দেশ এখন এ কোন
গণতন্ত্রের কবলে পড়েছে সেটা প্রমাণ করতে বা
বুঝতে চাইলে প্রিন্টেড ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দিকে দৃষ্টি দিলে যে কেউ তা অনুধাবন
করতে পারবেন। মানুষ যে বর্তমান গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারের সাথে একমত পোষণ করছে না
সেটা স্পষ্ট বোঝা যায় একতরফা নির্বাচনের আয়োজন থেকে। যে নির্বাচনে ১৫ ডিসেম্বর
জাতীয় দৈনিকের হিসাব মতে, ভোট ছাড়াই বিজয় অর্জন
করেছে ১৫৪ জন। এর মধ্যে মহাজোটের ১৪ দলীয় অন্যতম দল আওয়ামী লীগ
বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী ৪.৮ আসনে, ১৮
আসনে জাপা, ২ আসনে জাসদ, ২ আসনে ওয়ার্কার্স পার্টি ও এক আসনে জেপি। ১৪
দল তথা মহাজোটের দুই-একটি ছাড়া সবারই মার্কা আওয়ামী লীগের নৌকা।
বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় অর্থাৎ ভোট ছাড়াই বিজয় অর্জন। ৪৩তম বিজয় দিবস উদযাপনের সময়
যা বাংলাদেশের গত ৪২ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এ কারণে
জনগণ বলাবলি করছে রাস্তাঘাটে হাটবাজারে অফিস আদালতে
এমনকি ফুটপাথের চায়ের দোকানে দেশ এখন মারাত্মক স্বৈরাচারের কবলে পড়েছে।
১৯৭৩
সালে প্রথম সংসদে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয় লাভ করেছিল ১১ জন। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয়
সংসদে ১১ জন, ১৯৮৮ চতুর্থ সংসদে ১৮ জন, ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সংসদে ৪৯ জন, ২০১৪ দশম সংসদে ১৫৪ জন। নির্বাচন ৫ জানুয়ারি।
বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ জনের সংখ্যা যে আরো বাড়বে সেটা বুঝতে কারো অসুবিধা হবে
না শুধু অপেক্ষা করতে হবে আরো
কিছু দিন। বর্তমান সরকার জনগণকে এখন
গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারের পাঠশালায় অধ্যয়নের আহ্বান জানিয়েছেন প্রাথমিকভাবে একদলীয়
নির্বাচনের আয়োজন করে। ১৯৮৮ আর ১৯৯৬ এর নির্বাচনকে ভোটারবিহীন নির্বাচন বলা যায়।
আগের
নির্বাচনগুলোর তুলনায় এবারই সবচেয়ে কম প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বিধায় জনগণ
মনে করছে এটাই গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারের আসল রূপ। ১৪ ডিসেম্বর শনিবার পর্যন্ত দশম
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টিতে একজনের বেশি প্রার্থী খুঁজে পাওয়া
যায়নি। ফলে দেশের মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেকই ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে ভোট
দেয়ার সুযোগ পাবেন না। বাকি অর্ধেক ভোটার ওই সুযোগ পেলেও তাদের কতভাগ ভোটকেন্দ্রে
যাবেন, তা নিয়ে নির্বাচন কমিশন এখনই
চিন্তিত। নির্বাচন বর্জনকারী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিরোধীদল বিএনপি ১৪ ডিসেম্বর ’১৩ শনিবার এক বিবৃতিতে বলেছে, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলে নির্বাচন
কমিশন রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর ফরমায়েশ প্রতিষ্ঠানের মতো কাজ করছে।
এ
দেশে অনিয়মই যে নিয়ম সেটা প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড দেখে।
অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন
নিশ্চিত করার মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু কমিশনের গত কয়েক দিনের
কর্মকাণ্ড এর স্বাধীন অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। এর প্রমাণ পেতে চাইলে ১৩ ডিসেম্বর
শুক্রবার বিকেল ৫টায় মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময়সীমা শেষ হয়ে গেলেও ১৪ ডিসেম্বর
সকাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের অনেকের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের
সুযোগ দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে কমিশনের বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রীর একজন সাবেক
উপদেষ্টা এই প্রক্রিয়া তদারক করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সাজানো প্রশাসনেই একতরফা
নির্বাচন এ কারণেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী পদ থেকে সরে দাঁড়াতে চাচ্ছেন না।
প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে সে জায়গায় নির্দলীয় লোক বসালে সাজানো প্রশাসন ভেঙে
যাবে। ফলে আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচনের এজেন্ডা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না বলেই
বিএনপিকে মাইনাস করে এরশাদকে নিয়ে গৃহপালিত বিরোধী দল বানিয়ে দশম সংসদ নির্বাচনের
দীর্ঘ দিনের লালিত রূপরেখা বাস্তবায়নে এখনো সক্রিয় বলা যায়। এখন দেশের মানুষ
এরশাদের পাশাপাশি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকেও স্বৈরাচারী সরকার হিসেবে
চিহ্নিত করছে। ২০০৬ সালে ঠুনকো অজুহাতে কেএম হাসানের মতো একজন সাবেক প্রধান
বিচারপতিকে আওয়ামী লীগ মানেনি। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের দলীয় সভানেত্রী বর্তমান
নির্বাহী প্রধান শেখ হাসিনাকে ১৮ দলীয় জোটের পক্ষে কিভাবে মেনে নেয়া সম্ভব। এ
কথাটি আওয়ামী লীগও বোঝেÑ সমস্যাটা হলো বিচার
মানি তালগাছটা আমার। দেশ এখন গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের কবলে পড়েছে বলে মন্তব্য
করেছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি আরো
বলেন, এটি সামরিক স্বৈরতন্ত্রের
চেয়ে আরো ভয়ানক। সত্যিকার অর্থে দেশে কোনো গণতন্ত্র নেই। বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবা
উচিত। ১৩ ডিসেম্বর ২০১৩ শুক্রবার সিরডাপ মিলনায়তনে ‘দেশ শান্তি চায়’ শীর্ষক
বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে নাগরিক আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। এরশাদের
সময় ‘স্বৈরাচার নিপাত যাকÑ গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগানে আন্দোলন হয়েছে। এরপর গণতন্ত্র
এলো। কিন্তু আমরা গত কয়েকদিনে টের পেয়েছি যে স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে আমরা ছিলাম তার
চেয়ে অনেক খারাপ স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে আমরা পড়েছি বর্তমানে। বর্তমান সরকারের
স্বৈরাচারের আরেকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও তরীকত ফেডারেশনকে নৌকা
প্রতীক বরাদ্দ দেয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে গুরুতর
আইনি প্রশ্ন উঠেছে। ১৮ ডিসেম্বর সিইসির কাছে লেখা এক চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা এই তিনদলের ১০ জন প্রার্থীকে জোটবদ্ধ প্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করে নৌকা
প্রতীক বরাদ্দ দেয়ার অনুরোধ জানান। নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী
রিটার্নিং কর্মকর্তাদের প্রতীক বরাদ্দের নির্দেশ দিয়েছে। বিষয়টি আরপিওর (গণপ্রতিনিধিত্ব
আদেশ) পরিপন্থী। আরপিওর ২০ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, একাধিক রাজনৈতিক দল জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করলে তা তফসিল ঘোষণার
তিন দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ, জাসদ, ওয়ার্কার্স
পার্টি ও তরীকত ফেডারেশন কখন নির্বাচনী জোট গঠন করেছে এ ব্যাপারে তারা কমিশনকে
কিছুই জানায়নি বলে সূত্র জানায়। (তথ্যসূত্র : প্রথম আলো ও মানব জমিন ১৫ ও ১৪ ডিসেম্বর ২০১৩) একটি অসুস্থ
রাজনীতি সুস্থ অর্থনীতিকে কিভাবে অসুস্থ করে, বাংলাদেশ
তার জ্বলন্ত প্রমাণ। কথাটি বলেছেন ব্যবসায়ী নেতা ও এপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ
মঞ্জুর এলাহী ১৫ ডিসেম্বর প্রথম আলোর বিশেষ সাক্ষাৎকারে। তিনি একথাও বলেছেন
ব্যবসায়ীরাও দু’দলে বিভক্ত। এক গ্রুপ সরকারি
দলে এবং অপর গ্রুপ বিরোধী দলে বিশ্বাসী। এ কারণে বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের দায়
থেকে ব্যবসায়ীরা এড়াতে পারেন না। যেমন সরকারই ঠিক করে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কে
হবেন। আমরা ব্যবসায়ীরাও সেটি মেনে নিচ্ছি। ১৫ থেকে ২০ বছর আগে এফবিসিসিআইয়ের
সভাপতি কে হবেন তা নিয়ে সরকারপ্রধান মাথা ঘামাতেন না। কোনো সভ্য দেশেই এটি হয় না।
সরকার মনোনীত এফবিসিসিআই সভাপতির পক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলা সম্ভব নয়।
ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক বলয়ে ঢুকে যাওয়ার কারণে তারা এখন মারাত্মক অস্তিত্বের সঙ্কটে
ভুগছেন। তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। ব্যবসায়ীদের এই রাজনৈতিক বৃত্ত থেকে বেরিয়ে
আসতে হবে। দু’টি বড় রাজনৈতিক দলে
ব্যবসায়ীরা সমর্থক হওয়ার কারণে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। কথাগুলো
বলেছেন বিশেষ সাক্ষাৎকারে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী।
ড.
শাহদীন মালিক (আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট এবং অধ্যাপক, স্কুল অব ল’ ব্রাক ইউনিভার্সিটি) ১৫
ডিসেম্বর রোববার প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক নিবন্ধের শেষে গিয়ে বলেছেনÑ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনের জন্য
অভিনন্দন পাওয়া যায়, কিন্তু জনগণের আস্থা, বিশ্বাস ও সমর্থন পাওয়া যায় না। জনগণের
সমর্থন ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করে দেশ চালানোর চেষ্টা করে
একমাত্র স্বৈরাচারীরা। তবে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে সেটা বাংলাদেশে আর সম্ভব
নয়। বিরোধী দলকে উন্মুক্ত রাজনীতি করতে দিতে হবে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বিএনপির
অফিসের তালা খুলে দিতে হবে। ১৭ ডিসেম্বর তাদের ঢাকায় সমাবেশ, মিটিং-মিছিল করতে দিতে হবে। অধমের
দৃঢ়বিশ্বাস তাহলে বিএনপি ১৮ তারিখ থেকে অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহার করবে। নির্বাচন
কমিশনও দায়বদ্ধতা এড়াতে পারবে নাÑ এ কারণে যে ৯ কোটি
ভোটারের মধ্যে ৫ জানুয়ারি ২০১৪ অর্ধেক ভোটারও ভোট দেবে না। জনতার আদালতে সরকার ও
নির্বাচন কমিশনকে এ কারণে একদিন জবাবদিহি করতে হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন