আওয়ামী লীগ
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা অহরহ বলে থাকে। মনে হয়, তারাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একমাত্র ধারক ও বাহক।
মুক্তিযুদ্ধের পর তারা স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব দল ও মতের
লোকের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠনের দাবিকে উপেক্ষা করে দলীয়
সরকার গঠন করে সঙ্কীর্ণ মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধকে তারা বানিয়ে
ফেলেছেন দলীয় সম্পদ। তাদের মতেÑ যারা আওয়ামী লীগের
সমর্থক, শুধু তারাই মুক্তিযুদ্ধের
চেতনায় বিশ্বাসী। অন্যরা ‘স্বাধীনতার বিপক্ষের
শক্তি’ এমনকি যারা এক সময় আওয়ামী
লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক ও নেতা ছিলেন, কিন্তু
পরে দলটি ত্যাগ করেছেন তাদেরও তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নয় বলে মনে
করেন। একবার লেখকের সাথে আলাপকালে মুক্তিযুদ্ধের এক সাব-সেক্টর কমান্ডার আওয়ামী
লীগ নেতাদের মধ্যে যারা ১৯৭১ সালে ভারতে গিয়েছিলেন তাদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ না বলে ‘শরণার্থী’ বলে আখ্যায়িত করেন।
কারণ তার মতে, মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়ে
তাদের অনেকে আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে ছিলেন। আওয়ামী লীগের মতে, তাদের আদর্শে বিশ্বাসী না হলে কেউ
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নয়। কিন্তু তাদের কর্তৃক সংবিধানে সন্নিবেশিত চার
মৌলনীতির অন্যতম, সমাজতন্ত্রে কি আওয়ামী লীগ
নিজেই বিশ্বাসী? যদি তা হয়, তা হলে তারা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির
প্রবর্তন ও চর্চা করছেন না কেন? প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী
লীগ সমাজতান্ত্রিক দল বলে কেউ বিশ্বাস করে না। আর আওয়ামী লীগ কর্তৃক সংবিধানে
সন্নিবেশিত ধর্মনিরপেক্ষতার কথা মুক্তিযুদ্ধকালে (লেখক নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা) বলা
হয়নি। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের সাথে সম্পাদিত গোপন চুক্তির শর্তানুসারে
ভারতীয় সংবিধানের আদলে ওই মৌল নীতিগুলো আওয়ামী লীগ সংবিধানে সন্নিবেশিত করেছে।
উল্লেখ্য, সংবিধানের চার মৌলনীতির একটি
হলো, গণতন্ত্র। তা হলে ১৯৭৫ সালে
আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত একদলীয় শাসনব্যবস্থা তথা বাকশাল গঠন করল
কিভাবে? এটি কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
ছিল? আওয়ামী লীগ মুখে গণতন্ত্রের
ধারাবাহিকতা বজায় রাখার কথা বললেও তাদের মনোজগতে এখনো ‘বাকশালের ভূত’ ক্রিয়াশীল বলে কাজে কর্মে প্রতীয়মান।
বিএনপি কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা আওয়ামী লীগের চেয়ে কম
হবে বলে মনে হয় না।
মুক্তিযুদ্ধের
চেতনার দলীয়করণের কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা যায়। যেমন, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর জেনারেল (অব:) এম এ জি
ওসমানীকে তারা যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেননি, এখনো
করেন না। মুক্তিযুদ্ধের তথা গণতন্ত্রের চেতনার পরিপন্থী ‘বাকশাল’ কায়েম
করায় তিনি প্রতিবাদস্বরূপ সংসদ সদস্য পদ ত্যাগ করেন এবং পরে রাজনৈতিক দল গঠন করেন
আদালাভাবে। এ কারণেই আওয়ামী লীগ তাকে সম্মান প্রদর্শনে অনীহা প্রকাশ করে। আওয়ামী
লীগ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার লে. জে. (অব:) মীর শওকত আলী এবং উইং
কমান্ডার (অব:) হামিদুল্লাহ খানের মৃত্যুতে একটি শোকবাণী পর্যন্ত দেয়নি। কারণ তারা
বিএনপির আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষক এবং ‘বীর উত্তম’ খেতাবপ্রাপ্ত অন্যতম সেক্টর কমান্ডার শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর
রহমান নাকি ‘পাকিস্তানি চর’। হয়তো এর বড় কারণ, তিনি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আশা-আকাক্সার
প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির
রাহমানির রাহিম’ এবং ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সন্নিবেশিত করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি জাতীয়
ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংহতিমূলক নীতি গ্রহণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির
চর্চা শুরু করেন। আর বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম নাকি কোনো
মুক্তিযুদ্ধই করেননি। অথচ তার বিশাল ‘কাদেরিয়া
বাহিনীর’ লড়াইয়ের বীরত্বগাথা কে না
জানে। এর কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুর একজন তুখোড় সমর্থক হলেও আওয়ামী লীগের বর্তমান নীতি
ও আদর্শের সাথে একমত নন। তিনি এখন ভিন্ন একটি দলের সভাপতি। অনেকেরই অভিযোগ, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে এবং
মুক্তিযোদ্ধাদের দলীয় সম্পদ মনে করে। এমনকি, দলটি
বিএনপি কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধদের সংবর্ধনা দেয়ার বিরোধিতা করেছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের
চেতনা হতে পারে না।
আওয়ামী
লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে ‘গণজাগরণ’ মঞ্চের চেতনা সমর্থন করেছে, যারা ইসলাম ও মহানবী সা: সম্পর্কে কটূক্তি
করে এবং যারা বিধিমালা লঙ্ঘন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে যখন-তখন জাতীয় পতাকা
উত্তোলন এবং যখন তখন দেশবাসীকে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার নির্দেশ দেয়। সরকারি মন্ত্রী ও
কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সেই নির্দেশ পালন করতে একরকম বাধ্য ছিল। এভাবে সমান্তরাল
সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল শাহবাগমঞ্চ। সরকারের মদদেই তারা মাসের পর মাস সড়ক
অবরোধ করে জনসাধারণের দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে, যার
খেসারত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারকে দিতে হয়েছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে
নির্বাচন হলে জাতীয় নির্বাচনেও অনুরূপ মাশুল দিতে হবে।
আওয়ামী
লীগের কাছে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ মানে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও বিশ্বাসকে
নির্বাসনে দেয়া। উদাহরণস্বরূপ, তারা ১৯৭২ সালে
জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ
মুসলিম হল এবং ফজলুল হক মুসলিম হল থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম
থেকে ‘রাব্বি জিদনি ইলমি’ কুআনের এই কথাগুলো বাদ দিয়েছিলেন। পরে
হাইকোর্টের নির্দেশে হল দুটোর নাম পুনর্বহাল করা হয়। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম
বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মুসলিম’ অংশটুকু আর পুনঃসন্নিবেশিত করা হয়নি।
আওয়ামী
লীগের এ মনোভাব তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দলীয় ব্যাখ্যা জাতির মাঝে বিভেদ সৃষ্টির
চেতনা বই কিছু নয়। এ ধরনের প্রবণতাকে উসকে কিংবা প্রশ্রয় দিয়ে দলটি জাতীয় ঐক্য ও
সংহতি প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। জাতীয় সংহতি ও সমৃদ্ধির স্বার্থে উদার
ও বহুত্ববাদী চেতনা ধারণ করাই হবে সবার জন্য কল্যাণকর।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন