বুধবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৩

সুশাসন এখন স্বপ্নের বিষয়



সমাজে বসবাসের একটা লক্ষ্য থাকে, সুন্দর সমাজের জন্য কিছু নিয়ম-কানুন পালন করতে হয়, মূল্যবোধও লালন করতে হয়। কিন্তু এসব কিছু থেকে আমাদের সমাজ যেন মুক্ত হযে গেছে। এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন সমাজের অধিপতিগণ এবৎং রাজনীতির নায়কগণ। সাধারণ শিষ্টাচারও এখন নির্বাসিত হতে চলেছে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে। নিজ মতের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে কিংবা নিজের পক্ষ অবলম্বন না করলে মুহূর্তেই পরম বন্ধু বিবেচিত হয় চরম শত্রু হিসেবে। এমন পরিবেশকে কি গণতান্ত্রিক পরিবেশ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়? এরপরও আমাদের রাজনীতিবিদরা নিজেদের গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে কতভাবেই না বর্ণনা করে থাকেন। অথচ প্রতিদিনই আমাদের রাজনীতিবিদদের আচরণে গণতন্ত্র লাঞ্ছিত হচ্ছে, জনমনেও শঙ্কা বাড়ছে। মানুষ এ বিষয়টি ভালভাবেই উপলব্ধি করেছে যে, গণতন্ত্র আসলে উচ্চারণের বিষয় নয়, আচরণের বিষয়। বিগত বছরগুলোতে মানুষ আরো উপলব্ধি করেছে যে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেই সরকার গণতান্ত্রিক হয়ে যায় না। গণতন্ত্র আসলে একটি সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের নাম, যা থেকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির নেতা-কর্মীরা এখনো বহু দূরে অবস্থান করছেন।
আমাদের রাজনীতি থেকে যে গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার লোপ পেতে বসেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক এক সাংবাদিক সম্মেলনেও। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির পক্ষে যুগ্মসাধারণ সম্পাদক এক লিখিত বক্তব্যে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবিএম মূসাকে মানসিক ভারসাম্যহীন ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। গত রোববার চ্যানেল আই-এর টকশোতে প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা মাহবুব উল আলম হানিফের বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাকে বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, তাহলে বঙ্গবন্ধু আমাকে এমপি বানালেন কেন? বিটিভির মহাপরিচালক করলেন কেন? সবচেয়ে বড় কথা, এ সরকারের আমলা শেখ হাসিনা আমাকে বিদেশ সফরে নিয়ে গেলেন কেন? একজন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী লোককে একুশে পদক কেন দেয়া হলো? মজার ব্যাপার, আমি নাকি টেলিভিশন চ্যানেল চেয়ে পাইনি বলে আওয়ামী বিরোধী কথাবার্তা বলছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আর্থিক সুবিধাই যদি নেব তাহলে টেলিভিশন কেন, একটা কুইক রেন্টাল নিলেই তো বেশি আয় করতে পারতাম। যারাই বর্তমান সরকারের সমালোচনা করছেন তাদেরই চরিত্র হনন চলছে। আমার বেলায় একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে অথচ এক-এগারোর পর শেখ হাসিনা দেশে না ফেরায় নেতা-কর্মীরা যখন হতাশ তখন আমিই তাকে ফোন করে দেশে আসতে বলেছিলাম। খোঁচা মেরে বলেছি, তুমি ওখানে বসে আছ তোমার দলতো শেষ হয়ে যাচ্ছে। এক-এগারোর পরে মাইনাস টু ফর্মুলার বিপক্ষে সবচেয়ে বেশি লিখেছি আমি। কারণ শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার যে ফর্মুলা ছিল, কোথায় পরিকল্পনা হতো সে খবর আমি রাখতাম। জেনারেল মইনের সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করেছি আমি। সে আমারই চরিত্র হনন শুরু হয়েছে। যে বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে মাহবুব উল আলম হানিফ সংবাদ সম্মেলন করেছেন সে প্রসঙ্গে এবিএম মূসা বলেন, আমি শেখ মুজিবকে তৃতীয় সারির নেতা বলেছি, তাও বলেছি তরুণ শেখ মুজিবর রহমানের কথা। তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি। বলেছি প্রথম সারিতে মাওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, দ্বিতীয় সারিতে আবদুস সালাম খান, আতাউর রহমান খান প্রমুখ এবং যুব সমাজের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন তৃতীয় সারিতে। কিন্তু নিজস্ব নেতৃত্বের গুণে, ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় তিনি দ্বিতীয় সারির নেতাদের ডিঙ্গিয়ে প্রথম সারিতে উঠে আসেন। ৬ দফা দেন। কিন্তু কিছু পত্রিকায় ‘সারিকে' ‘শ্রেণী' বলে, পূর্বাপর সম্পর্ক ঠিক না রেখে সংবাদ প্রকাশ করায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে এর ভিত্তিতে আমাকে মুজিব বিদ্বেষী, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ও মানসিক ভারসাম্যহীন বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব উল আলম হানিফের বক্তব্য ও সাংবাদিক এবিএম মূসার জবাব থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো, আমাদের সমাজে এখনও গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটেনি। অন্ধ দলপূজা, ব্যক্তিপূজাই এখানে প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। এ কথার অর্থ আবার এই নয় যে, যার যে মর্যাদা প্রাপ্য আমরা দেব না। কিন্তু ইতিহাসের আলোকে কেউ কোনো সময়ের বা বিষয়ের বিশ্লেষণ করতে চাইলে কিংবা কারো কোন সমালোচনা করলে তা শোনার মত ধৈর্য আমাদের থাকবে না কেন? ধৈর্য নিয়ে শোনার সক্ষমতা অর্জন করলে কোন বক্তব্যের কিংবা ভুল মন্তব্যের সঙ্গত জবাব দেয়া সহজ হয় কি? গণতান্ত্রিক সক্ষমতা অর্জিত না হলে মানুষ কোনো ভিন্ন মতের জবাব দিতে গিয়ে মানুষের চরিত্র হননে প্রবৃত্ত হয়। এমন আচরণ জনসমর্থন থেকে বঞ্চিত হয় এবং চরিত্র হননকারীর ইমেজও ক্ষুণ্ণ হয়। যেমনটি লক্ষ্য করা গেছে আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব-উল-আলম হানিফের ক্ষেত্রে।
গণতান্ত্রিক রাজনীতির কথা, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের কথা বলছিলাম। এসব বিষয়ে আমরা অগ্রসর হতে পারিনি বলেই দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি আইনের শাসন। সুশাসন এখনও আমাদের স্বপ্নের বিষয়। এ কারণেই পত্রিকায় শিরোনাম হয়, ‘নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করার পরেই ছাত্র খুন'। গত মঙ্গলবার এমন শিরোনামে প্রকাশিত খবরটিতে বলা হয় নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়রী (জিডি) করার দেড় ঘণ্টা পরেই খুন হলো কলেজ ছাত্র নূরুল আমীন সুহেল। এই ঘটনায় উত্তেজিত জনতা ঘাতকের গাড়ি ও বাড়িতে আগুন দিয়েছে। নিহত নূরুল আমিন সিলেটের মোগলবাজার থানার বাসিন্দা ও মদনমোহন কলেজের বিএ অনার্সের ছাত্র। গত রোববার ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত রোববার এলাকার রফিক বক্স সুহেলের একটি মোরগ ধরে নিয়ে যায়। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হলে রফিক বকস ও তার স্ত্রী সুহেলের বাড়িতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে এবং দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। এ ঘটনায় সুহেল নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করে। এর প্রায় দেড় ঘণ্টা পর রাত ৮টার দিকে সুহেল এশার নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার পথে রফিক বকস ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তাকে গুরুতর আহত করে। হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আমাদের এই গণতান্ত্রিক (!) সমাজে কথা কাটাকাটির জের ধরে একজন মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এমন ঘটনায় মনুষ্যত্বের অবনতির সাথে সাথে আইনশৃক্মখলা পরিস্থিতির অবনতির চিত্রও লক্ষ্য করা যায়। নিহত সুহেল নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করলেও পুলিশ তাকে রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। ফলে তাকে প্রাণ হারাতে হলো। আর আশঙ্কার বিষয় হলো, দেশে সরকার ও থানা-পুলিশ থাকার পরও কোনো মানুষকে হত্যা করতে এখন ঘাতকরা মোটেও কুণ্ঠিত নয়। থানা-পুলিশকে ঘাতকরা এতটা অবজ্ঞা করে কীভাবে? এর কারণ বিশ্লেষণ করলে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক বিষয় উঠে আসে। আসলে পুলিশ যখন আইন-শৃক্মখলা রক্ষা তথা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের বদলে বিরোধীদলকে অবদমনে সরকারের পেটোয়া বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন আর জনগণের জানমালের নিরাপত্তা থাকে না। কোনো দেশের পুলিশ মূল কাজের বদলে অন্য কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লে আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতি রক্ষিত হবে কেমন করে?
পুলিশকে আজকাল পেশাগত দায়িত্ব পালনের চাইতে রাজনৈতিক কর্তব্য পালনে বেশি তৎপর দেখা যায়। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যেও তেমন চেতনার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। বিরোধী দলের চিফ হুইপকে পেটানোর কারণে যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রেসিডেন্ট পদক দেয়া হয়, তাহলে পুলিশকে রাজনীতিককরণের আর কিছু বাকি থাকে কী? সরকারের এমন চেতনা এবং পুলিশের এমন আচরণ দিয়ে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা তো সম্ভব নয়। বিষয়টি ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের ঐতিহ্যবাহী পুলিশ বাহিনীকে পেশাগত দায়িত্ব পালনের বদলে যেন বিশেষ এক রাজনৈতিক ঘোরের মধ্যে রাখার চেষ্টা চলছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যের পর ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের গত সোমবারের বক্তব্যে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারের সামনেই শিবির কর্মীদের দেখামাত্র পুলিশকে গুলী করার নির্দেশ দিলেন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ। একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার এমন নির্দেশে বিস্মিত হয়েছেন নাগরিক সমাজ। শিবিরের কর্মীরা যদি আইন-শৃক্মখলা বিরোধী কোনো কাজ করে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে তো আইনসিদ্ধ পদক্ষেপ নিতে পারে দেশের পুলিশ প্রশাসন। কিন্তু শিবির কর্মীদের দেখামাত্র গুলী করার নির্দেশ কি দেশের কোনো আইনের মধ্যে পড়ে? আইনের মানুষরাই যদি এমন বেআইনী কথা বলেন, তাহলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে কেমন করে? ডিএমপি কমিশনার যে বক্তব্য রেখেছেন তা কোনো রাজনৈতিক কর্মীর মুখেও শোভা পায় না। জানি না আমাদের মন্ত্রীমন্ডলী তথা সরকার বাহাদুরের দায়িত্ব গ্রহণকালীন শপথের কথা মনে আছে কিনা! তারা তো এই মর্মে শপথ নিয়েছিলেন যে, অনুরাগ কিংবা বিরাগের বশবর্তী হয়ে তারা কোনো কাজ করবেন না। কিন্তু এখন তো তাদের এবং তাদের আজ্ঞাবহ প্রশাসনের আচরণে অনুরাগ ও বিরাগের বিষয়ই প্রবলভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শপথ ভঙ্গ করে কোনোদিন সফল হওয়া যায় না, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বিষয়টি তারা উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads