আধুনিক কালে নির্বাচন
অনুষ্ঠান ও তদনুযায়ী সরকার গঠন দৃশ্যত গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বৈধতা
দিয়ে থাকে। যদি আমরা ভারতীয় উপমহাদেশ তথা ভারত, পাকিস্তান
ও বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সময়ের নির্বাচনগুলো ল করি, সেখানে দেখা যায় কখনো বা স্বাধিকার লাভের
নিমিত্তে, আবার কখনো বা মতা গ্রহণের
ল্েয নির্বাচন সংগঠিত হয়েছে। উল্লেখ্য, মতালাভের
নিমিত্তে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ গণতন্ত্রসমর্থিত যদি
তা নির্বাচন-উত্তর সময়ে জনগণের কল্যাণসাধনের ল্েয পরিচালিত হয়। কারণ গণতন্ত্রের
মৌল আদর্শ হলো জনকল্যাণ।
উপমহাদেশের
প্রথম নির্বাচন ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যার
প্রধান উদ্দেশ্য ছিল স্বাধিকারের দাবি আদায় এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে
প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। এ নির্বাচনটিরও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল
স্বাধিকারের দাবি আদায়। স্বাধিকারের দাবি কখন গণদাবিতে রূপান্তরিত হয়? যখন কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দু’টি শক্তিশালী গোষ্ঠী একে অপরের সাথে
প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থেকে দাবি আদায়ের চেষ্টা করে। কখনো আন্দোলনের মাধ্যমে
যুক্তরাষ্ট্রীয় কায়দায় সরকার গঠনের দাবির মাধ্যমে; আবার কখনো বা আন্দোলনে পরিপূর্ণরূপে শামিল থেকে অধিকার আদায়ের
মাধ্যমে। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিক প্রোপট আলোচনা করলে দেখি যে, মুসলিম লীগের মতো একটি বৃহৎ দল পর্যন্ত
কংগ্রেসের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে স্বাধিকার আদায়ের ল্েয ব্রিটিশ শাসনের প্রতি নমনীয়
ভাব প্রদর্শন করেছিল। বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রোপটে এ দেশের জনগণ পরাধীন
নয়। বরং স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে বাস করছে এ কথা ঠিক। কিন্তু স্বাধিকার আদায়ের
দাবির মতো জাতি যে দুই ভাগে বিভক্ত, এ
কথা বলার অপো রাখে না। বর্তমান মতাসীন সরকারের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী
বাংলাদেশের জনগণকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। এক : আংশিক ধর্মপালনকারী সেকুলারপন্থী, দুই : ধর্মপন্থী। জাতি দুই ভাগে বিভাজিত
হওয়ার প্রমাণ আরো বেশি প্রকট হয়ে ওঠে যখন রাজনৈতিকভাবে দু’টি শিবিরে বিভক্ত হয়ে সেকুলারিস্ট ও
ডানপন্থীদের দিয়ে গঠিত হয়েছে যথাক্রমে ১৪ দলীয় ও ১৮ দলীয় জোট। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের সর্বশেষ সাধারণ
নির্বাচনে নিবন্ধনকৃত ৩৯টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। ১৪ দল ও ১৮ দল গঠনের মধ্য দিয়ে ৩২
দলের সমন্বয়ে দু’টি শিবির ইতোমধ্যে গঠিত
হয়েছে। বাকি যে দলগুলো অবশিষ্ট আছে তারাও এই দু’টি শিবিরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যোগ দেবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। বাংলাদেশের
অধিবাসীদের দু’টি শিবিরে বিভক্ত হওয়া যেন
স্বাধিকার আন্দোলনের কার্বন কপি। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনী ফলাফলস্বরূপ মুসলমানদের
জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি গঠনের নিমিত্তে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ কর্তৃক ১৯৪০ সালে
লাহোর প্রস্তাব ঘোষিত হয়েছিল। আর ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ের জের ধরে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, যা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা
আন্দোলনের গতিকে বেগবান করেছিল। বাংলাদেশের জনগণের দু’টি ব্লকে বিভক্ত হওয়া এ দেশের ভাগ্যে কী
পরিণতি বয়ে আনে, তা দেখার বিষয়।
এ
দেশের জনগণ শাসিত হয়েছে একদলীয় শাসন দ্বারা, সামরিক
শাসক দ্বারা, নির্বাচন অনুষ্ঠানকল্পে গঠিত
সেনাসমর্থিত সরকার দ্বারা এবং গণতান্ত্রিক সরকার দ্বারা। গণতান্ত্রিক সরকারগুলো
দলীয় কায়দায় অনেক বিষয় বিবেচনায় আনলেও জেরেমি বেনথাম প্রবর্তিত ‘উপযোগবাদ’ তত্ত্বের প্রয়োগ অন্তত ঘটিয়েছিল। সেখানে বলা হয় ‘অধিকসংখ্যক লোকের অধিক সন্তুষ্টি বিধান করা’। যেহেতু অধিকসংখ্যক লোকের ভোট দিয়ে সরকার
গঠিত হয়, সেহেতু অধিকসংখ্যক লোকের
কল্যাণসাধন জনকল্যাণের মৌলনীতিকে একেবারে ম্লান করে দেয় না। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক
সরকারগুলো এতটুকু অন্তত করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে এ কথাও বলা
যায়, সামরিক শাসক ও সেনাসমর্থিত
কেয়ারটেকার সরকার গোষ্ঠিস্বার্থ সংরণে নিবেদিত ছিল বিধায় সামষ্টিক উন্নয়ন চরমভাবে
ব্যাহত হয়। আগামী দিনের বাংলাদেশে নতুন কোনো অসাংবিধানিক সরকার নতুন কোনো ফর্মে
আসবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
বিরোধী
দলের চাপে মতাসীন আওয়ামী লীগ যদি মতা ছেড়ে দেয়, তবে
কী অবস্থা দাঁড়াবে, তা অনেকের চিন্তার
বিষয়। বিএনপি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ কর্তৃক নির্যাতিত, জামায়াতের গায়ে দগদগে ঘা বিদ্যমান। প্রশাসন
একপ্রকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে। বিভিন্ন উৎস থেকে
জানা যায়, আওয়ামী লীগের ওপরের মহলের
একটি গ্র“প অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের
হাতে মতা হস্তান্তর করতে সম্মত। কিন্তু নেতৃত্বের বড় অংশই মতা হস্তান্তরে একেবারেই
রাজি নয়। কারণ তারা মনে করেন প্রতিকূল পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় বলি হবেন তারা।
বিদেশীদের মদদপুষ্ট বুর্জোয়া কোনো এলিট দিয়ে কোনো ‘পাপেট’ সরকার যেন এ দেশে গঠিত
না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা
দরকার। সব মহলকে এ বিষয়টি মাথায় নিতে হবে। সামরিক বাহিনী বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের
মতা গ্রহণে ব্রতী হবে না। কেননা দেশে দেশে সামরিক সরকারের বিচার সংঘটিত হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ পাকিস্তানের সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফের বিচারকার্যকে উপস্থাপন করা
যায়।
বাংলাদেশে
অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের এক একটি পরিণতি ল করা গেছে। আকাশসম
জনপ্রিয়তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনে
মতাসীন হলেও সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল কায়েম, সংসদীয় ব্যবস্থা বাতিল করে রাষ্ট্রপতির
হাতে একক মতা প্রদান, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
খর্বকরণ, রীবাহিনী গঠন ইত্যাদি তার
সপরিবারে নির্মম মৃত্যু ডেকে এনেছিল। ভোট কারচুপির নির্বাচনের জয়ের নায়ক জেনারেল
এইচ এম এরশাদকে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মতাচ্যুত হয়ে কারাবরণ করতে হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের
১৫ ফেব্র“য়ারির নির্বাচনের কোনো করুণ
পরিণতি ল করা না গেলেও পরবর্তী ভোটযুদ্ধে বিরোধী বলয়ের কাছে চরম পরাজয়ের মতো ঘটনা
ঘটেছিল বিএনপির। উল্লেখ্য, সেই নির্বাচনটি
সংবিধান মোতাবেক হয়েছিল। বর্তমান মতাসীন সরকারও ‘সংবিধান মোতাবেক’ নির্বাচন
অনুষ্ঠান করতে চাচ্ছে। এদেরও আবার কী পরিণতি বহন করতে হয়, কে জানে। বর্তমান সরকারের সংশোধিত সংবিধান
মোতাবেক নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে চাওয়া ১৯৯৬ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে বিএনপি সরকার কর্তৃক নির্বাচন
অনুষ্ঠানের প্রতিশোধ নয়তো? যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, প্রতিশোধের আগুনে জ্বলা মানসিকতা বিভিন্ন
দেশ ও জনপদকে ধ্বংস করেছে। আমাদের স্বদেশপ্রেমে উদ্বেলিত এবং দেশরার কারিগররূপী
রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিশ্চয়ই সেই পথে হাঁটবেন না। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সৎ ও সরলমনা
জনগণের প থেকে আশায় বুক বাঁধলাম।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন