মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৩
অদ্ভুত আঁধার এক নেমেছে এ দেশে
Posted on ৫:১৮ PM by Abul Bashar Manik
একটি পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠার খবর গত ২৮ নভেম্বর
: উপদেষ্টারা যেখানে মন্ত্রণালয়ের কোনো ফাইলেই স্বাক্ষর করতে পারেন না, সেখানে
পদত্যাগের মাত্র এক দিন আগে দুই উপদেষ্টা একটি প্রস্তাবের সারসংক্ষেপ তৈরি করে
প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন। অনুমোদিত সারসংক্ষেপটি গতকালই (২৭ নভেম্বর)
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সারসংক্ষেপটি পুলিশের সুযোগ-সুবিধা
বৃদ্ধিসংক্রান্ত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একে পুলিশের জন্য ‘নির্বাচনী’ প্যাকেজ
হিসেবে দেখছেন। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘সচিবালয়
নির্দেশমালা ও রুলস অব বিজনেসে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।’ অর্থাৎ, জেনেশুনেই
নীতিনির্ধারকপর্যায়ে সরকারি বিধিবিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে। তা-ও নির্বাচনে দলীয় ফায়দা
ওঠানোর সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে।
এখন নাকি ক্ষমতায় আছে ‘নির্বাচনকালীন
সরকার’। তফসিল ঘোষণার পর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার নিয়ম নেই। তা
কিন্তু এ সরকার মানছে না। নিজের করা নিয়ম নিজেই ভেঙে গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত
সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। প্রথম আলো জানিয়েছে, ‘এ প্রসঙ্গে নির্বাচনী দায়িত্বে সম্পৃক্ত
ব্যক্তিদের নানা সুযোগ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বদলি ও
পদায়ন করা হচ্ছে।’
‘সর্বদলীয়
সরকার’ নির্বাচনকালীন বলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেবে না এবং
কেবল রুটিন ওয়ার্ক করবে। এমন কথা ক্ষমতাসীন নেতানেত্রীরা বারবার বলে এলেও বাস্তবে
টিকফা চুক্তির মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজও করে ফেলেছে নিজেদের ওই ঘোষণা লঙ্ঘন
করে। এ দিকে কয়েকজন ‘ভারপ্রাপ্ত’ সচিবকে ‘ভারমুক্ত’ করে আরো ‘ভারী’ পদে উন্নীত করা হয়েছে। যখন প্রশাসনের
শীর্ষপর্যায়ে রদবদল, নিয়োগ-পদোন্নতির বিষয়টি রাজনৈতিক কারণে খুবই
স্পর্শকাতর ও তাৎপর্যপূর্ণ, তখনই এটা ঘটল। পত্রিকার রিপোর্টে জানা যায়, রাষ্ট্রপতির
১০ শতাংশ কোটায় পাঁচজন সচিব নিয়োগ দেয়া যায়। এ বিধান অমান্য করে এবার ছয়জনকে নিয়োগ
দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বহুলালোচিত সচিব, আইন
মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন নিয়ে বিতর্কিত একজন সচিব (অন্য একটি মন্ত্রণালয়ের) এবং
পুলিশের সাবেক একজন আইজি ও দু’জন এডিশনাল আইজি। বর্তমান সরকারসমর্থক একটি
পত্রিকা জানায়, জানুয়ারির মধ্যে অবসরে যাচ্ছেন সরকার সমর্থক কয়েকজন সচিব। তাদের অবসর
নেয়ার কথা গত বছর। অথচ তাদের ধরে রাখার জন্য সরকারি চাকুরেদের অবসর বয়সসীমা এক বছর
বাড়ানো হয়েছে। এখন ওই সচিবদের কয়েকজনকে চুক্তিতে সচিব পদে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সে জন্য শিথিল করা হয়েছে রাষ্ট্রপতির কোটা।
নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী প্রচারণার
পোস্টার তুলে ফেলা এবং বিলবোর্ড সরানোর নির্দেশ দিতে ঢিলেমির পরিচয় দিয়েছে। বলা
বাহুল্য, এসব পোস্টার, ব্যানার, বিলবোর্ড প্রায় সবই আওয়ামী লীগের। এ
ক্ষেত্রে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ঘোষিত সময়সীমা শেষ হওয়ার পরে গতকাল সোমবারও দেখা
গেছে, খোদ নির্বাচন কমিশন কমপ্লেক্সের পূর্ব দিকে সীমানা ঘেঁষে আওয়ামী লীগের
বিশাল বিলবোর্ড। নির্বাচন কমিশন ভবনের চার দিকের রাস্তা বন্ধ করে পুলিশ পাহারা; গেটে
ট্যাংকসদৃশ এপিসি যান। অথচ দলীয় প্রচারণার উপকরণ বহাল তবিয়তে। এর কারণ কমিশনের
ভীতি, নীতি না অন্য কিছু?
বাংলাদেশের রাজনীতিসহ জাতীয় জীবনে বাঙালি
বনাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এটা চলে আসছে, বলা
যায়, দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন থেকেই। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, প্রেসিডেন্ট
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর থেকে এই আদর্শের সমর্থক মহলে ভাঙন ধরানোর নানা প্রয়াস
শুরু হয়। নির্বাচিত বিএনপি সরকারকে সংবিধানবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক পন্থায় উৎখাত করে
ক্ষমতায় আসেন প্রধান সেনাপতি এরশাদ। তখন সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে এবং গোয়েন্দা
সংস্থার মাধ্যমে বিএনপির একটা গ্রুপকে মাঠে নামিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চলে।
কারণ এরা শহীদ জিয়ার আদর্শ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বলে নিজেদের তুলে
ধরছিল। কিছু দিন পরে বিএনপির এই অংশ, খন্দকার মোশতাকের ডেমোক্রেটিক লীগের একটা
বড় অংশ, আওয়ামী লীগ (মিজান)-এর একাংশ প্রভৃতি নিয়ে প্রথমে জনদল, পরে
জাতীয় পার্টি গঠিত হয়। এরশাদের রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে এর জন্ম। দলটিকে বাংলাদেশী
জাতীয়তাবাদের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে দেখানোর কৌশল চলে দেশীবিদেশী
ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষ থেকে। উদ্দেশ্য ছিল, বিএনপিকে দুর্বল করা। তবে বিশেষ করে, ১৯৯৬-এর
নির্বাচনের পর থেকে এরশাদ ও তার দলের আওয়ামীপন্থী ও ভারতবান্ধব অবস্থান জনগণের
সামনে স্পষ্ট। এতে জাপা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের ‘বি’ টিম
হিসেবেই নিজেকে কার্যত উপস্থাপন করে আসছে।
একইভাবে এবার বিএনপিতে ভাঙন ধরানোর জন্য
বিএনএফ নামে একটি নতুন সংগঠনকে ব্যবহার করার যথাসাধ্য প্রয়াস চালানো হয়েছে।
বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ। বিএনএফ চাইল গমের শীষ। এ দুটো দেখতে প্রায়
একই। রহস্যময় ক্ষুদ্র দলটির এই বৃহৎ দাবি থেকেই সবাই বুঝে যান, ‘দাল
মে সির্ফ কুছ নেহি, জিয়াদা কালা হ্যায়।’ এই
বিএনএফ সামনে রেখেছে অপরিচিত এক লোককে। সাথে আছেন বিএনপির একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রী
এবং জিয়া আমলের একজন উপমন্ত্রী। তারা বিএনপি ছেড়ে প্রথমে আরেক দল করেছিলেন। যা হোক
বিএনএফের মতো অখ্যাত দলের ঘোষণা, তারা সংসদের ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে। দেখা যাক, কী
অবস্থা দাঁড়ায়।
জাতীয় পার্টি জন্মগতভাবেই অস্বাভাবিক।
কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, এদল ক্ষমতার ভাগীদার হতে চাচ্ছে, ছিটেফোঁটা
পাচ্ছে। আবার ব্যাপক উপেক্ষা-বঞ্চনার কারণে আধা বিরোধী দলের ভঙ্গিতে কথা বলার
চেষ্টা করছে। গাছের ফল খাওয়া আর তলারটাও কুড়ানোÑ দুটোই করতে চাইলে আম ও ছালা দু’টিই
হারাতে হয়। বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে জাপা জাতীয় রাজনীতিতে অনেকটা !x-এর
মতো অবস্থানে ছিল। এবার নির্বাচন নিয়ে এরশাদ দুই রকম কথা বলায় ড. কামাল হোসেন তাকে
‘থুতু সাহেব’ অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, এরশাদ
একসাথে সরকারেও আছেন, বিরোধী দলেও আছেন। বিশ্বের ইতিহাসে এটা
নজিরবিহীন ঘটনা।’
জাপা মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার শেখ
হাসিনার ‘সর্বদলীয় সরকারে’ মন্ত্রী হয়েছেন। তবে বিরোধী দলের মতো নিজেও
এটাকে ‘সর্বদলীয়’ মনে করেন না। বলেছেন, এই সরকারে থাকলেও আমাদের অবস্থান হুবহু আওয়ামী
লীগের মতো নয়। হাওলাদার বলেছেন, জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের
মধ্যস্থতাকারী হবে। অর্থাৎ তাদের অবস্থান ‘মাঝামাঝি’। এমন দ্বৈত ভূমিকা পালনকারী দল আর কোনো
দেশে আছে কি না জানা নেই। মজার ব্যাপার হলো, মহাসচিব বর্তমান সরকারকে ‘সর্বদলীয়’ বলে
না মানলেও দলের চেয়ারম্যান এরশাদ এটাকে ‘সর্বদলীয়’ সরকার মনে করেন। ২৪ নভেম্বরের একটি
পত্রিকায় একই দলের দু’জনের এই দুই রকম বক্তব্য একই পৃষ্ঠায় ছাপা
হয়েছে।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী নয়, প্রতীক
দেখে ভোট দেয়ার আহ্বান এসেছে শীর্ষপর্যায় থেকে। প্রধানমন্ত্রীতনয়ও ভোটযুদ্ধে জয়
পেতে নৌকা মার্কা দেখে ব্যালটে সিল মারতে বলেছেন। আওয়ামী প্রতীকের ব্র্যান্ডিং
মূল্য আছে বলেও তিনি সম্প্রতি উল্লেখ করেছেন। এসব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, মানুষের
চেয়ে বস্তু বড় এবং দল জিতলে প্রার্থী নয়, তাদের প্রতীক দেশ চালাবে। কিন্তু মার্কার
চেয়ে মানুষ অনেক বড়। জনগণ মনে করে, প্রার্থী সৎ, যোগ্য, জনদরদি
ও দেশপ্রেমিক হলে যেকোনো দল তাদের প্রার্থীদের গুণগুলো তুলে ধরে ভোট প্রার্থনা
করে। আর যাদের প্রার্থীর যোগ্যতা ও সততার অভাব, যাদের প্রার্থী ভোটারদের আস্থাভাজন নন, তারাই
প্রার্থী বাছবিচার না করে বিশেষ কোনো মার্কায় সিল মারার কথা বলতে পারেন।
গত পাঁচ বছরে যেসব কাণ্ডকীর্তির রেকর্ড
ক্ষমতাসীনেরা গড়েছেন, এতে প্রার্থীদের অপেক্ষাকৃত সৎ ও যোগ্য হিসেবে তুলে
ধরা তাদের জন্য কঠিন। এ অবস্থায় কোনো স্পর্শকাতর জাতীয় ইস্যু ব্যবহার করে সহজ-সরল
সাধারণ মানুষের আবেগ উসকে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করবে ১৪ দল।
যা হোক, মাঝিমাল্লা কেমন দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য, তা
না দেখে নৌকাটা দেখেই ভোট দেয়ার আহ্বানে একজন কলামিস্ট লিখেছেন, ‘দলে
দলে কলাগাছে ভোট দিন’। মনে পড়ছে ১৯৭০ সালের কথা। আওয়ামী লীগের
তখনকার অন্যতম শীর্ষ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী। আমাদের ফেনী জেলায় অনুষ্ঠিত
জনসভায় মিজান চৌধুরী বলেছিলেন, ‘নৌকা প্রতীক নিয়ে কলাগাছ দাঁড়ালে তাকেও ভোট
দিতে হবে।’
রাজধানীর সব আসনেই ১৪ দল মনোনয়ন দিচ্ছে
বর্তমান এমপিদের। তাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধে বড় বড় অভিযোগ রয়েছে। তদুপরি তারা
ছিলেন দলীয় নেতাকর্মী থেকে বিচ্ছিন্ন। আমি যে এলাকায় থাকি, সেখানে
যিনি আওয়ামী এমপি, তার বাসা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দুটোই অন্য দু’টি
আসনের এলাকায়। তিনি এমপি হয়ে একটি স্বনামধন্য স্কুলের বহু শিক্ষককে চাকরিচ্যুত
করেছেন আওয়ামী লীগ সমর্থক নয় বলে। সে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে অনেক বেশি
শিক্ষার্থী। এর পেছনে মোটা অঙ্কের লেনদেনের কথা শোনা গেছে। সাংবাদিক লাঞ্ছনার
অভিযোগও রয়েছে এই এমপির নামে। এলাকার মানুষের কাছে তিনি বহিরাগত। তবু আবারো তিনি
পেলেন দলের মনোনয়ন।
সরকার সমর্থক ‘আমাদের
সময়’ পত্রিকায় শুক্রবার জানানো হয়েছে, ঢাকায় একজন মন্ত্রী ও একজন
প্রতিমন্ত্রীসহ আটজন এমপির বদলে কিন ইমেজের প্রার্থী সন্ধান করা হয়েছিল। তবে
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় পুরনোরাই দশম জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের
হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন।’ অর্থাৎ এসব জবরদস্ত আওয়ামী নেতানেত্রী আনকিন বা
কলঙ্কিত বলে দলই স্বীকার করে নিয়েছে। যে নির্বাচনে এমন প্রার্থীর ছড়াছড়ি, সেটা
কিন হয় কী করে?
পাদটীকা : বাল্টিক অঞ্চলের ুদ্র ইউরোপীয়
দেশ লাটভিয়া। সেখানে এবার একটি মার্কেট ধসে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি মারা গেছেন। এই
দুর্ঘটনার দায় পুরোটাই কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করেছেন সরকার প্রধান ভালদিস
দোমব্রোভস্কিস। আর আমাদের বাংলাদেশে জাতীয় জীবনে রাজনৈতিক মহা ধস নেমেছে। এতে এ
যাবৎ প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত কয়েক শ’ মানুষ। না, এখানে কেউ পদত্যাগ করেননি, তার
সম্ভাবনাও নেই। বরং এই অদ্ভুত দেশে পদত্যাগের চেয়ে নিজের দু’টি
পদকে ত্যাগ করা সহজ। আর কখনো যদি মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেনও, মন্ত্রিত্ব
তাদের ত্যাগ করে না।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন