। খালেদা জিয়ার পর মুখ খুলেছেন অন্য সব দলের নেতারাও। তারা বলেছেন, নির্বাচন কমিশনকে দলীয়করণ করা হয়েছে এবং নানা কর্মকা-ের মাধ্যমে কমিশন জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। কমিশনারদের বক্তব্যে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আগামী নির্বাচন হবে একতরফা।
বলা বাহুল্য, অকারণে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অনাস্থার প্রকাশ ঘটেনি। এটা আর নতুন কোনো খবর নয় যে, প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের অধীনে এমনভাবে নির্বাচন করতে চাচ্ছেন যাতে তিনি নিজে এবং মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ তার দলীয় প্রার্থীরা পরিপূর্ণ সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেন। এ উদ্দেশ্যে প্রশাসনকে ষোলো আনা দলীয়করণ করা হয়েছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী তো ‘নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার’ গঠনেরও অনেক আগে থেকেই রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়ে এবং সরকারি খরচে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। কিন্তু কমিশনকে কখনো প্রতিবাদ জানাতে বা আইনত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। কথা শুধু এটুকুই নয়। দায়িত্ব যেখানে ছিল নির্বাচনী বিধিমালা অনুযায়ী আইন লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া নির্বাচন কমিশনাররা সেখানে উল্টো ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছেন। পদ ও ক্ষমতা না ছেড়েই প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে ও প্রচারণাসহ তৎপরতা চালাতে পারেন তার বিধান রেখেও নির্বাচনী আচরণবিধিতে সংশোধনী এনেছে কমিশন। এর ফলে বহুল আলোচিত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডই শুধু নষ্ট হচ্ছে না, ক্ষমতাসীনদের জন্য কারচুপি এমনকি ভোট ডাকাতি করাও আইনসিদ্ধ হয়ে উঠবে। এরই পাশাপাশি বিএনপির আদলে বিএনএফ নামের একটি ভূঁইফোড় দলকে নিবন্ধন দেয়ার ব্যাপারে মাতামাতির মাধ্যমেও কমিশন বর্তমান সরকারের পক্ষেই ভ’মিকা পালন করেছে। অর্থাৎ সব কর্মকা-ের মাধ্যমেই কমিশন তার গ্রহণযোগ্যতা খুইয়ে ফেলেছে। এই কমিশনের অধীনে কোনো সষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।
কলের গানের ভাঙা রেকর্ড মনে হলেও এখানে নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ কিছু কীর্তির কথা উল্লেখ করতেই হবে। প্রথমে আসে তফসিল ঘোষণার প্রসঙ্গ। দীর্ঘদিন পর্যন্ত সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে আশ্বাস দিলেও ২৫ নভেম্বর হঠাৎ করেই তফসিল ঘোষণা করে বসেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। প্রশ্ন উঠেছে ও সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে আসলে বিভিন্ন সময়ে ঘোষিত আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে। কারণ, সিইসি কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ বহুবার বলেছেন, কমিশনের দিক থেকে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হলেও তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার জন্য অপেক্ষা করছেন। কেননা, তারা চান, প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে অংশ নিক এবং সব দলের অংশগ্রহণের ফলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠুক। কোনো দলের নাম উল্লেখ না করলেও মূলকথায় সিইসি সব সময় প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে চেষ্টা চালানো হচ্ছে এবং সে চেষ্টা সফল হওয়ার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে কিছুটা এদিক-সেদিক করে সে সম্পর্কেও জানিয়েছিলেন সিইসি। ফলে জনমনে এমন আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিল যে, কমিশন অন্তত সরকার ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে এবং বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পরই তফসিল ঘোষণা করা হবে। অন্যদিকে তফসিল ঘোষিত হয়েছে হঠাৎ করে, সেটাও আবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসার পরদিনই। সিইসি নিজেদের ঘোষিত আশ্বাস তথা অঙ্গীকার থেকে সরে যাওয়ার ফলেই রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি জনমনেও তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। পূর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুুযায়ী ১৮ দলীয় জোট পরদিন ২৬ নভেম্বর সকাল থেকেই সারাদেশে সড়ক, নৌপথ ও রেলপথ অবরোধের কর্মসূচি পালন করতে শুরু করেছে। সেটা এখনো চলছে। অথচ সদিচ্ছা থাকলে খুব সহজেই এমন পরিস্থিতি এড়ানো যেতো। সেটাই কমিশনের দায়িত্বও ছিল। সিইসি নিজেও যে রাজনৈতিক সংকটের কথা বলেছেন, সে সংকট কাটিয়ে ওঠার পন্থা কিন্তু সংবিধানেই রয়েছে। সংবিধানে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার নির্দেশনা দেয়া আছে। সন্দেহ নেই, এজন্য প্রধান দায়িত্ব ছিল সরকারের কিন্তু কমিশনও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারতো। সরকারকে উপর্যুপরি অনুরোধ জানানোর পাশাপাশি কমিশন বিএনপির সঙ্গেও বৈঠকে বসতে পারতো। সংঘাত এড়ানোর জন্য কমিশন সহজেই পূর্ববর্তী ৯০ দিনের পরিবর্তে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনকে বেছে নিতে পারতো। এর ফলে সমঝোতা ও সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য অনেক বেশি সময় পাওয়া যেতো। কিন্তু সিইসি ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা পূরণের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। সিইসি প্রমাণ করেছেন, ‘অথর্ব’ ও ‘মেরুদ-হীন’ শুধু নয়, ক্ষমতাসীনদের অতি যোগ্য বশংবদও তারা।
মূলত নির্বাচন কমিশনের এই ভূমিকার ফাঁক গলিয়েই দশম সংসদ নির্বাচনকে তামাশার বিষয়ে পরিণত করার সুযোগ পেয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। একই কারণে তিনশ আসনের সংসদে ১৫৪ জনই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে পেরেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে কমিশনের কিছু করার নেই ধরনের যুক্তি দেখানো হলেও বলা হচ্ছে, সাধারণভাবেও কমিশন আইনের তোয়াক্কা করছে না। সরকারি অর্থে প্রচারণা চালানোর মতো বেআইনী বিভিন্ন কর্মকা-ের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, কোনো প্রার্থী বা দল আইন লংঘন করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দূরের কথা, কমিশন নিজেই নির্বাচনী আইন মানছে না। যেমন একটি আইনে বলা আছে, কোনো দল নির্বাচন না করলে বা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালে সে দলের সব প্রার্থীর প্রার্থিতাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। অর্থাৎ ওই দলের নামে কেউই প্রার্থী থাকতে এবং দলের জন্য বরাদ্দ করা প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন না। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, এই আইন অনুযায়ী এরশাদ নিজে যেহেতু চিঠি দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন সেহেতু জাতীয় পার্টির সব প্রার্থীর মনোনয়নপত্রই বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটা না করে উল্টো সিইসি কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ বলেছেন, প্রত্যেক প্রার্থীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন সংশ্লিষ্ট এলাকার রিটার্নিং অফিসাররা। বলা বাহুল্য, আইনের এমন ব্যাখ্যা কেবল অথর্ব ও মেরুদন্ডহীন সেবাদাসদের পক্ষেই দেয়া সম্ভব। কারণ, ব্যক্তি-প্রার্থীর ব্যাপারে পৃথকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ থাকলে ইসির পক্ষ থেকে বিভিন্ন দলকে নিবন্ধন ও প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হতো না। এটা দেয়ার উদ্দেশ্যই হলো, যাতে কোনো ব্যক্তি-প্রার্থী বিশেষ কোনো দলের প্রতীক ও নাম ব্যবহার করে নির্বাচনে না দাঁড়াতে পারেন। কিন্তু জাতীয় পার্টির ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে কমিশন মূল একটি আইনই লংঘন করেছে (এখানে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী বলার কারণ, দলের চেয়ারম্যান এরশাদ স্বয়ং মনোনীত সকল প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেকে সটান দাঁড়িয়ে থেকেছেন)। কথা শুধু এটুকুই নয়। আওয়ামী লীগের বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ সর্বশেষ তিনজনের বেলায় দেখা গেছে, দলটির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমামের একটি বেআইনী চিঠির ভিত্তিতে কমিশন তাদের ‘নির্বাচিত’ ঘোষণা করেছে। এই চিঠি এইচ টি ইমাম পাঠিয়েছেন ‘ব্যাক ডেটে’Ñ পেছনের তারিখ দিয়ে। উল্লেখ্য, এ তিনজনকে যোগ করেই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’দের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫৪।
এভাবে সব মিলিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই দশম সংসদ নির্বাচনকে চরম এক হাস্যকর ও তামাশার বিষয়ে পরিণত করে ছেড়েছে নির্বাচন কমিশন। এ প্রসঙ্গেই কলের গানের ভাঙা রেকর্ড বাজানোর পাশাপাশি এসেছে বাঁশী বাজানোর বিষয়টি। পাঠকরাও নিশ্চয়ই ইতিহাসের প্রসিদ্ধ সে কাহিনী জানেন। কাহিনীটি হলো, রোম যখন পুড়ছিল সম্রাট নিরো নাকি তখনও মনের আনন্দে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। লক্ষ্য করলে এবং বিভিন্ন কথাবার্তা শুনলে দেখা যাবে, সিইসি কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ নিরোর সেই বাঁশি বাজানোর কথাটাই বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। বিস্তারিত উল্লেখের পরিবর্তে এখানে তার সর্বশেষ একটি মন্তব্য উল্লেখ করা যাক। তার নিজের ঘোষিত তফসিলকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলের অবরোধে সারাদেশ যখন অচল হয়ে পড়েছে, সরকারের নিষ্ঠুর অভিযানে যখন শয়ের অংকে নেতা-কর্মীসহ নারী, শিশু ও বৃদ্ধের পর্যন্ত মৃত্যু ঘটছে, বিরোধী দলের শত শত নেতা-কর্মীকে যখন কারাগারে ঢোকানো হচ্ছে তেমন এক কঠিন দুঃসময়েও গত ১৮ ডিসেম্বর সিইসি বলে বসেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সঙ্গে নাকি চলমান সহিংসতা ও হত্যাকান্ডের কোনো সম্পর্ক নেই! এ ধরনের ঘটনা নাকি আগেও ঘটেছে এবং সে কারণে এসবের কোনো দায়দায়িত্ব কমিশন নেবে না। আরো একটি কথা বলেও তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সিইসি। বলেছেন, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো নাকি তাদের ‘স্বাভাবিক’ কাজ করছে! অথচ কথিত নির্বাচনকালীন সরকারের সময় প্রশাসন ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকার কথা। অন্যদিকে ‘স্বাভাবিক’ কাজের আড়ালে বাহিনীগুলো এখনো রাজনৈতিক দলের সরকারের হয়েই কাজ করছেÑ বিরোধী দলকে শুধু দমনই করছে না, নির্মূল করে ফেলার লক্ষ্যেও অভিযান চালাচ্ছে। এই অভিযানে প্রতিদিন মৃত্যু ঘটছে অসংখ্য নেতা-কর্মীর। গ্রেফতারও করা হচ্ছে শত শত নেতা-কর্মীকে। সিইসি অস্বীকার করলেও আইনত সবকিছুর দায়দায়িত্ব কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ওপরই বর্তায়। এমনকি র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগসহ আওয়ামী গুন্ডা-সন্ত্রাসী ও ক্যাডারদের দিয়ে দমন ও হত্যার অভিযান চালানোর দায়দায়িত্বও এড়াতে পারে না কমিশন। অন্যদিকে সিইসি এখনো সম্রাট নিরোর মতো বাঁশীই বাজিয়ে চলেছেন। সেবাদাসের ভূমিকা পালন করার মধ্য দিয়ে প্রভুর তথা ক্ষমতাসীনদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারছেন বলে সিইসি ও তার সহকর্মীদের চিত্তে আনন্দ থৈ থৈ করতেই পারে, বাঁশীও তারা আনন্দে বাজাতেই পারেন, কিন্তু পরিণতি বলেও একটা কথা রয়েছেÑ সিইসিকে এক সময় যে পরিণতির মুখোমুখী হতে হবে। সেটা কতটা ভয়ংকর হবে তা না বলা গেলেও এটুকু অন্তত বলে রাখা যায়, ওই পরিণতি তার জন্য আদৌ সুখকর হবে না। আমরা জানি না, সময় একেবারে পেরিয়ে যাওয়ার আগে সিইসি বিকল্প কোনো চিন্তা ও চেষ্টা করবেন কি না, নাকি প্রভুদের সন্তুষ্টি ও মনোরঞ্জনের জন্য কেবল বাঁশীই বাজাতে থাকবেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন