শনিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৩

আতংকিত জনপদে দানব রুপে ছাত্রলীগ !


আবুল বাসার মানিক ,মন্ট্রিয়ল,কানাডা।


স্বাধীনতা-উত্তর ছাত্রলীগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এমন অপকর্ম নেই যা তারা করতে পারে না। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত তারা ব্যাংক ডাকাতি, সন্ত্রাস, খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, গুদাম লুটসহ সব অপকর্ম করেছিল। আওয়ামী ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের ক্ষতচিহ্ন এখনো বহন করে চলেছেন মহাজোট শরীক, জাসদের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী শরীফ নুরুল আম্বিয়া। ১৯৭৩ সালে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন শরীফ নুরুল আম্বিয়া আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আ ফ ম মাহবুবুল হক (বর্তমানে গুরুতর অসুস্থ) তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনের সামনে থেকে অপহরণ করে উইলি জিপে তুলে নিয়ে যায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন, ছাত্রলীগের ক্যাডারেরা। তাদের ওপর ওরা ব্যাপক নির্যাতন চালায়, যার পরিণতিতে সারা জীবনের জন্য শরীফ নুরুল আম্বিয়ার একটি হাত অকেজো হয়ে যায়। একই সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে জাসদ ছাত্রলীগের নেতা মিয়া মোশতাক আহমদকে (সরকারের অস্কারপ্রাপ্ত সচিব) থাপ্পড় মেরে নিচতলার মাটিতে ফেলে দেন তখন যিনি অনেকের ভাষায়, রাজপুত্র। ১৯৭৩ সালে ডাকসু নির্বাচনে ভরাডুবি দেখে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নির্বাচন পণ্ড করে দেয় এই ছাত্রলীগ। ডাকসু নির্বাচনে জাসদ ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী আ ফ ম মাহবুবুল হকের মাহবুব-জহুর প্যানেলের কাছে তৎকালীন মুজিববাদী ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের লেনিন-গামা প্যানেল বিপুল ভোটে পরাজয় দেখে খুব বড় নেতার পুত্রের নেতৃত্বে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ডাকসু নির্বাচন বানচাল করে দেয়। ১৯৭৪ সালে মুজিববাদী ছাত্রলীগের খুব বড় নেতার কোন্দলে সূর্য সেন হলে নাজমুল হক কোহিনূরসহ সাত ছাত্রকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়, যা সারাবিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের এসব অপকর্মের ফলে তখন সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পঁচানব্বই শতাংশ ছাত্র সংসদে নির্বাচিত হয়েছিল সরকারবিরোধী জাসদ ছাত্রলীগ। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ আবারো ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ছাত্রলীগের পুরনো আতঙ্ক আবারো বাংলাদেশের জনগণের সামনে হাজির হয়। সে সময় ছাত্রলীগের ক্যাডারদের মাত্র দুটো ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাডারের ছাত্রী ধর্ষণের সেঞ্চুরি ঘটা করে পালন করা হয়, যা দেশের বিবেকবান মানুষের অন্তরে ব্যাপক রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করে। অন্য ঘটনাটি হলো ইংরেজি নববর্ষের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তরুণী বাঁধনের ওপর ছাত্রলীগ ক্যাডারদের পাশবিক নির্যাতন, যা দেশের বাইরে আমাদেরকেও আলোড়িত করে।

অসীম প্রতাপ নিয়ে ছাত্রলীগ যমের ভূমিকায় ছিল ২০১২ সালে। বছরটি শুরু হয় নিজ সংগঠনের সদস্য যুবায়েরকে হত্যা করে। ছাত্রলীগ ভিসি গ্রুপের তাড়া খেয়ে যুবায়ের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসছাড়া হন। সেই ভিসি শরীফ এনামুলের কাছ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেয়েই ৮ জানুয়ারি পরীক্ষা দিতে ক্যাম্পাসে ঢোকেন। সতীর্থরা কুপিয়ে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে হত্যা করে প্রমাণ করল ভিসি নন, ছাত্রলীগই ক্যাম্পাসের প্রধান প্রশাসক। তার আগে বছরের প্রথম দিনই পুলিশ হত্যার মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ আলোচনায় থাকতে পারত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ওই পুলিশ সদস্যকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপর্যুপরি কোপালেও তিনি মারা যাননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মাখদুম হল গেটে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। অপরাধ ছিল ধর্মীয় ওয়াজ শোনা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে যান হল শাখা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক সুশান্ত। তার নেতৃত্বে ছাত্রলীগ সদস্যরা দুই পুলিশকে গেটের বাইরে নিয়ে উপর্যুপরি কোপাতে থাকেন। একজন পালিয়ে যেতে সমর্থ হলেও অন্যজন ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ধরাশায়ী হন। কাঁপতে কাঁপতে পুলিশ কর্মকর্তারা মুমূর্ষু কনস্টেবলকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলন। কর্মকর্তা কাউকে জিজ্ঞাসা করেননি, কে এই নির্মম আঘাত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। বিচার তদন্ত এসব নিয়ে তৎপরতা দেখাতে সাহস পেল না কেউ।
যুবায়েরকে দিয়ে শুরু আর বছর শেষ হয়েছিল বিশ্বজিৎকে দিয়ে। গরিব দর্জি বিশ্বজিৎকে রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে প্রাণ বধ করেছে এরা। জান কবজ হওয়া পর্যন্ত প্রতিযোগিতা করে পাষণ্ডরা তার ওপর ধারালো অস্ত্র চালিয়েছে। বিশ্বজিতের ক্ষীণ আশা ছিল হয়তো ধর্মীয় পরিচয় দিলে তিনি রক্ষা পাবেন। হত্যার জন্য যারা প্রতিযোগিতা করছিল তাদের মনের খবর বিশ্বজিৎ জানতেন না। ছাত্রলীগের মনোস্তত্ত্ব এ হত্যাকাণ্ডে প্রকাশ পেয়েছে। অপরাধীরা প্রেসের ক্যামেরা দেখলে যেখানে মুখ ঢাকে সেখানে ছাত্রলীগের এ সদস্যরা যেন হত্যালীলায় তাদের বীরত্ব প্রকাশ পাক তা দেখাতে চাচ্ছিল! তারা এ পৈশাচিকতাকে রাজনৈতিক পদন্নোতির একটি সুবর্ণ সিঁড়ি হিসেবে দেখছিল। কেউ বলেছেন একটি চাকরি পাওয়া নিশ্চিত করতেন হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। তারা দেখাতে জোর অপচেষ্টা চালায় ব্যক্তিগতভাবে মানুষ বধে তারা কতটা পারঙ্গম। বড় ভাইদের রাজনৈতিক গুরুত্বের মানদণ্ডটা তারা ভালো করে জানে।
ছাত্রলীগ ৯ জনকে হত্যা করেছে এ বছর। যুবায়ের ও বিশ্বজিতের মতোই আরো সাতটি তরতাজা প্রাণকে এরা প্রকাশ্য দিবালোকে শেষ করেছে। খালবিলে নাম না জানা যে অসংখ্য লাশ পাওয়া যাচ্ছে সেখানে ছাত্রলীগের অবদান কতটুকু তা জানার সাধ্য কারো নেই। বাংলাদেশের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ডজন ডজন বাহিনী সবাই মহাব্যস্ত নাশকতা আর সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র উদঘাটনে। নোবেলজয়ী ড. ইউনূস সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান গ্রামীণের শক্তি দইয়ে ক্ষতিকারক ফরমালিনের পরিমাণ নিয়ে রাসায়নিক পরীক্ষা ও বিরোধীদলীয় নেতা ফখরুল ইসলামের ময়লার গাড়িতে ঢিল মারার রাষ্ট্রবিনাশী কর্মকাণ্ড তদন্তে এরা রাতদিন ব্যস্ত। বছরজুড়ে ছাত্রলীগ ১০৭৮ জনকে পিটিয়ে আহত করেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনা এগুলো। এর বাইরে আড়ালে-আবডালে আরো কত মারধর, নির্যাতন ও লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছে, তা জানার সাধ্য নেই একই কারণে।
বিজয় দিবসে দুই তরুণীকে হত্যা করা হয়েছে। ১৫ ডিসেম্বর স্বামীবাগ মিতালী স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাচগান শেষে সূত্রাপর থানা ছাত্রলীগ সভাপতি আবু হানিফ ও সাংগঠনিক সম্পাদক রাশেদ রেজাসহ এক বাসায় প্রমোদ আড্ডা হয় গভীর রাত অবধি। সেখানে মদসেবন করা হয়। রেশমা ও তুষি নামের দুই মামাতো ফুপাতো বোন বিষক্রিয়ায় মারা যান। একজন ছিলেন ছাত্রলীগ নেতার রক্ষিতা। গোপনে তাদের লাশ দাফন কাফন হয়েছে। সাংবাদিকেরা আত্মীয়স্বজনের সাথে কথা বলতে চাইলে ভয়ে কেউ মুখ খুলেনি। একই সময় প্রকাশ্যে নারীরা ছাত্রলীগ সদস্যদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন, কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। ইডেন কলেজের ছাত্রীদের দিয়ে দেহ বাবসা করানোর মত কলঙ্কিত ঘটনা বোধ করি ইতপুরবে কেউ শোনেনি! ১৪ এপ্রিল ১ বৈশাখের অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ২০ তরুণীকে ছাত্রলীগ লাঞ্ছিত করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফি কমানোর জন্য আন্দোলনকারী ছাত্রীদের ওপর প্রকাশ্যে অত্যাচার চালায় ।   
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কতটা শক্তিশালী তা গেল বছর দেখিয়ে দিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ পরিণত হয়েছিল নিয়োগবাণিজ্যে। মনে হলো ছাত্রলীগ নেতাদের কামাইরুজির জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হলো। প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিতে গিয়ে তারা বেসামাল হয়ে গিয়েছিল। নির্ধারিত আসনের চেয়ে বেশিসংখ্যক প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল তারা। তাদের সবাইকে নিয়োগ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। তার খেসারত অবশ্য ছাত্রলীগ নেতাদের নয়; দিতে হয়েছে ভিসিকে। দলের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য থাকার পরও ভিসিকে পদ ছাড়তে হয়েছে। ছাত্রলীগের অত্যাচারের টিকতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসমাজ আন্দোলনে নামে। শিক্ষক সমিতির সভাপতি সম্পাদকসহ ৩০ জন শিক্ষককে ছাত্রলীগ পিটিয়েছে। অপরাধীদের একজনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এমন দেখা যায়নি।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের পছন্দের প্রধান প্রকৌশলী নিয়োগ দিতে তারা ভিসিকে অবরুদ্ধ করে রাখে। তাদের কথামতো কাজের পাকা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভিসি সে দিন রক্ষা পেয়েছিলেন। চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি ছিল গতানুগতিক ব্যবসায়। এগুলো অবাধে তারা করেছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। নিয়োগ ও ভর্তিবাণিজ্য এবার ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। এ জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের পদ বিক্রি হয়েছে চড়াদামে। একটি জাতীয় দৈনিক ছাত্রলীগ নেতাদের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামনোর ওপর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে দলটির তোপের মুখে পড়ে। প্রতিবেদনে কার কটি কোন মডেলের গাড়ি, কোথায় ফ্যাট ও প্লট রয়েছে এসব বিষয়ে প্রামাণ্য তথ্য প্রকাশ করেছে।
নতুন বছরটি কেমন যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় ক্যাম্পাসে একদল সাংবাদিককে পিটিয়ে তার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগের তাণ্ডবে শিক্ষামন্ত্রী নীরব। তার ভূমিকা দেখে মনে হচ্ছে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে শিক্ষা ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলছে না। অথবা ছাত্রলীগের সাথে ক্ষমতাসীন দলের কোনো সম্পর্ক নেই। পতিত এই বামনেতা মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠনের দায় নিতে চান না। দেশের বাম প্রভাবিত গণমাধ্যম তাকে একজন সফল মন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই অরাজক পরিস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যম খুব পরিকল্পিতভাবে তার কোনো বক্তব্য নিচ্ছে না।
ক্ষমতাসীন দলের খুদকুঁড়ো খাওয়া একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বারবার এ কথা বলার চেষ্টা করছেন ছাত্রলীগ এক মহাগৌরবময় সংগঠন। সম্প্রতি এরা খারাপ হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবকে কাজে লাগানোর জন্য সন্ত্রাসীরা এই ছাত্রসংগঠনে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ গৌরবের কী কাজ দেখেছে দেশবাসী? প্রত্যেকটি অস্ত্রবাজি, টেন্ডারবাজি ও নারী নিপীড়নের ঘটনার সাথে ছাত্রসংগঠনটির বিভিন্ন শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা জড়িত। ছাত্রলীগের সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন? এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে ছাত্রলীগের অপকর্মকে প্রশ্রয় দেয়া হয়।
প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের রাজনীতির অপছায়া এখন ছাত্রলীগের ওপর ভর করেছে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads