রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৩

মন্ত্রীদের পদত্যাগ ও সর্বদলীয় সরকার , সংবিধান যা বলে .


ইকতেদার আহমেদ
একটি দেশের সরকারব্যবস্থা রাষ্ট্রপতিশাসিত বা সংসদীয় পদ্ধতির যা-ই হোক না কেন, উভয়ক্ষেত্রে মন্ত্রীদের নিয়োগ ও পদত্যাগ এবং মন্ত্রিসভার গঠন পদ্ধতি সংবিধানের বিধানাবলি দ্বারা নির্ধারিত। বিভিন্ন চড়াই-উৎরাইয়ের মাধ্যমে আমরা উভয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা দ্বারা শাসিত হয়ে এলেও ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে অদ্যাবধি নির্বাচনকালীন সময়ের তিনবারের স্বল্পকালীন তত্ত্বাবধায়ক এবং একবারের প্রায় দুই বছর মেয়াদের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসন ছাড়া সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা দ্বারা শাসিত হয়ে আসছি। 
সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা অনুসৃত হয় পৃথিবীর এমন সব দেশে প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধান কিন্তু সংসদীয় পদ্ধতির অন্যান্য দেশের সাথে আমাদের পার্থক্য হলো আমাদের এখানে সরকারের সব নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রযুক্ত হয়, যা অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে সরকার বা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রযুক্ত হয়। 
প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ এবং প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীর পদত্যাগ বিষয়ে স্বচ্ছ ও স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে হলে আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৫৮ এর বিধানাবলির প্রতি আলোকপাত আবশ্যক। 
অনুচ্ছেদ নং ৫৫ অবলোকনে প্রতীয়মান হয়Ñ এ অনুচ্ছেদটির দফা (১), (২) ও (৩) এ পর্যায়ক্রমিকভাবে বলা হয়েছে (১) প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি মন্ত্রিসভা থাকবে এবং প্রধানমন্ত্রী ও সময়ে সময়ে তিনি যে রূপ স্থির করবেন, সে রূপ অন্যান্য মন্ত্রীর সমন্বয়ে এ মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। (২) প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তার কর্তৃত্বে এ সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হবে। (৩) মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের কাছে দায়ী থাকবে। 
অনুচ্ছেদ নং ৫৬ এর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, এ অনুচ্ছেদটির দফা (১), (২) ও এর শর্তাংশে এবং (৩) ও (৪) এ পর্যায়ক্রমিকভাবে বলা হয়েছে (১) একজন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন এবং প্রধানমন্ত্রী যে রূপ নির্ধারণ করবেন, সে রূপ অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী থাকবেন। (২) প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করবেন; তবে শর্ত থাকে যে, তাদের সংখ্যার অন্যূন নয়-দশমাংশ সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে নিযুক্ত হবেন এবং অনধিক এক-দশমাংশ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের মধ্য থেকে মনোনীত হতে পারবেন। (৩) যে সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন বলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতীয়মান হবেন, রাষ্ট্রপতি তাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন, (৪) সংসদ ভেঙে যাওয়া এবং সংসদ সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে এ অনুচ্ছেদের (২) বা (৩) দফার অধীন নিয়োগ দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে সংসদ ভেঙে যাওয়ার অব্যবহিত পূর্বে যারা সংসদ সদস্য ছিলেন, এ দফার উদ্দেশ্য সাধনকল্পে তারা সদস্যরূপে বহাল রয়েছেন বলে গণ্য হবেন। 
অনুচ্ছেদ নং ৫৭ প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ সংক্রান্ত। এ অনুচ্ছেদটি (১), (২) ও (৩) এ তিনটি দফা সমন্বয়ে গঠিত। এ তিনটি দফায় পর্যায়ক্রমিকভাবে বলা হয়েছে- (১) প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হবে যদিÑ (ক) তিনি কোনো সময় রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করেন; অথবা (খ) তিনি সংসদ সদস্য না থাকেন। (২) সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করবেন কিংবা সংসদ ভেঙে দেয়ার জন্য লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শদান করবেন এবং তিনি অনুরূপ পরামর্শদান করলে রাষ্ট্রপতি, অন্য কোনো সংসদ সদস্য সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন নন এ মর্মে সন্তুষ্ট হলে, সংসদ ভেঙে দেবেন। (৩) প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে নিজ পদে বহাল থাকতে এ অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই অযোগ্য করবে না। 
অনুচ্ছেদ নং ৫৮ অন্যান্য মন্ত্রীর পদ অর্থাৎ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী সংক্রান্ত। এ অনুচ্ছেদটিতে পাঁচটি দফা রয়েছে। দফা নং (১), (২), (৩) ও (৪) এ পর্যায়ক্রমিকভাবে বলা হয়েছে- (১) প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো মন্ত্রীর পদ শূন্য হবে যদিÑ (ক) তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র প্রদান করেন; (খ) তিনি সংসদ সদস্য না থাকেন, তবে ৫৬ অনুচ্ছেদের (২) দফার শর্তাংশের অধীনে মনোনীত মন্ত্রীর ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে না; (গ) এ অনুচ্ছেদের (২) দফা অনুসারে রাষ্ট্রপতি অনুরূপ নির্দেশদান করেন; অথবা (ঘ) এ অনুচ্ছেদের (৪) দফায় যে রূপ বিধান করা হয়েছে তা কার্যকর হয়। (২) প্রধানমন্ত্রী যেকোনো সময় কোনো মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করতে পারবেন এবং ওই মন্ত্রী অনুরোধ পালনে অসমর্থ হলে তিনি রাষ্ট্রপতিকে ওই মন্ত্রীর নিয়োগ অবসান ঘটানোর পরামর্শদান করতে পারবেন। (৩) সংসদ ভেঙে যাওয়া অবস্থায় যেকোনো সময় কোনো মন্ত্রীকে নিজ পদে বহাল থাকতে এ অনুচ্ছেদের (ক), (খ) ও (ঘ) উপদফার কোনো কিছুই অযোগ্য করবে না। (৪) প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে বা নিজ পদে বহাল না থাকলে মন্ত্রীদের প্রত্যেকে পদত্যাগ করেছেন বলে গণ্য হবে; তবে এ পরিচ্ছেদের বিধানাবলি সাপেক্ষে তাদের উত্তরাধিকারীরা কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তারা নিজ নিজ পদে বহাল থাকবেন। 
উপরিউক্ত বিধানাবলি পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর পদ এবং একজন মন্ত্রীর পদ শূন্য হওয়ার ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। একজন মন্ত্রীর পদ তিন ভাবে শূন্য হতে পারে। এর একটি হলোÑ তিনি যদি রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করার নিমিত্ত প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র প্রদান করেন এবং অপর দুটির প্রথমোক্তটি হলো তিনি যদি সংসদ সদস্য না থাকেন আর শেষোক্তটি হলো প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের অনুরোধ রক্ষা না করায় রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তার নিয়োগের অবসান ঘটানো। 
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র প্রদান করলে অথবা সংসদ সদস্য না থাকলে অথবা সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালে তার পদ শূন্য হবে। তবে প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হওয়ার ক্ষেত্রে তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি নিজ পদে বহাল থাকবেন। অনুরূপভাবে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে তার মন্ত্রিসভার অপর সব মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন বলে গণ্য হবে কিন্তু তাদের ক্ষেত্রেও তাদের উত্তরাধিকারীরা কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তারা নিজ নিজ পদে বহাল থাকবেন। 
প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীরা সাংবিধানিক পদধারী। তাদের নিয়োগপরবর্তী শপথ গ্রহণ ব্যতিরেকে তাদের নিয়োগ কার্যকর হয় না এবং তারা পদে আসীন হন না। মন্ত্রীদের সরকারি চাকরিজীবীদের মতো পদে যোগদানের সময় যোগদানপত্র প্রদান করতে হয় না। 
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার সব সদস্য একযোগে তার কাছে পদত্যাগপত্র দাখিল করায় বিতর্ক দেখা দিয়েছে দাখিলপরবর্তী তাদের নিজ নিজ মন্ত্রী পদ শূন্য হয়েছে কি হয়নি? এ বিষয়ে প্রধামন্ত্রীসহ তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষা অনুযায়ী তারা পদত্যাগের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন এবং অভিপ্রায় ব্যক্তসংক্রান্ত পত্রে তারিখ উল্লেখ না থাকায় প্রধানমন্ত্রী যতক্ষণ পর্যন্ত না পদত্যাগপত্রগুলো কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ না করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজ পদে বহাল থাকবেন এবং তাদের পদও শূন্য হবে না। অপর দিকে একই বিষয়ে দেশের অধিকাংশ আইনজ্ঞের ভাষ্যÑ একজন মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষা বা নিজ ইচ্ছা থেকে যে মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার পদত্যাগপত্র প্রদান করেন সে মুহূর্ত থেকেই তার পদটি শূন্য হয়ে যায় এবং শূন্য হওয়া পরবর্তী কোনো পদত্যাগী মন্ত্রী যদি নিজের আগের দায়িত্ব চালিয়ে যান অথবা আগের মতো সরকারের কাছ থেকে মন্ত্রী হিসেবে সুযোগ-সুবিধা নেয়া অব্যাহত রাখেন তবে সে ক্ষেত্রে এটি সংবিধানে নবসন্নিবেশিত ৭ক (১) (খ) এর বিধানাবলির আলোকে একজন ব্যক্তি কর্তৃক অসাংবিধানিক পন্থায় এ সংবিধান বা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করার শামিল, যা রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে গণ্য এবং তার সহযোগীও রাষ্ট্রদ্রোহের সমঅপরাধে অপরাধী। আমাদের প্রচলিত আইনে রাষ্ট্রদ্রোহের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিন্তু সংবিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহতের ক্ষেত্রে সংবিধানে বলা হয়েছে অপরাধী প্রচলিত আইনের সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। 
আইনজ্ঞরা আরো বলেন, একজন সাধারণ পদধারী সরকারি কর্মকর্তা এবং সাংবিধানিক পদধারী মন্ত্রীর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একজন মন্ত্রী শপথ গ্রহণ করাকালীন অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ব্যক্ত করেন যে, তিনি সংবিধানের রক্ষণ, সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবেন। তাই সংবিধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনার আলোকে একজন মন্ত্রী পদত্যাগের উদ্দেশ্যে বা অভিপ্রায় ব্যক্ত করে যা-ই বলা হোক না কেন, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রদানের নিমিত্ত প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র হস্তান্তর করা মানেই পদ শূন্য হয়ে যাওয়া এবং স্বপঠিত শপথ থেকে অবমুক্ত হয়ে যাওয়া। তা ছাড়া সব মন্ত্রী যখন প্রকাশ্যে একে একে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দাখিল করেছেন এবং পদত্যাগের বিষয়টি ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার বদৌলতে দেশবাসী জানতে পেরেছে সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষায় পদত্যাগের অভিপ্রায় ব্যক্ত বা পদত্যাগপত্রে তারিখ উল্লেখ না থাকা বা রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তরের নিমিত্ত প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দেয়া হয়নি এসব প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। এখানে আরো প্রাসঙ্গিক যে, পদত্যাগী মন্ত্রীদের মধ্যে অন্তত পাঁচজন যাদের দু-একজন প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ তারা তাদের পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তরপরবর্তী তাকে কদমবুচি করেছেন। এখন প্রশ্ন কদমবুচি কখন ও কাকে করা হয়? আমরা সচরাচর দেখে আসছি, কোনো ব্যক্তির আগমন ও প্রত্যাবর্তনের সময় কনিষ্ঠরা বয়োজ্যেষ্ঠদের কদমবুচি করে থাকেন। তা ছাড়া কেউ যদি শুভ সংবাদ পায় বা কোনো কাজে সফলতা পায় সে ক্ষেত্রেও দেখা যায় কনিষ্ঠরা বয়োজ্যেষ্ঠদের কদমবুচি করছেন। আমরা ইতঃপূর্বেও প্রত্যক্ষ করেছি আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তার দলের কতিপয় সংসদ সদস্যকে যখন মন্ত্রী পদ দ্বারা পুরস্কৃত করেন তখন শপথ গ্রহণপরবর্তী তারা প্রধানমন্ত্রীকে কদমবুচি করেছিলেন। আলোচ্য ক্ষেত্রে কতিপয় মন্ত্রী কর্তৃক পদত্যাগপত্র দাখিলপরবর্তী প্রধানমন্ত্রীকে কদমবুচি করা পদত্যাগের বার্তাবহ নয় কি? 
সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে চাকরির সময়সীমা ২৫ বছর অতিক্রম করলে তারা স্বেচ্ছায় অবসরের জন্য আবেদন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে একজন সরকারি কর্মকর্তা তার চাকরির বয়স ২৫ বছর হওয়া সাপেক্ষে একবার যদি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনপত্র দাখিলের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন সে ক্ষেত্রে তার পক্ষে পরে এ অভিপ্রায় প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ থাকে না। 
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পদত্যাগপত্রে তারিখ উল্লেখ থাকুক বা না থাকুক যে মুহূর্তে একজন মন্ত্রী সে দেশের সংবিধান অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তার পদত্যাগপত্র পেশ করেন এবং পেশের বিষয়টি প্রকাশ্যে ঘটে থাকে সে মুহূর্ত থেকে তার পদটি শূন্য হয়ে যায় এবং এ ক্ষেত্রে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারেরও কোনো সুযোগ থাকে না। তাই সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার যেসব মন্ত্রী গত ১১ নভেম্বর মন্ত্রিসভার সাপ্তাহিক বৈঠকপরবর্তী সচিবালয়ে তার কাছে পদত্যাগপত্র হস্তান্তর করেছেন তা হস্তান্তরপরবর্তী কার্যকর হয়ে গেছে। এখানে তাদের অভিপ্রায় কী ছিল এবং পদত্যাগপত্রে তারিখ ছিল কি ছিল নাÑ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দৃষ্টান্ত অবলোকনে প্রতীয়মান হয় এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপনের কোনো সুযোগ নেই। 
এখন দেখা যাক মন্ত্রিসভা বিষয়ে আমাদের সংবিধানের বর্তমান অবস্থান কী এবং সংবিধানের বর্তমান বিধানাবলির আলোকে সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের সুযোগ কতটুকু? 
প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৫৬(৩), ৫৬(১) ও ৫৫(১) প্রাসঙ্গিক। অনুচ্ছেদ নং ৫৬(৩) এ সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, যে সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন বলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতীয়মান হবেন, রাষ্ট্রপতি তাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন। অনুচ্ছেদ নং ৫৬(১) ও ৫৫(১) একটি অপরটির পরিপূরক। এর প্রথমোক্তটিতে বলা হয়েছেÑ একজন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন এবং তিনি যেরূপ নির্ধারণ করবেন সেরূপ অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী থাকবেন। শেষোক্তটিতে বলা হয়েছে- প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা থাকবে এবং তিনি যেরূপ স্থির করবেন সেরূপ মন্ত্রীসহকারে এ মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। 
উপরিউক্ত অনুচ্ছেদ দুটির তিনটি দফা সম্মিলিতভাবে অধ্যয়ন করলে যে চিত্রটি আমাদের কাছে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে তা হলোÑ যে সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতীয়মান হবেন তাকে ছাড়া অন্য কাউকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগদানের সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতি তার অন্য সব কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী সম্পাদন করে থাকেন। তাই মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের ব্যত্যয়ে রাষ্ট্রপতি তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো সংসদ সদস্যকে বা সংসদ সদস্য বহির্ভূত কোনো ব্যক্তিকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের ক্ষমতা ভোগ করেন না। 
সংসদীয় গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয় এবং দলীয় ব্যক্তিই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন হওয়া সাপেক্ষে নিয়োগ লাভ করেন। সংসদ নির্বাচনে কোনো দল সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে সে দলের যৌথ সরকার (কোয়ালিশন গভর্নমেন্ট) গঠনের কোনো অবকাশ থাকে না। আর যৌথ সরকারের ক্ষেত্রে যে কটি দল সমন্বয়ে যৌথ সরকার গঠিত হয় সে দলগুলোর বাইরে অন্য কোনো দলের সংসদ সদস্যকে মন্ত্রী নিয়োগের সুযোগ নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রের মাহাত্ম্য হলোÑ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। সংসদীয় গণতন্ত্রের আবরণে যদি কখনো কোনো দেশে সর্বদলীয় সরকার গঠন করা হয় তবে সে ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের কোনো অবকাশ থাকে না। আমাদের সংবিধানের যে অভিপ্রায় তাতে সর্বদলীয় সরকারের কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। যদি কখনো জাতির ক্রান্তিলগ্নে বা জাতীয় প্রয়োজনে সর্বদলীয় সরকার গঠনের আবশ্যকতা অনুভূত হয় তাতে বর্তমান সংসদের ক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া সেটিকে সর্বদলীয় সরকার বলার সুযোগ আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। তা ছাড়া এ ধরনের সর্বদলীয় সরকার আমাদের বর্তমান সংবিধানের যে চেতনাবিরোধী তা সংবিধানের পূর্বালোচিত বিধানাবলি থেকে স্পষ্ট। তাই বিগত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় যেসব দল জোটবদ্ধভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছিল সেসব দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্য সমন্বয়ে গঠিত সরকার কোনোভাবেই সর্বদলীয় সরকারের ধারণাকে আকৃষ্ট করে না। 
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট প্রতিভাত মন্ত্রীরা সম্মিলিতভাবে যেভাবে পদত্যাগ করেছেন তাতে তাদের সবার পদ শূন্য হয়ে গেছে এবং শুধু আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সংসদ সদস্যদের নিয়ে যেভাবে সর্বদলীয় সরকার গঠন করা হয়েছে তা কোনোভাবেই সর্বদলীয় হিসেবে বিবেচিত হওয়ার অবকাশ সৃষ্টি করে না। তাই পদত্যাগী মন্ত্রীদের পুনঃশপথ গ্রহণ ব্যতিরেকে মন্ত্রী পদে অব্যাহত থাকা এবং প্রধান বিরোধীদলের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে মন্ত্রিসভাকে সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা আখ্যা দেয়ায় যে সাংবিধানিক সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে তা বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা ক্ষমতার আধিক্য উপেক্ষা করলেও ভবিষ্যতে যে শত প্রশ্নের জন্ম দেবে না সে নিশ্চয়তা কি দেয়া যায়? 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads