শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৩

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ জন , প্রধানমন্ত্রীর আকর্ষণীয় নির্বাচনী উপহার


ইংরেজী ‘ডেইলী স্টার’ গতকাল দুটি রাজনৈতিক ভাষ্য ছেপেছে। একটি লিখেছেন পত্রিকাটির সম্পাদক মাহফুজ আনাম। আর একটি লিখেছেন ঐ পত্রিকার সাংবাদিক সাখাওয়াত লিটন। মাহফুজ আনামের লেখার শিরোনাম, PM’s gift: A voter-less election বাংলা অর্থ, “প্রধানমন্ত্রীর উপহার ঃ একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন” সাখাওয়াত লিটনের লেখার শিরোনাম Congratulations Sheikh Hasina,, বাংলায় অনুবাদ, “শেখ হাসিনা, আপনাকে অভিনন্দন” এরা দুজন যা লিখেছেন সে সব কথা এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে উথাল পাথাল করছে। তবে তারা সাধারণ মানুষের মনের কথা তাদের পত্রিকার মাধ্যমে ইংরেজী পড়–য়া পাঠক বৃন্দকে জানিয়ে দিয়েছেন।
 সাখাওয়াত লিটন লেখার শুরুতেই বলেছেন যে, ১৫৪ জন প্রার্থী, যারা আনুষ্ঠানিক ভাবে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন, তাদেরকে অভিনন্দন। কারণ তাদেরকে কোন বিরোধীতার সন্মুখীন হতে হয়নি। তারা প্রমাণ করেছেন যে, তারা সত্যিই জনগণকে ভালবাসেন! তাই যদি না হবে তাহলে কেউ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলো না কেন? যারা ও বা প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিল তারাও কেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ালো। যারা নির্বাচনে ভোট দেন তাদেরকে অনেক কষ্ট (?) করতে হয়! এই শীতকালে সাত সকালে উঠে চা নাস্তা অথবা পান্তা ভাত খেয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে তারা ভোট দেয়ার জন্য লাইনে খাড়া হন। সেখানে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। সেটা সাধারণত খোলা ফাঁকা মাঠ। এই শীতের মধ্যে ভোট দেয়ার জন্য তারা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে ভোট দিতে অনেক সময় লেগে যায়। কারণ তারা লাইনের অনেক পিছে পড়ে যান। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। তারপর বাসায় ফিরে চারটে ডাল ভাত বা নুন ভাত মুখে দিয়ে মাঠে যান, অথবা ফ্যাক্টরীতে যান, অথবা বাকি দিনটা শুয়ে বসে কাটান। শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন এই কারণেই যে, ১৫৪টি নির্বাচনী এলাকার ৫কোটিরও বেশি ভোটারকে ভোট দেয়ার কষ্ট (?) থেকে তিনি তাদেরকে মুক্ত করেছেন! এখন আর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার কষ্ট (?), খোলা মাঠে শীতের কষ্ট (?) এবং এক বেলা কাজ থেকে বিরত হওয়ার ক্ষতি (?) সহ্য করতে হবে না! যে সব নেতা ভোটারদের প্রতি এই বিরল অনুগ্রহ(?) বর্ষণ করেছেন ৫কোটি ভোটারের উচিত আওয়ামী লীগের ঐ সব নেতার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা।
 তবে প্রশ্ন থাকে যে, ভোট দানের এই কষ্ট (?) লাঘবের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা বৈষম্য করলেন কেন? এখনো বাকি রয়ে গেছে ১৪৬টি আসন। এই ১৪৬টি নির্বাচনী আসনের ভোটারদের কে তো ভোট দেয়ার জন্য যেতে হবে। তাদের এই কষ্ট (?) লাঘবের অন্য কোন ব্যবস্থা কি করা যেত না? একই দেশের ৯ কোটিরও বেশি ভোটার। তাদের কিছু সংখ্যককে আপনি ফেভার করবেন, আর কিছু সংখ্যককে ফেভার করবেন না, সেটা কি তাহলে বৈষম্য হয়ে গেল না? আর বৈষম্য যদি হয় তাহলে তো সেটা অসাংবিধানিক বা সংবিধান বিরোধী (?) হয়ে গেল। জনগণের ভোট দেয়ার দারুণ কষ্ট (?) যাতে লাঘব (?) করা যায় সেই জন্য সংবিধানে কি কোন অনুচ্ছেদ থাকা উচিত নয় (?)। তবে তাদের জন্য একটি সুসংবাদও রয়েছে। কাদেরকে তারা ভোট দেবেন সেটা নিয়ে তাদের বেশি মাথা ঘামাতে হবে না। কারণ যেটি লাউ, সেটিই কদু। ভোট নিয়ে কাড়াকাড়ি হবে আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাসদ ইনুর প্রার্থীর মধ্যে। এদের সব রসুনের গোড়া এক। কাজেই যাকেই তারা ভোট দেন না কেন ভোট তো শেষ মেষ রসুনের গোড়াতেই পড়বে।
দুই
 এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি বিশেষ কারণে বিশেষ ভাবে অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। আর প্রধান মন্ত্রী যে অভিনন্দন পাবেন সেই অভিনন্দন প্রাপ্তির জন্য তার বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কারণ তিনি যদি নির্বাচন বর্জন না করতেন তাহলে নির্বাচন উপলক্ষে হতো হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। তাহলে আর তারা ইলেকশন না করে এম পি হিসাবে আসমান থেকে নাজিল হতেন কিভাবে? ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী বেগম খালেদা জিয়া একতরফা নির্বাচন করেছিলেন। তখন এদেশের জনগণ সেই নির্বাচনকে মন থেকে গ্রহণ করতে পারেনি। তবে ঐ নির্বাচনের পক্ষে দুটি যুক্তি যথার্থ ছিল। একটি হলো সংবিধান মোতাবেক নির্বাচনের ধারাবাহিকতা রক্ষা। আর দ্বিতীয়টি হলো ১৫ই ফেব্রুয়ারী নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পার্লামেন্টে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস এবং জন দাবীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। এবার খালেদা বয়কট করায় হাসিনার লাভ হয়ে গেল। হাসিনা বয়কট করায় বেগম জিয়া ৪৯টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। কিন্তু এবার সেই সংখ্যা দেড় গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আর হাসিনা এবার খালেদার রেকর্ড ভাঙ্গলেন। হাসিনার সাফল্যের ব্যবধান ১০৫টি।
তিন
শেখ হাসিনা যদি এইবার চাইতেন তাহলে ৩০০টি আসনেই তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করতে পারতেন। হাসিনার নেতৃত্ব দিন দিন পোক্ত(?) হচ্ছে। কারণ ১৯৮৬ সালে তার দল পেয়েছিল ৭৬টি আসন। ১৯৯১ সালে পেয়েছিল ৮৮টি আসন। কিন্তু এবার তার দল পেয়েছে ১২৭টি আসন, এবং সবগুলি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। পাঠক, শেখ হাসিনা এবার ওয়াক ওভার পেতেন, যদি না তার দলের অনেক প্রার্থী প্রার্থীতা প্রত্যাহার না করতো। বলতেই হবে যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে এবার অপ্রতিদ্বন্দ্বী রূপ পেয়েছে। কন্যা মুজিব একটি ক্ষেত্রে পিতা মুজিবকেও হার মানিয়েছেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মরহুম শেখ মুজিবর রহমান। তার সময় মাত্র ১১জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু এবার ১১ জন নয় একেবারে ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, যার মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রয়েছেন ১২৭জন।
চার
ডেইলী স্টার সম্পাদক তার লেখার শুরুতেই এক ডাক্তারের গল্প বলেছেন। ঐ ডাক্তারের তরফ থেকে তার রুগীর পরিবারের কাছে একটি টেলিগ্রাম পাঠানো হয়। ঐ টেলিগ্রামে বলা হয়, “অপারেশন সফল! তবে অপারেশনের কিছুক্ষণ পরেই রোগী মারা গেছে”। শেখ হাসিনা ১০ম সংসদের যে নির্বাচন করছেন সেখানে প্রধান মন্ত্রী হিসাবে তিনি সফল। কারণ ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে। অবশিষ্ট ১৪৬টি আসনে নামকা ওয়াস্তে নির্বাচন হবে। তবে সেই গল্পের রোগীর মত ১০ম পার্লামেন্ট কতদিন টিকবে, সেটাই হলো বড় প্রশ্ন। ১০ম পার্লামেন্টের গঠন যখন সম্পূর্ণ হবে তখন শেখ হাসিনা একটি অনির্বাচিত পার্লামেন্টের সরকারি দলের নেতা হিসাবে তার ভাবমূর্তিকে মসিলিপ্ত করবেন। বাংলাদেশের মানুষ নির্ভেজাল স্বচ্ছ গণতন্ত্রের জন্য বহু বছর অক্লান্ত সংগ্রাম করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ, এবং সেই সুবাদে বাংলাদেশের মানুষ, উপনিবেশ বাদ থেকে মুক্তি লাভ এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ২শত বছর সংগ্রাম করেছে। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তান আমলে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশের মানুষ ২৪ বছর ধরে সংগ্রাম করেছে। তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এরশাদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ১দশক সংগ্রাম করেছে। ডেইলি ষ্টারের সম্পাদকের মতে আজ আমাদেরকে প্রশ্ন করতে হচ্ছে, আমরা কোন্ ধরনের শাসনের অধীনে আছি? আমরা কি গণতান্ত্রিক শাসনে আছি? নাকি নির্বাচিত এক নায়কতন্ত্রের অধীনে আছি?
প্রধানমন্ত্রীকে আরেকটি কারণেও অভিনন্দন (?) জানাতে হয়। এবারই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে কোন পর্যবেক্ষক আসছে না। একতরফা আসন্ন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন। শুক্রবার পর্যবেক্ষক না পাঠানোর এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ইইউ। সংস্থাটির পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রতিনিধি ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যাথরিন এস্টোনের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মনে করে যে বাংলাদেশে সরকার সকল দলের অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজন একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি সম্প্রতি জাতিসংঘের নেয়া উদ্যোগও ফলপ্রসূ হয়নি বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয় । এতে বলা হয়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক প্রেরণের বিষয়টি স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
চার
সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আগামী ২৬শে ডিসেম্বর থেকে সেনা বাহিনী নামানো হবে। সেনাবাহিনী সাধারণ ভাবে আগামী বছরের ৯ই জানুয়ারী পর্যন্ত মাঠে থাকবে। তবে চীফ ইলেকশন কমিশনার বলেছেন যে, ক্ষেত্র বিশেষে সেনাবাহিনীর অবস্থানে দু চার দিন হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটতে পারে। সেটি নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট এলাকার আইন শৃংখলা পরিস্থিতির ওপর।
সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে রাজনৈতিক মহলে অনুকূল প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় নাই। তাদের মতে আওয়ামী লীগ সরকার এবং নির্বাচন কমিশন সব সময় নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিরুদ্ধে ছিল। চলতি বছরের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জেলা প্রশাসকদের সভায় বলেছেন যে, আগামী নির্বাচনটি সেনাবাহিনী ছাড়াই অবাধ সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য তারা যেন প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহম্মেদও একাধিকবার নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন। তিনি বহুবার বলেছেন যে, আগামী সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের কোন পরিকল্পনা সরকারের নাই। যখন সেনা মোতায়েনের বিরুদ্ধে কথা বলা হয় তখন কিন্তু ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতি। তখন নির্বাচনে ১৮ দল সহ সমস্ত দলের অংশ গ্রহণের কথা ছিল। ফলে সেই নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। তেমন পরিস্থিতিতে বরং সেনাবাহিনী মোতায়েন আবশ্যকীয় ছিল। এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। নির্বাচনে ১৮ দল নাই। এমনকি জাতীয় পার্টিও নাই। নির্বাচনে আছে শুধু মাত্র আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাসদ (ইনু)। সেই নির্বাচনেও ১৫৪জন প্রার্থী ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের কোন প্রয়োজন নাই।
 তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে চলমান আন্দোলন নির্বাচন পর্যন্ত, এমনকি নির্বাচনের পরেও অব্যাহত থাকবে। সেই আন্দোলন দমনের অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করছে। এর ফলে জনগণ এবং সেনাবাহিনীর মুখোমুখী অবস্থানের একটি আশংকা রয়ে গেছে। এমন একটি অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে সেনা বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্তটি পূর্ণ বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads